চিঠি
বাসুন বারোতে (প্রথম পর্ব)
চিঠিটি আমার একমাত্র ছেলেকে উদ্দেশ করে লেখা। এই চিঠি যখন লিখি, তখন তার বয়স ছিল ১১ বছর। বর্তমানে সে ২৪ বছরের তরুণ।
বাসুন,
অফিস থেকে ফিরতি পথে ভীষণ হতাশ লাগছিল। ইদানীং মনে হয়, পৃথিবীর কোথাও এক ফোঁটা আশ্বাসও বুঝি আমার জন্য নেই। টরন্টোতে শীতের শুরু, সেপ্টেম্বর মাসের শেষ দিকে। আমি বাসে করে বাড়ির দিকে ফিরছি। হঠাৎ দেখি হুইলচেয়ারে করে একজন সাদা চামড়ার মানুষ পাবলিক বাসে উঠছে। অনেকক্ষণ ধরে লোকটা মুখ দিয়ে নেড়ে নেড়ে চোয়াল বরাবর রিমোটটা দাঁত দিয়ে নেড়ে নিজেকে চালিত করছে, দুই হাত হুইলচেয়ারের সঙ্গে বাঁধা। লোকটার হাত দুটো অচল। বিস্মিত হয়ে মানুষটাকে দেখতে লাগলাম! কিন্তু আমি কেন হতাশ হয়ে আছি? কী নেই আমার? কীসের জন্য দুঃখ করছি?
একটা সময় ছিল বাবু, এই শহরে নতুন ছিলাম তুই আর আমি। তোকে বাসায় রেখে এক ঘণ্টার জন্য কোথাও গেলে ডলার গুনতে হতো। আমি তো সেই দিনকেও পার করেছি। তুই বাসায় একা থাকতে পারিস, তা প্রায় তিন বছর হতে চলছে। তোকে নিয়ে বাসুন পর্বের যে বই লিখেছিলাম, সেখানে আমার এই শহর নিয়ে আবেগ ছিল, বিদেশে কী করে তোকে নিয়ে দিন পার করেছি, সেটা লেখা ছিল।
আজও আমি দিন পার করছি। প্রত্যেক মানুষই করে। কিন্তু এখন আমি অনেক বেশি একা এই শহরে। মনে হয় কোনো দূর অতীতে আমার একটা জীবন ফেলে এসেছি। সেখানকার মানুষ আর আমাকে মনে রাখেনি। বাংলাদেশ নামক সেই দগদগে পোড়া ঘা, এর ওপরে মোটা শক্ত চামড়া হয়ে গেছে যেন! এখন তুই পাশের ঘরে একা ঘুমাস। আমি একা বসে থাকি আমার ঘরে। আমার বাইরের কাজ যেমন বেড়েছে, তেমনি বেড়েছে গভীর একাকিত্ব।
এখন আর তোর সেই শিশুমুখ দেখি না। এখন দেখি ১২ বছরের ছেলে তুই। তোর মতামত হয়েছে, হাই স্কুলের গল্প করিস, একা থাকতে চাস, নিজের মতো সময় কাটাতে চাস। সময় সময় আমাকে বলিস, ‘মা, ইউ হ্যাভ টু পাস ইয়োর ওউন টাইম।’ আমি কেমন করে নিজের সময় পার করব বাবা? আমি তো তোকে বড় করব বলে নিজের জন্য ভাবলাম না। এখন যে আমার বেলা বয়ে গেল সোনা। না বাবু, তুই ভাবিস না, কোনো দিন তোকে অভিযোগ করব না। কেন বলব আমি তোর জন্য একা হয়ে গেছি? এমন মিছে কথার দরকার কী বল? আসলে আমি যখন ভাবতে শুরু করেছি, তখন অনেক দেরি হয়ে গেছে বাবু। আবার ভাবি, দেরি কি মানুষের জীবনে কখনো হয়? হয়তো না। এই যে প্রতিদিন পৃথিবীর কত কত মানুষ দেখি, কত রং জীবনের বাবু।
ভেবেছি তোকে লিখব আবার। যা দেখলাম, যা দেখে ভাবলাম জীবন কত ব্যাপক ও বিস্তর, আবার জীবন কি গভীর একাকী—মাঝরাতে যখন ঘুম ভেঙে যায়, তখন ফেলে আসা স্মৃতি মনে পড়ে বাজান। ভালোবাসা না পেয়ে পেয়ে বোবা কান্না বেরিয়ে আসে দুই চোখ বেয়ে। আবার ভাবি, দুঃখ না পেলে কি জীবন অর্জন করা যায় সোনা বাবা আমার? এই পর্বে তুই আর সেই ছোট্ট বাসুন না, এই মাসে তুই বারোতে পা দিবি। আর মাত্র ছয় বছর পরে তুই সাবালক। আমার বুকের ভেতর কাঁপতে থাকে বাবু, কোন ফাঁকে না তুই আমাকে বলে বসিস—‘মা, আমি বড় হয়ে গেছি। তোমার কী চাই বলো?’
সেদিনও যেন সেই ছোটবেলার মতো তোর কপালে চুমু দিয়ে বলতে পারি, ‘তুই একজন অতি সাধারণ মানুষ হয়ে ওঠ বাজান। শুধু এই-ই আমি চাই।’
তোর মা
২৭ অক্টোবর ২০১১
টরন্টো, কানাডা