আমার কণ্ঠের তীব্রতায় তার আত্মবিশ্বাস কমে গেল বলে মনে হলো। গাড়ি থেকে সিনিয়র নেমে এলেন। ‘কে ভাই, আপনি? আমাদের কাজে বাধা সৃষ্টি করছেন কেন! আপনার কাজে যান।’
মুহূর্তেই লোক জড়ো হয়ে গেল চারপাশে। চোখেমুখে জল দিলে জ্ঞান ফিরতে পারে। কিন্তু জলের বোতল পাওয়া গেল না কারও কাছে। মেট্রোরেলে জলের বোতল নিয়ে ভ্রমণে নিষেধাজ্ঞা আছে। একজন দৌড়ে গিয়ে বাইরে থেকে জলের বোতল নিয়ে এলেন। চোখেমুখে জলের ঝাপটা দিতেই চোখ খুললেন তিনি। কিছু সময়ের মধ্যে চারপাশের ভিড় কমে গেল। তার হাত ধরে নিয়ে স্টেশনে বসার জন্য ইট-সিমেন্ট-বালু দিয়ে করা বেঞ্চের ওপর বসলাম। বোতল হাতে দিয়ে বললাম, ‘জল খান, ভালো লাগবে।’ বোতল থেকে জল গালে দিয়ে উঠে যাচ্ছিলেন তিনি। হাত ধরে থামালে বসলেন। ‘একটু বসে বিশ্রাম নিয়ে নেন। তারপর ডাক্তার দেখাতে যাব চলেন। প্রেশার ঠিক আছে কি না বা অন্য কোনো সমস্যা কি না বোঝা যাবে।’ ঠোঁটের নিচে হাসলেন। সাদা বক যেমন উড়ে যাওয়ার সময় কিছু শূন্যতা রেখে যায়। তাঁর হাসিমুখ দেখে তেমনই শূন্যতা অনুভব করলাম। ‘কোনো সমস্যা নেই। সমস্যা আমার কপালে। বাদ দেন, ধন্যবাদ আপনাকে। আমি যাই, থাকার জায়গা খুঁজতে হবে। রাত হয়ে গেলে পেরেশানিতে পড়ব। অনেক ধন্যবাদ।’
‘আমার সঙ্গে চলেন, আমার সঙ্গে থাকবেন। ভয় নেই, আমি খারাপ মানুষ নই।’ বলে অফিসের কার্ড দেখালাম। মৃদু হেসে হাত বাড়িয়ে দিয়ে বললেন, ‘আমি কলরব। বাগেরহাট থেকে আসছি। খুলনা বিশ্ববিদ্যালয় থেকে ফিজিকসে স্নাতক ও স্নাতকোত্তর শেষ করেছি। বয়সে আপনার ছোটই হব। আমাকে তুমি করে বলেন, প্লিজ।’ করমর্দন শেষে মেট্রোস্টেশন থেকে নেমে শাপলা চত্বরের পাশ দিয়ে বাংলাদেশ ব্যাংকের সামনে দিয়ে হেঁটে পরের গলির মুখে গিয়ে দাঁড়ালাম। মোবাইল বের করে কারও সঙ্গে কথা বলছিল কলরব। হঠাৎ একজন লোক এসে তার কলার চেপে ধরল। সঙ্গে সঙ্গে আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনীর একটা গাড়িও এসে দাঁড়াল পাশে। কিছু বুঝে ওঠার আগেই কলার চেপে ধরা লোকটা গাড়িতে থাকা সহকর্মীদের বলল, ‘এই-ই, কোনো ভুল হয়নি। দ্রুত আসেন গাড়িতে তুলুন এটাকে।’ ‘আমি কিছু করিনি। মারবেন না, মারছেন কেন! আমি কিছু করিনি।’ সিগারেট ফেলে এগিয়ে গেলাম।
‘কী ব্যাপার, কী সমস্যা?’
‘আপনি কে? আপনাকে বলতে হবে কেন, একসঙ্গে নাকি? আপনাকেও তুলব নাকি গাড়িতে?’
