উইলির পেটের কাছে শক্ত বেল্ট দিয়ে একটা মাঝারি সাইজের ব্যাগ বাঁধা আছে গত তিন বছর। ছেলেদের অণ্ডকোষে যে ক্যানসার ধরা পড়ে, সেটা ধরা পড়েছিল ২০১৭ সালে। ডাক্তার বলেছিল, উইলির আয়ু আছে আর মাত্র আড়াই মাস। কিন্তু ও বেঁচে আছে আজ তিন বছর চলছে।
২০২০ সালের ফেব্রুয়ারির ৬ তারিখে উইলির জন্মদিন ছিল। পরিবার, বন্ধু ও সহকর্মী মিলে প্রায় ৮০ জন উপস্থিত ছিল জন্মদিনের আসরে। উইলি ৯১ বছর বয়সে পা রাখল। পেটের কাছে যে মাঝারি সাইজের ব্যাগ বহন করে, সেখানে ওর পটি জমা হয়। দুদিন অন্তর একজন নার্স এসে সেই ব্যাগ বদলে দিয়ে যায়। এভাবেই মাত্র আড়াই মাসের আয়ু নিয়ে ডাক্তারের কথাকে তুড়ি দিয়ে উইলি বেঁচে আছে বহাল তবিয়তে।
শুনেছি ৯১ বছর বয়সী উইলি উত্তরাধিকার সূত্রে অঢেল সম্পদের মালিক। তাই এই অ্যাডাল্ট গ্রুপ হোমে, মানে যেখানে ছুটির দিনে পার্টটাইম কাজ করি বা উইলি যে হোমে থাকে, সেখান থেকে ওকে আলাদা করে ট্রিট করা হয়। যেমন প্রতি ভ্যালেন্টাইন ডেতে উইলিকে দামি খাবারের দোকানে নিয়ে যাওয়া হয়। ওকে সপ্তাহে হাতখরচ দেওয়া হয়, আলাদা করে সোশ্যাল ওয়ার্কার রাখা হয়। বছরে দুইবার ওকে অন্য দেশে বেড়াতে নিয়ে যাওয়া, সেখানে সঙ্গে ২৪ ঘণ্টা লোক রাখা হয়।
উইলির নামে যে চ্যারিটেবল ফান্ড রাখা আছে, সেখান থেকেই যাবতীয় খরচ বহন করা হয়। এসব শুনে অনেকক্ষণ হা করে বসে থাকি। বোকার মতো বাঙালি সুপারভাইজার নিপাকে জিজ্ঞেস করি, ‘তার মানে আমি যে এসব মানুষকে খুব অসহায় ভাবছি—আসলে এরা অসহায় না, তাই না?’
ছয় বছরের পুরোনো কর্মী নিপা অবাক করে বলে, ‘আপা, ওদের টাকায় আপনার বেতন হচ্ছে। খুব মন দিয়ে কাজ করেন।’
গ্রুপ হোমের অন্য একজন বসবাসকারী ৯৫ বছর বয়সী লুসিল। চায়নিজ মহিলা লুসিলের গায়ের মাংস চিরে চিরে রক্ত বের হচ্ছে, শরীরের নানান জায়গায় পচন ধরেছে। মাস ছয়েক আগে লুসিলকে প্যালিয়েটিভ কেয়ারের পেশেন্ট হিসেবে ঘোষণা দেওয়া হয়। অর্থাৎ সে এই গ্রুপ হোম থেকেই মরণের পথে যাবে। ওকে আর নতুন করে চিকিৎসা করা যাবে না। এই হোমের সব শিফটের কর্মীদের কাজ হচ্ছে লুসিলকে যথাসম্ভব যত্ন করে ড্রেসিং করানো।
এই ভয়াবহ অসুস্থতা নিয়েও লুসিল কথা বলতে পারে। নিজের অবস্থান জানান দিতে পারে। দুপুরে যখন নিপার সঙ্গে শিফট করছিলাম, তখন এক ঘণ্টায় আমাদের দুজনকে মোট তিনবার ‘বিচ’ বলেছে লুসিল। আমাদের অপরাধ, ওকে ডেসিং করার সময় নাকি বেশি জোরে পরিষ্কার করেছি। যাঁরা খুব কাছ থেকে এ রকম রোগীকে দেখেছেন, তাঁরাই বলতে পারবেন মানুষের শরীরের পচা মাংসের গন্ধ কী বিকট আর দুর্গন্ধযুক্ত হতে পারে।
সারা দিন কাজ সেরে ঘরে ফিরে যখন নিজেকে গোসল করাই, তখন প্যাটি আর লুসিলের কথা মনে পড়ে। অন্তরাত্মা কেঁপে ওঠে।
লুসিলের বেঁচে থাকাকে একটা অভিশাপ ভাবতে ইচ্ছা করে। কিন্তু জীবনের নিয়ন্ত্রণ কি আমাদের কারও হাতে? আমি কি হলপ করে বলতে পারি, আগামীতে লুসিলের ঘরটা আমার হবে না? জীবন এক ঘুঘু ডাকা দুপুরের মতো নির্জন নিঃসঙ্গ পথ। তবু আমরা সেই পথেই সঙ্গী খুঁজি, সুখ খুঁজি।
