বাসুন বারোতে (দ্বিতীয় পর্ব)

চিঠিটি আমার একমাত্র ছেলেকে উদ্দেশ করে লেখা। এই চিঠি যখন লিখি, তখন তার বয়স ছিল ১১ বছর। বর্তমানে সে ২৪ বছরের তরুণ।

অলংকরণ: মাসুক হেলাল

বাসুন,

বাইরে ঝকঝকে রোদ, কী অপূর্ব প্রকৃতি। এইমাত্র বাইরে থেকে ঘরে ফিরলাম। গিয়েছিলাম ডাউনটাউন টরন্টোতে। পথে যেতে যেতে ভাবি বয়ে বেড়ানো এই জীবনের কথা। কিছু কি হিসাব মেলে বাসুন? কারোরই কি মেলে? আজ সকালে ঘুম থেকে উঠেই বসেছিলাম নেটে। কাল রাতে একুশে ব্লগে লেখা দিয়েছিলাম। ওদেরকে বলেছিলাম, তোকে নিয়ে আবার লিখতে চাই। খুব জানতে ইচ্ছা করছিল ওরা লেখাটা দিয়েছে কি না। দেখি, সত্যি আমার লেখাটা পোস্ট করেছে। কী ভীষণ ভরে গেল মন।

আমার বেডরুমেই নিচে বিছানা করে ঘুমিয়ে পড়িস তুই। কয়েক দিন হলো এই কাজ করছিস। বারবার বলি, তোর ঘরে গিয়ে ঘুমাতে। কিছুতেই না, কী আর করা! রাতে যখন শুতে যাই তখন মনে হয়, তা–ও তো ভালো, তুই আমার ঘরেই আছিস, শূন্য তো নয় এই ঘর। জানিস সোনা, লোনলিনেস যে কী, সেটা যারা না ভোগে, তারা জানবে না কোনো দিন। আমি জানি আর জানিস তুই, তাই না সোনা? মনে আছে তোর, সেই যে আরও দুই বছর আগে, তোর স্কুলের ক্লাস টিচার ফ্যামিলির ছবি আঁকতে দিয়েছিল ক্লাসে। তুই নাকি চুপ করে বসেছিলি। তোর টিচার বলেছে, কী হলো সামির? তুই বলেছিলি, ‘মি অ্যান্ড মাই মম অনলি, মাই ফাদার নট উইথ আস’, বলেই নাকি সেকি কান্না। পরে স্কুল থেকে এসে আমাকে বলেছিলি তুই সে কথা। আমি ভুলতে পারি না সেই মুখ বাবু। কী বলব বল? মানুষ কি সব পায় এক জীবনে?

তবু তো তুই আছিস আমার হয়ে। আজ যখন তোকে বললাম, ‘বাবু দেখ, তোর কাছে আবার চিঠি লেখা শুরু করেছি। এই দেখ, তোকে লেখা চিঠি।’ তুই কী অবাক সুন্দর করে জানতে চাইলি, ‘ইস অল অ্যাবাউট মি, মা?’ আমি বলি, ‘হ্যাঁ বাবু, তোকেই তো বলছি সব কথা। আর কাকে বলব বল? মানুষের তো শ্রোতা লাগে, তাই না বাজান?’

আমার জীবনের সেটা তুই সোনাপাখি। তুই এসে আমার গলা পেঁচিয়ে ধরিস। মুহূর্তে ভুলে যাই সব কষ্ট, না পাওয়া। মনে হয়, এক জন্মে বুঝি আর কিছু চাওয়ার নেই। ওই যে বলছিলাম তোকে, সকালে গিয়েছিলাম বাইরে, কী সুন্দর ডাউনটাউন টরন্টো। যেন মনে হয় বর্ষাধোয়া এক অপরূপ তরুণী গোটা শহরটা। ফাঁকা ফাঁকা, নির্জন রাস্তা দিয়ে মানুষ হেঁটে চলছে। জীবন কী অদ্ভুত  সুন্দর, কোন দেশ থেকে এসে আমি কোথায় হাঁটছি। তোকে সকালের নাশতা দিয়ে একটা ব্রেড নিয়ে বেরিয়েছিলাম সকালে। কফি শপ খুঁজছিলাম, শীতে জড়াজড়ি করা শহরের কোনায় কোনায় কফির দোকান। একেকটি দোকানে একেক নিয়ম বাবু, আমি যেন কিছুই জানি না এই শহরের। আজ লিখব বলেই কি না  জানি না, সব কিছু নতুন লাগছিল। শপে কাজ করছে সাদা এক ৩৫ ঊর্ধ্ব যুবক। একটু অবাক হয়ে তাকিয়ে থাকি। তারপর কফির কথা বলতে সময় লাগে, বুঝতে পারি, খুব পশ দোকান, দামি দোকান। কথা বলি জনের সঙ্গে, দক্ষ হাতে কফি বানাচ্ছে ও।

আরও পড়ুন

জানতে চাই, ‘এই দোকানের নাম কী?’
বলে, ‘বারিস্তা।’
‘মানে কী?’
‘মানে, কফি (ইতালিয়ান শব্দ)।’
‘তুমি কি সারা দিন এই কাজ করো?’
‘না, আমি দুইটার পর কাজ করি না।’
‘এরপর কী করো?’
‘আমার নিজের সময় কাটাই’, বলেই জন ঘাড় নাচায়।

আমি বিল দিয়ে চলে আসি। ভাবি, জনের কি বউ আছে বা বান্ধবী? বা কোনো টান? যে কারণে ঘরে ফেরে জন। আমি যেমন ফিরি দিন শেষে। বাবু আমার, বাসুন আমার, আমি ঘরে ফিরি তোর জন্য। ফিরছি গত ১১ বছর, তোকে দেখে দেখে, তোর বড় হওয়া দেখে দেখে জীবনকে চিনে নিই। কত শক্তি পাই আমি, জানিস তুই বাজান? ওই যে সেদিন তোকে বললাম, সব কথা তোকে বলে যাব। সত্যিই সত্যিই তোকেই সব বলে যাব।

তোর মা
২৩ নভেম্বর, ২০১১

টরন্টো, কানাডা