‘ভদ্রভাবে কথা বলেন। অভিযোগ কী, সেটা বলেন আগে, তারপর দেখছি কে কাকে গাড়িতে তোলে।’
আমার কণ্ঠের তীব্রতায় তার আত্মবিশ্বাস কমে গেল বলে মনে হলো। গাড়ি থেকে সিনিয়র নেমে এলেন। ‘কে ভাই, আপনি? আমাদের কাজে বাধা সৃষ্টি করছেন কেন! আপনার কাজে যান।’
‘আমার পরিচিত। কী সমস্যা, না বললে নিয়ে যেতে পারবেন না।’ বলে পকেট থেকে কার্ড বের করে দেখালে ‘স্যার’ বলে যথাযথ সম্মান দেখালেন।
‘আমরা সন্দেহ করছি, মাদকের সঙ্গে তার যোগসূত্র থাকতে পারে। তবে আপনার পরিচিত যখন, তখন আর সমস্যা নেই। আপনারা যান, স্যার। আমাদের কাছে ইনফরমেশন ছিল। সরি, কিছু মনে নিয়েন না। এই স্যারকে সরি বলো।’ শুরুতে যে খারাপ ব্যবহার করেছিল, কলরবকে থাপ্পড় মেরেছিল, সরি বলল সে। তারা চলে গেলে কলরব দৌড়ে এসে জড়িয়ে ধরল। মৃদু হাসি ছাড়িয়ে বললাম, ‘চলো বাসার দিকে যাওয়া যাক।’
মোড়ের দোকান থেকে সিগারেট কিনে কলরবের হাতে দিলাম। বেনসন লাইট। প্রথমে না না করলেও পরে একটা ধরাল কলরব। হাঁটতে হাঁটতে গেটের সামনে পৌঁছাতেই কারেন্ট চলে গেল। ১১টার পর গেট বন্ধ হয়ে যায়। ঘড়িতে ৯.৫০ বাজে। ডাকলে দারোয়ান গেট খুলে দিল। ‘স্যার, এক ম্যাডাম আয়ছিল আপনের কাছে। কী যেন নাম বলল, হিয়া। আপনেরে ফোনে পাইতেছে না। কল করতে কইছে। মনে কইরে কল কইরেন।’ মাথা নেড়ে হ্যাঁ বলে কলরবকে নিয়ে বাড়ির মধ্যে ঢুকলাম। আমি থাকি তিনতলায়। দুই রুম। একা থাকি। বাড়িওয়ালা ব্যাচেলর ভাড়া দেন না। এক পরিচিতের মাধ্যমে সুপারিশ করে নিয়েছি। তা-ও এই শর্তে যে একা থাকব, অন্য কেউ থাকবে না।
সিঁড়ি দিয়ে উঠতে উঠতে প্যান্টের ডান পকেট থেকে সেলফোনটা বের করলাম। ৭৭টা মিসড কল। হিয়া কল করেছিল, মিসড কল হয়ে আছে। ওয়াই-ফাই অন করতেই হোয়াটসঅ্যাপে অনেকগুলো মেসেজ এল। ছবি পাঠিয়েছে হিয়া। সঙ্গে একটা টেক্সট, ‘কী হট না! লোভ হয় না? কাপুরুষ একটা।’ হোয়াটসঅ্যাপে পাঠানো ছবি দেখতে হলে ডাউনলোড করে নিতে হয়। সরাসরি দেখতে পারি না। কিন্তু মেসেজটা দেখে ডাউনলোড করার সাহস হলো না। পকেট থেকে চাবি বের করে কলরবের হাতে দিয়ে সহকর্মীকে কল করে হিয়ার ফাইলটা ছেড়ে দিতে বললাম। মেয়েলি ঝামেলায় ফেঁসে গত মাসে এক সহকর্মীর চাকরি চলে গেছে। হিয়া, আবেদনময়ী, কম বয়সী, ছলাকলা জানে। নিজেকে নিয়ন্ত্রণ করা ক্রমে কঠিন হয়ে যাচ্ছে। কখন কী ঘটে যায়, বলা যায় না। হিয়ার থেকে যতটা দূরে থাকা যায়। ততই ক্যারিয়ারের জন্য মঙ্গল। কল কেটে দিয়ে ইত্যাদি ভাবতে ভাবতে দরজার সামনে গেলাম। ‘দাদা, কোনো সমস্যা?’ কলরব জিজ্ঞাসা করলে ‘আরে না। দরজা খোলোনি কেন! দ্রুত খোলো, আগে গিয়ে ফ্রেশ হয়ে নাও।’ ঘরে ঢোকার মুহূর্তেই ‘ইনফরমেশন ছিল’, কথাটা কানে বেজে উঠল। কলরব সত্যি সত্যিই কোনো খারাপ কাজের সঙ্গে জড়িত নয় তো?