হঠাৎ দেখা

ছবি: এআই/বন্ধুসভা

ইস্টিশনে বিকেলে এসে থামে ঢাকাগামী ট্রেন ‘এক্সপ্রেস ১২’। কারও সেদিকে বিশেষ ভ্রুক্ষেপ না থাকলেও একজন খুব মনোযোগ দিয়ে শুনছে সেই শব্দ। তাকিয়ে রয়েছে নিষ্পলক দৃষ্টিতে পুরোনো ধাঁচের রং উঠে যাওয়া ট্রেনটার দিকে। ট্রেনের ইঞ্জিনটায় যেমন জং ধরেছে, তেমনি ধুলো জমেছে স্মৃতিতেও। তবু বছর কুড়ি আগের কোনো এক তপ্ত দুপুরের স্মৃতি নবীনের কাছে আজও অমলিন। যেন বছর বছর পুরোনো কাঠের মতো পালিশ করে সেই স্মৃতিকে নতুন করাই তার কাজ। তাই আজও সে ভুলতে পারে না ১৭ এপ্রিলের কথা।

তখন ২০০২ সাল। ভার্সিটি থেকে স্নাতক পাস করা টগবগে তরুণ নবীন। ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের বাংলা বিভাগ থেকে সবে স্নাতক শেষ হয়েছে। বাংলা বিভাগে পড়লেও সাহিত্যের প্রতি তেমন টান কখনোই অনুভব করেনি। মায়ের একপ্রকার জোরাজুরিতেই বাংলা বিভাগে ভর্তি হয়েছিল নবীন। এরপর দেখতে দেখতে চলে যায় চারটি বছর। স্নাতক শেষ হয়ে যাওয়ায় এই মুহূর্তে হাতে তেমন কাজও নেই। এই সুযোগে ঢাকা থেকে গ্রামে বেড়াতে এসেছে সে।

গৌরীপুর রেলস্টেশন বাড়ি থেকে মিনিট পাঁচেকের রাস্তা। সেই সুবাদে রেলস্টেশনে নিত্য যাতায়াত। যদিও বাড়ি থেকেই ট্রেনের আওয়াজ শোনা যায়, তবু স্টেশনে বসে ট্রেনের আনাগোনা দেখতে ভালোই লাগে নবীনের।

এমনি একদিন স্টেশনে বসে চায়ের কাপে চুমুক দিয়ে ঘন ঘন নিশ্বাস ছাড়ছিল নবীন। কেনই বা ছাড়বে না, চৈত্রের দুপুরের তীব্র গরম বলে কথা। এই গরমেও চা খাওয়া থেমে নেই। মনে মনে সে হাসে আর ভাবে, তার মতো এমন চা–পাগল বোধ হয় আর দুটো নেই।

কিন্তু পরক্ষণেই পাশের বেঞ্চির দিকে তাকিয়ে কিছুটা স্তম্ভিত হয় নবীন। একি! ঠিক তার মতো বেশ আয়েশ করেই চা খাচ্ছেন আরেক ব্যক্তি। না, শুধু ব্যক্তি বললে ভুল হবে। বই হাতে গরম চায়ের কাপে যিনি ক্রমাগত চুমুক দিচ্ছেন, তিনি একুশ কিংবা বাইশ বছর বয়সী সুলোচনা স্নিগ্ধ এক রমণী। প্রথম দেখায় নবীনের চোখ আটকে যায়। তারপর সংবিৎ ফেরে নবনীতার ডাকে।
‘এই যে শুনছেন জনাব, এই যে? এবার তো চোখ ঝলসে যাবে।’
কিছুটা স্বাভাবিক হয়ে মৃদু হেসে শুধু ‘জি শুনছি’ বলে উঠে দাঁড়াতে যাবে, ঠিক তখনই নবনীতা বলে ওঠে, ‘তা এত অবাক হয়ে তাকিয়ে থাকার কারণটা কি জানতে পারি?’
নবীন কিছুটা ইতস্তত বোধ করে বলে, ‘আসলে আমি ভাবতাম, আমার মতো চা–পাগল বোধ হয় আর নেই। তাই প্রথমে আপনাকে দেখে থমকে গিয়েছিলাম। অবশ্য ঠিক চা নয় আসলে...আসলে!’ নবনীতা বলে ওঠে, ‘আসলে কী?’
নবীন পাশ কাটিয়ে বলে, ‘আসলে এই গরমে চায়ের সঙ্গে বইটা ঠিক মেনে নিতে পারছি না।’
কিছুটা বিরক্তি ভাব নিয়ে নবনীতা বলে, ‘কেন? আপনি বই পড়েন না বুঝি!’
‘ঠিক তা নয়, তবে কম পড়া হয় আরকি।’
‘নিন, এই বইটা পড়ে দেখবেন, ভালো লাগবে।’

আরও পড়ুন

এই বলে নবীনের দিকে জীবনানন্দ দাশকে নিয়ে লেখা ‘একজন কমলালেবু’ বইটি এগিয়ে দেয় নবনীতা। আর বলে, ‘পড়ে অবশ্যই পাঠপ্রতিক্রিয়া জানাবেন কিন্তু। কাছেই আমার বাড়ি। তবে ঠিক সাতদিন পর বইটা ফেরত দিতে হবে কিন্তু।’

অল্পক্ষণের আলাপে কেমন একটা বন্ধুত্বের সম্পর্ক তৈরি হয়ে যায়। বই নিয়ে অলিখিত এক চুক্তিও করে ফেলে তারা।
হঠাৎ আকাশের দিকে তাকিয়েই নবনীতা বলে ওঠে, ‘ইশ! বিকেল হয়ে এল প্রায়, এবার ফিরতে হবে। ওহ, আমার নাম নবনীতা। ভুলেই গিয়েছিলাম বলতে।’ বলেই দুজন হো হো করে হেসে ওঠে।

