লালনের গানের সরস্বতী ফরিদা পারভীন

ফরিদা পারভীনছবি: প্রথম আলো

‘এই পদ্মা, এই মেঘনা, যমুনা-সুরমা নদী তটে...’। আবু জাফরের লেখা এবং সুরে ফরিদা পারভীনের কণ্ঠে হৃদয় আকুল করা এই গান ছোটবেলায় আমাদের পাথরঘাটার বাসায় মামাতো ভাইবোনেরা মিলে গাইতাম। জে এম সেন কিন্ডার গার্টেন স্কুলে সহপাঠীদের কণ্ঠে কিংবা ১৬ ডিসেম্বর বিজয় দিবসে পাড়ার অনুষ্ঠানে পড়শিদের মুখে বারবার শুনেছি। একটি গান এভাবেই তো গোটা একটা জাতির সুর হয়ে ওঠে, যখন স্রষ্টার হাত ধরে স্রষ্টা-শিল্পীর কণ্ঠে অমৃত সুধা রসে জারিত হয়ে প্রাণ থেকে প্রাণে ছড়িয়ে পড়ে। নদীমাতৃক বাংলাদেশের নদী আর মানুষের আবহমান কালের সম্পর্ককে দেশপ্রেমের ভালোবাসার মূর্ছনায় অমর করে দিয়ে গেছেন শিল্পী এবং স্রষ্টা।

নদীর প্রবহমান ধারার মতো লালনের গান বাঙালির হৃদয়ের সম্পদ। আর লালনের গানের সরস্বতীর নাম ফরিদা পারভীন। বাউল ফকিরেরা চিরকাল লালনের গান করে আসবেন, সেটাই শাশ্বত সত্য। কারণ, লালনের গান একধরনের সাধনা। লালনের মতোই গ্রামবাংলার বাউল ফকিরেরা সাধন পথের পথিক। জনজীবনে অতিসাধারণ মানুষেরাও লালনের গান করে আসবেন, সেটা বাঙালি জাতিসত্তার প্রতীক।

আরও পড়ুন

গান এবং প্রতিটি শিল্পই একধরনের সাধনা। চিরাচরিত প্রচলিত সংসারজীবনে থেকে সেই সাধনায় সিদ্ধি লাভ করা আরও বেশি কঠিন। শিল্প প্রত্যেক মানুষের জীবনেই কোনো না কোনোভাবে থাকে। কিন্তু অনবরত চর্চার সাধনা থাকে না বলে সবাই শিল্পী হতে পারেন না। বাংলাদেশের নিজস্ব ব্যক্তিগত সংসার এবং বৃহত্তর সমাজ-রাষ্ট্রজীবনে থেকেও ফরিদা পারভীন আপন তেজস্বিনী সত্তায় লালনকন্যা হয়ে উঠতে পেরেছিলেন। অথচ লালনের জন্মের বহুকাল পরে এই শিল্পীর জন্ম। সরাসরি লালনের কাছ থেকে দীক্ষা তিনি নিতে পারেননি। লালনের গানের শক্তি এমনই প্রজন্মের পর প্রজন্মকে উজ্জীবিত করে যেতে পারে।

এক আসরে লালনের গান গাইছেন ফরিদা পারভীন
ফাইল ছবি: প্রথম আলো

লালনের গান যাঁরা করেন তাঁরা যদি একেবারে মাটির কাছাকাছি না থাকেন, সেই সাধনা কখনো সফল হয় না। ফরিদা পারভীন সংসারে থেকে সন্ন্যাসী হয়ে চিরকাল এই মাটির কাছাকাছি থাকা জীবনে থেকেই সিদ্ধি লাভ করতে পেরেছেন। নারী হয়েও তাঁর কণ্ঠের মধ্যে ছিল পৌরুষিক শক্তি। লালনের কথা বলতে গেলে সুরের ভাঁজে কণ্ঠের শৈল্পিক জাদুর যতটা স্পষ্ট জোর দরকার, তা তাঁর কণ্ঠের মধ্যে ছিল। তিনি যে জনজীবনের বাউল। নারী মানেই শুধু কোমল চেতনা, শিউলি ফুল নয়। নারী মানেই শুধু কোকিলকণ্ঠী, গোলাপবালা নয়। কখনো কখনো নারী–পুরুষের সম্মিলিত চেতনার মতো অর্ধনারীশ্বর হয়ে তিনি বাড়ির পাশে আরশিনগরের পড়শিকে দেখার সাধনায় ব্যাকুল হয়ে উঠতে পেরেছেন। আমাদের সারা জীবনের ইচ্ছা থাকে সেই পড়শিকে দেখার। মানবতাবাদ ছাড়া, মানবিক দুঃখকষ্টের অনুভূতি ছাড়া সেই পড়শির কোনো ধর্মরূপ, জাতিরূপ, লিঙ্গরূপ থাকে না। সুরের স্রোতধারায় পড়শির কাছে ভেসে যেতে চাওয়ার সাধনার মধ্যেই জীবনের সুখ। মহাপ্রয়াণের পরে তিনি হয়তো সেই পড়শির বাড়িতে পৌঁছে যাবেন। তাঁর কণ্ঠের গানের ফুল ফুটে থাকবে আমাদের অন্তরে। কালের ফকির হয়ে প্রতিটি দিন তিনি আসবেন দুয়ারে দুয়ারে।

ছোটবেলায় আমাদের পাথরঘাটার বাসার চারকোনা চারটে পায়ার ওপর দাঁড়ানো কাঠের বাক্সের ভেতর সাদা–কালো টিভির মধ্যে দেখা সেই মানুষটি, তারের ভেতরে অ্যান্টেনায় ভর করে বাংলাদেশ টেলিভিশনের মাধ্যমে বারবার এসে গান শুনিয়ে যাওয়া সেই মানুষটি, চিরকাল লালনের গান করতে করতে আজ চির অনন্ত লালনালোকে হারিয়ে গেছেন। যত দিন বোধ আর চেতনা থাকে, স্মৃতি যেমন মনের মধ্যে জ্বলজ্বল করে, সেভাবেই তিনি বেঁচে থাকবেন। দিগন্তলোকে ভালো থাকবেন ফরিদা পারভীন।