২০১৯ সালের ডিসেম্বর মাস থেকে একটা হেলথকেয়ারের খণ্ডকালীন কাজের সঙ্গে যুক্ত হয়েছি। ছোট বোনের মতো বন্ধু নিতা এই কাজের লিংক দিয়ে বলেছে, ‘লুনা আপা, তোমার ইচ্ছা হলে তুমি শিফটের জন্য সাইন আপ করবে, আর ইচ্ছা না হলে করবে না। কাজের জন্য কেউ তোমার গলায় পাড়া দেবে না।’
২০১৯ সালের ডিসেম্বর থেকে ২০২০ সালের ফেব্রুয়ারি অবধি এভাবেই চলছে। সব সময় ই–মেইলে কাজ আসতে থাকে, আমি দেখে দেখে ঠিক করি কবে কাজ করব, কীভাবে সময় বের করব।
লুসিল, উইলিসহ মিডল্যান্ডের এই স্যাটেলাইট হোমে আরও আছে ম্যারি, লরেন, গেইল, প্যাটি। তাদের সবার বয়স ৬৫ থেকে ৯৫-এর মধ্যে। সবাই জন্মগতভাবে প্রতিবন্ধী এবং এখন লং টার্ম ডিসঅ্যাবিলিটি প্রোগ্রামে আছে। কেউ কেউ এই হোমে আছে ২০ বছরের বেশি সময় ধরে। কেউ সুস্থ না। ৭০ বছর বয়সী ম্যারি হাঁটতে পারে; কিন্তু নিজেকে পরিষ্কার করতে পারে না, গোসল করতে পারে না, নিজের খাবারের আন্দাজ জানে না। উল্টো সে সুযোগ পেলেই রান্নাঘর থেকে খাবার চুরি করে। তাই এই হোমের সব স্টাফকে দুইটা চোখের জায়গায় ২০০ চোখ খোলা রাখতে হয়।
লরেন সবচেয়ে নিরীহ, বয়স ৬৮। দুই হাত বেঁকে গেছে। অন্য সবার মতো লরেনকেও অ্যাডাল্ট প্যাড পরাতে হয়। তিন ঘণ্টা পরপর চেক করতে হয় ওর প্যাড ভেজা কি না। অনেকক্ষণ কোনো ক্লায়েন্ট ভেজা থাকতে পারবে না; এটাকে কানাডার হেলথকেয়ার অ্যাবিউস বলে গণ্য করা হয়।
গেইলের হার্নিয়া আছে, ওর পেট ভীষণ উঁচু। মাত্র ৬৫ বছর বয়সেই সে সম্পূর্ণ জিহ্বা বের করে কথা বলে, তাই ওর কথা ভীষণ জড়ানো। বুঝে উঠতে সময় লাগে। গেইলও নাকি অঢেল সম্পদের মালিক। ওর নামেও নাকি ট্রাস্টি আছে মোটা অঙ্কের।
আজকে নিয়ে মাত্র পাঁচ দিন এই লোকেশনে শিফট করলাম। যেহেতু শুধু ছুটির দিনেই কাজ করতে পারব, তাই প্রতি ৭ বা ১৫ দিন পরে ওরা আমাকে দেখে এবং আবার ভুলে যায়। কিন্তু আমার করোটির ভেতরে জীবন্ত হয়ে খেলা করে প্রতিটা চরিত্র। খুব ভোরে যখন প্রতিদিন কষ্টি অফিসে হেঁটে যাই, তখন মনে হয়, সুস্থ আছি, হাঁটাচলা করছি, নিজের জীবন এখনো নিজের কাছে ভারী মনে হয় না। এই সুখের বাইরে আর কী চাইবার আছে?
সারা দিন কাজ সেরে ঘরে ফিরে যখন নিজেকে গোসল করাই, তখন প্যাটি আর লুসিলের কথা মনে পড়ে। অন্তরাত্মা কেঁপে ওঠে। ওরা তো ছয় বছর ধরে হুইলচেয়ার থেকে উঠতে পারে না। নিজেরা হাত দিয়ে খাবারও খেতে পারে না। এমনকি নিজের শরীরের অন্য কোনো জায়গাও নিজেরা ছুঁয়ে দেখতে পারে না। তবু তো জীবন বেঁচে আছে।
লং টার্মের হোমেও তো দিন আসে, রাত কাটে। সেখানেও তো জীবন হাসে, জীবন কাঁদে। জীবন তো এখানেও বহমান। এমনকি ৯৫ বছর বয়সী লুসিল, যার গা থেকে মাংস পচে পড়ে যাচ্ছে, তার কাছে জীবন এখনো বহমান।
করোটির কথামালার সব কোষ প্যাচ লেগে যাওয়ার আগেই লেখা বন্ধ করি। আগামীকালের একটা ভোরের জন্য অপেক্ষা করি।
১৭ ফেব্রুয়ারি ২০২০
টরন্টো, কানাডা