বেশির ভাগ দিনই ভাবতে ভাবতে অফিস থেকে ফিরে নিজেকে বলি, বাড়িতে ফিরেই লিখতে বসব। কিন্তু অফিস ফেরার পথে মাথায় যে বাস্তবতা থাকে আর বাসায় যখন ঢুকি, এই দুই বাস্তবতা এক হয় না।
বাসায় ফিরেই দেখব, নাইয়া সারা বাড়ি এলোমেলো করে রেখেছে, রান্নাঘরের বেসিনভরা থালাবাসন, হয়তো কাপড়জামা এদিক–ওদিক ছুড়ে রাখা; নিজেকে সান্ত্বনা দিই; থাক, ছেলেটা সময় সময় আসে, একটু নাহয় এলোমেলো করলই।
ব্যস, পাঁচটায় বাসায় ফেরার পর কখন রাত পৌনে নয়টা বাজবে, সেটা টের পাব না। কিন্তু মাথার ভেতর ছাড়পোকার মতো পিলপিল করে হাঁটতে থাকে রক্তচোষার দল, মগজ চুষতে চুষতে করোটি জানান দেয়, লিখতে বসতে চেয়েছিলাম, লিখতে বসতে চেয়েছিলাম। সেই পুরোনো কথা; একটা হলে আরেকটা হবে না। কিছুতেই এক জীবনে সব করতে পারবে না, কিছুতেই না। এই যে লিখতে বসলাম, এই মুহূর্তে অন্তত পাঁচ-ছয়টা কাজ বাকি। ঘুমানোর আগেই কাজ সারতে হবে, হতেই হবে; না হলে আমার ঘুম আসবে না। কিন্তু কী করব, লিখব না?
ইরানি মেয়ে আস্তুরার অপরূপ গোলাপি মুখটা ভেসে আছে চোখের সামনে।
সকালে অফিস শুরু করে ও ওর দামি ব্যাগ থেকে আমার লেখা বই ‘বাসুন-কে মা’ বের করে বলে, ‘লুনা, আমি আমার বোনকে বলেছি তোমার বইয়ের কথা। আমি তোমার বই পড়ছি, কিন্তু বারবার কান্না পাচ্ছে।’ এই বলে আস্তুরা জড়িয়ে ধরে, ‘জানো, আমি নিজেও রিফিউজি হয়ে এই দেশে এসেছিলাম একদিন। বই পড়তে গিয়ে মনে হচ্ছে, তুমি আমার কথাগুলোই লিখেছ।’
আস্তুরার হাতে থাকা ‘বাসুন-কে মা’ বইটা দেখছিলাম। একমাত্র বই, যার ইংরেজি ভার্সন আছে। সহকর্মীদের সঙ্গে সখ্য হলে ওদের পড়তে দিই। এ যাবৎ যারা বই পড়েছে, সবাই শুরুতেই বলে, ‘তুমি খুব হৃদয় দিয়ে লেখো, তা–ই না?’
‘আর কী দিয়ে লেখা যায় বলো?’
সাহিত্যের মূল্য জানা নেই। সাহিত্য কী করে লিখতে হয়, তা–ও জানি না। শুধু জানি, শেয়ার করার জন্য মন পোড়ে। পুড়তেই থাকে। সেই বেদনা থেকেই একদিন যাপিত জীবনের কথা লিখতে বসেছিলাম ২০০৭ সালের কোনো এক গ্রীষ্মে। ছয় বছরের শিশুসন্তান নাইয়াকে চিঠি লেখা শুরু করেছিলাম মুক্তমনা ব্লগে।
সেই শুরু। আজ আবার আস্তুরার কাছ থেকে নিজের বই চেয়ে নিয়ে পড়লাম একটা চিঠি। ৫০টা চিঠি দিয়ে সাজানো প্রথম বই ‘বাসুন-কে মা’। বইয়ের প্রকাশক সাদা-কালোর বোন শাহিন বলে, ‘মেজপা, কেন ছাপো তোমার বই? এই বইয়ের সঙ্গে মানুষকে টাকা দিলেও তো পড়বে না কেউ।’ আমি বলি, ‘শাহিন, বই ছাপাই নিজের জন্য। একদিন যখন লেখা, কথা বলার শক্তি থাকবে না, সেদিন নিজের ফেলে আসা দিন সঙ্গে নিয়ে বসে থাকব। নিজের বই হাতে নিয়ে বসে থাকব। সেদিন ফিরে ফিরে দেখব, কেমন একটা জীবন ফেলে এসেছি; এ কারণেই বই ছাপি।’
যখন বয়স থাকে, সামর্থ্য আর শক্তি থাকে, তখন কত কত আয়োজনের সঙ্গে নিজেকে জড়িয়ে রাখি! একদিন যদি সেই সব স্মৃতি মনে করে নিজের কাছে নিজেই একটু ভালো থাকি, সেটা কি খুব বড় চাওয়া নিজের কাছে?