চোখের পলকে সাত দিন কেটে যায়। সাহিত্য ভালো না বাসা ছেলেটাও কীভাবে যেন হঠাৎ বইপ্রেমী হয়ে ওঠে। নবনীতার বইটা খুব তাড়াতাড়িই পড়ে শেষ করে ফেলে নবীন।
১৭ তারিখ বিকেলে খুব তড়িঘড়ি করেই নবীন চলে আসে স্টেশনে। কিন্তু এসে কিছুটা হতাশ হয়। নবনীতার সঙ্গে আলাপের ঘোরে ওর ফোন নম্বরটাই নেওয়া হয়নি। ঠিক কোথায় থাকে, সেটাও জিজ্ঞেস করতে ভুলে গিয়েছিল। এটা ভেবেই আফসোস করতে থাকে নবীন।

কিছুক্ষণ পর হঠাৎ দূর থেকে দেখতে পায়, বড় একটা ব্যাগ হাতে এগিয়ে আসছে নবনীতা। ওর চোখেমুখে চিন্তার ছাপ। নবীন বই সম্পর্কে কিছু বলতে যাবে, তখনই স্টেশনে চলে আসে ঢাকাগামী ট্রেন এক্সপ্রেস ১২। ট্রেনে উঠতে উঠতে বেশ তাড়াহুড়ায় নবনীতা শুধু বলে, ‘বইটা আপাতত আপনার কাছে রাখুন। আমাকে জরুরি ভিত্তিতে ঢাকায় যেতে হচ্ছে। রবিবারই চলে আসব। এসে নাহয় শুনব।’

ঝকঝক শব্দে স্টেশন ছাড়তেই নবনীতার চলে যাওয়া ট্রেনটার দিকে তাকিয়ে থেকেই নবীনের ভেতরটা কেমন যেন মোচড় দিয়ে ওঠে অজানা আশঙ্কায়। তবু খুব জোর করে কিছুটা হাসার চেষ্টা করে। আবার দেখা হবে তো!

না, আর দেখা হয় না। নবীন দিন গুনতে থাকে। দিন পেরিয়ে মাস, মাস পেরিয়ে কেটে যায় দীর্ঘ বিশটি বছর। নবীনের অপেক্ষা শেষ হয় না। সে আজও তাকিয়ে থাকে ঢাকাগামী ‘এক্সপ্রেস ১২’ ট্রেনের দিকে। সবার হাজার বারণ সত্ত্বেও কোনো কিছুর তোয়াক্কা না করে একটা ছোট্ট চায়ের স্টল নিয়ে বসে স্টেশনে। সবার একটাই কথা, শিক্ষিত ছেলে চাকরি না করে চা নিয়ে বসবে কেন? তবু সে চায়ের স্টল নিয়েই বসবে। অবশ্য স্টলটার নামও দিয়েছে নবনীতার নামে। সময়ের বহমানতায় নবীন খুব গভীরভাবে লক্ষ করেছে, নবনীতা তার খানিকটা দখল করে নিয়েছে। যে জায়গা সে চাইলেও খালি করতে পারবে না।

আজ বিকেলে হঠাৎ করেই ‘এক্সপ্রেস-১২’ ট্রেনটা স্টেশনে এসে থামতেই নবীনের ভেতরটা কেমন যেন করে ওঠে। একজন ভদ্রমহিলা ট্রেন থেকে নেমেই সোজা ‘নবনীতা চা স্টল’-এর দিকে এগিয়ে এসে জিজ্ঞেস করে, ‘আদা দিয়ে কড়া লিকারে এককাপ রং–চা হবে?’
গ্রীষ্মের তীব্র গরমে কোনো মেয়ে চা খেতে চাচ্ছে, এটা যেন অবাক করা বিষয়! কী ভেবে মুখ তুলে মধ্যবয়সী ভদ্রমহিলার দিকে তাকাতেই হতভম্ব হয়ে যায় নবীন।
এই তো সেই চোখ জোড়া, সেই চাহনি!

ঠিক কুড়ি বছর আগে যে চোখের দিকে তাকিয়েই আজকের মতো থমকে গিয়েছিল নবীন। কিছু একটা বলতে যাবে, তখনই ভদ্রমহিলা খানিকটা অবাক হয়েই বলে ওঠেন, ‘আমার নামে চায়ের স্টল!’
ভদ্রমহিলাকে আরও অবাক করে দিয়ে নবীন তার দিকে ‘একজন কমলালেবু’ বইটা এগিয়ে দিয়ে বলে, অনেকবার বইটা পড়ে শেষ করেছি।

তারপর আর কিছু বলতে পারে না কেউই। বাকরুদ্ধ হয়ে শুধু তাকিয়ে থাকে একে অপরের দিকে। এই তীব্র রোদেও নবীনের চোখ এড়ায় না বিপরীত পাশে দাঁড়িয়ে থাকা মানুষটির ছলছল চোখের করুণ চাহনি।
নবীনেরও কাঁদতে ভীষণ ইচ্ছে হয়।

হঠাৎ হাতঘড়িতে চোখ পড়তেই খানিকটা শিহরিত হয়ে নবীন অস্ফুটে বলে ওঠে, ‘নবনীতা, আজও ১৭ এপ্রিল।’

শিক্ষার্থী, ইডেন মহিলা কলেজ, ঢাকা