কস্টি শেল্টার সার্ভিসে কাজ শুরু করেছি ১০ মাস হতে চলল। কী বিপুল আয়োজন জীবনের, ভাবা যায় না। কত দূর থেকে একটা জীবন পেয়েছিলাম, সেই বাংলাদেশের মঙ্গাপীড়িত জেলা রংপুরে জন্ম। সেখান থেকে পথ নিয়ে এল কানাডার শেল্টার সার্ভিসে। একা বসে যখন ভাবি, তখন বিস্ময় কাটে না।
আসলে জীবন এভাবে চলে না। আমার যা করার, আমাকে তা করে যেতে হবে। ওই যে লেখার শুরুতে বলছিলাম, জীবনে সবকিছু একসঙ্গে হবে না, কিছুতেই নয়।
নাইজেরিয়া থেকে ৪০ বছরের সিঙ্গেল মাদার আকিন্তোলা এই শেল্টারে এসেছে মাত্র চার দিন আগে, সঙ্গে গ্যাদা তিন সন্তান। এয়ারপোর্ট থেকে শেল্টারে পা দেওয়ার মুহূর্ত থেকে আকিন্তোলা আমার ক্লায়েন্ট।
কেমন আছে এই মুহূর্তে আকিন? সাত বছরের ছেলে ক্যাভিনকে নিয়ে কি এখনো আকিন হাসপাতালের বারান্দায় অপেক্ষা করে আছে? গতকাল অফিস থেকে চলে আসার আগে জীবনে প্রথম একটা রোগের নাম শুনলাম, সিক্যল সেল। কোনো দিন এই নাম শুনিনি। এটা নাকি অ্যানিমিয়ার সঙ্গে জড়িত।
শরীরের সব নালি দুর্বল হয়ে যাবে, রোগী খুব ঠান্ডা বোধ করবে এবং অনেক সময় রোগীকে রক্ত বদল করতে হতে পারে। কিন্তু এটা খুব জটিল কিছু নয়। এই রোগ নিয়ে যে কেউ স্বাভাবিক মানুষের মতোই দীর্ঘজীবী হতে পারে। আকিনের বড় ছেলে ক্যাভিন এই রোগে আক্রান্ত। এদিকে, আকিন যদিও তিন সন্তান নিয়ে কানাডায় রিফিউজি ক্লেইম করেছে; কিন্তু লিগ্যাল রিফিউজি পেপার আকিনের হাতে আসবে আরও তিন সপ্তাহ পরে। এই মুহূর্তে আকিনের হেলথ কাভারেজ বা ইনস্যুরেন্স নেই। তাই বলে কি ক্যাভিনের চিকিৎসা হবে না?
নিশ্চয়ই হতে হবে। আমাদের মতো হাজার হাজার কানাডিয়ানের বিশাল অঙ্কের ট্যাক্সের ডলার দিয়ে আকিনরা এই দেশে সেবা পাবে। আমি যদি সারা দিন–রাত গলায় রক্ত তুলে ফেলি, আমার বিশাল অঙ্কের ট্যাক্স চলে যাচ্ছে; এটা আমি সহ্য করতে পারি না। কোনো লাভ হবে না। এটাই কানাডার নিয়ম, ট্যাক্স দিতেই হবে।
অন্য একটা কথা বলে এই পর্বের ইতি টানি।
এক বাঙালি মহিলা বিগত ১৮ বছর ভালো চাকরি করত এবং বেশ বড় অঙ্কের ট্যাক্স তাকে পরিশোধ করতেই হতো। সেটা নিয়ে বাঙালি মহিলা যে খুব খুশি, তা নয়, এমনকি আমি নিজেও খুশি নই এটা নিয়ে। যাহোক, খুব সম্প্রতি সেই মহিলা কঠিন অসুখে পড়ে এবং অবাক করে দিয়ে এই দেশ মানে কানাডা তাকে ভীষণ সাহায্য করে। ২২ দিন হাসপাতালে বিনা খরচায় থাকা এবং এখনো হাসপাতালে নানা সুবিধা পাওয়ার জন্য তাকে একটা পেনিও পরিশোধ করতে হয়নি। মহিলা এখন বেশ তুষ্ট গলায় বলে, ‘যাক লুনা, এত বছরের ট্যাক্সের ডলারের ভালো সুবিধা ভোগ করলাম। সব পেইড অফ, জানো তো!’
ভাবছি আকিনের কথা। ও তো মাত্র তিন দিন আগে এসেছে। এক ডলার পরিশোধ করার কথা তো বাদ থাক, এমনকি আকিনের হাসপাতালে আসা-যাওয়ার ট্যাক্সির রশিদ আমি সাইন করছি প্রতিদিন। এখন কি আমি আকিনকে বলতে পারি, তোমার মতো রিফিউজিদের সাহায্য করার জন্য কানাডার সরকার আমার বেতন থেকে বড় অঙ্কের ডলার কেটে নেয়, আমি তোমাকে একদম সহ্য করতে পারছি না!
আসলে জীবন এভাবে চলে না। আমার যা করার, আমাকে তা করে যেতে হবে। ওই যে লেখার শুরুতে বলছিলাম, জীবনে সবকিছু একসঙ্গে হবে না, কিছুতেই নয়। এটাই সত্য, এটা মেনে নিলেই শান্তি পাব। নিজেকে বলতে হবে, জীবনের ব্যালেন্স শিট মিলবে না, আবার কিছু কিছু মুহূর্ত এমনভাবে মিলে যায়, তখন মনে হয় এতটা তো চাইনি জীবনের কাছে।
অফিস শেষে আস্তুরা আবার জড়িয়ে ধরতে আসে। বলে, ‘আমি তোমাকে জড়িয়ে ধরতে চাই। তুমি এত সাহসী, এত সাহসী, আমি ভাবতেই পারছি না।’ বুঝতে পারি, সেই সকালের পর আস্তুরা আরও পাঁচ-ছয়টা চিঠি পড়ে ফেলেছে। সেই মুহূর্তে মনে হচ্ছিল, আর তেমন কি কিছু চাই জীবনের কাছে?
কাল সকালে অফিসে গিয়ে আকিনের ছেলে ক্যাভিনের খোঁজ নিতে হবে। এইবেলা ঘরের কাজগুলো সেরে ফেলি। করোটির ভেতর জমে থাকা ছাড়পোকার চলাচল কমে এসেছে। বেশ হাল্কা লাগছে এখন।
১১ এপ্রিল, ২০১৮
টরন্টো, কানাডা