তোমারে কে ভালোবাসে (পর্ব এক)

অলংকরণ: তুলি

: পাগলের মতো ওর মেসেজের জন্য যে ছটফট করছিস, সে কি এমন করে তোর জন্য?

: জানি না।

: দীর্ঘ জীবনের অভিজ্ঞতা থেকে যদি বলি, বলব করে না। কারণ, আমরা যার প্রতি প্রবল আকর্ষণ বোধ করি, অধিকাংশ ক্ষেত্রে তার আগ্রহ কাজ করে না। ফলশ্রুতিতে সে অবহেলা করে। এটা হয়তো প্রকৃতির নিয়ম। প্রকৃতি প্রবল ভালোবাসা মিলিয়ে দিতে পছন্দ করে না। কেন, ‘শেষের কবিতা’য় দেখিসনি, অমিত-লাবণ্যর কেউ কাউকে কি পেয়েছে? পায়নি। আচ্ছা, বাদ দে। মেয়েটা কি কখনো তোর খোঁজ নেয়? তোকে মেসেজ করে?

: সেভাবে তো কখনো নেয়নি।

: বা রে হতভাগা, বাহ! তোর আর দোষ দিই কী করে, এমনটাই হয়। তবে ভুল করছিস। সাবধান হয়ে যা। সামনে তোর সোনার মতো চকচকে ভবিষ্যৎ। কোনোক্রমে যেন ব্যাহত না হয়। আর মায়া বাড়াস না ভাই, খবরদার, বলে দিলাম। আচ্ছা ভালো কথা, একটা কথা বল তো আমাকে, সে এনগেজড কি না, কাউকে ভালোবাসে কি না, খবর নিয়েছিস?

: না।

: বাহ রে হারামজাদা, বাহ!

: আসলে প্রয়োজন মনে করিনি। তার হাসি, ধীরে ধীরে চোখের পলক ফেলা, ঘুরে তাকানো, পেছনে হাত নিয়ে চুল খোলার ভঙ্গি থেকে হাঁটাচলা, কথা বলা, কফির কাপ হাতে কফি খাওয়া, দাঁতে বেঁধে থাকা মুরগির মাংসের বাড়তি অংশ ছাড়ানোর ভঙ্গি থেকে শুরু করে মাছের কাঁটা বেছে খাওয়া, হাত ধোঁয়া, সব ভালো লাগে। আর যার সব ভালো লাগে, তার প্রতি ভালো লাগা আটকাব কেমন করে। ভাবছ নিশ্চয়ই, অনেক কষ্ট হবে! জীবনে কখনো পরিবারের বাইরের কারও প্রতি এত প্রবল মায়া বোধ করিনি। জানো, ইদানীং মাঝরাতে হঠাৎ হঠাৎ ঘুম ভেঙে যায়। ফোনের গ্যালারি খুলে ওর ছবি দেখি। ঢক ঢক করে দুই গ্লাস জল খাই। কোনো কোনো দিন তো ঘুমের ঘোরে ওর নাম ধরে চিৎকার করি—আমার রুমমেট বলছিলেন। সারাক্ষণ ওর সঙ্গে আমার কথা বলতে ইচ্ছে করে। মেসেজ দিতে ইচ্ছে করে। সব সময় মেসেজ করার কথা সাজাতে থাকি। কখনো কখনো মেসেজ দিই। একদিন দুইদিন পর রিপ্লাই দেয়। আমার হৃদয় জুড়িয়ে যায়। এটুকুতেই আমার হবে, আমি এটুকুতেই খুশি। ভাবছ পরে কষ্ট পাব? তুমি জানো না দাদা, আমার হৃদয় এমনিতেই এতটা রঞ্জিত হয়ে আছে, সেখানে আর কোনো রক্তক্ষরণই ব্যথা দিতে পারবে না।

: বাব্বাহ, অনেক দূর তো গড়িয়েছে জল। তাহলে আর কি, বলে ফেল।

: কোনো দিন বলব না। ভালোবাসা তো টের পাওয়া যায়। কথায়, যত্নে গানের মতো যাপনের অববাহিকায়। কেন বলতে হবে? সে বুঝলে বুঝবে, না বুঝলে নেই। আমার ভালোবাসা মখমলের চাঁদরে জড়ানো চিঠির মতো হৃদয়ে জমানো থাকবে।

: ছাগল। যেদিন দেখবি এনগেজড উইথ থার্ড পারসনের নাম লিখে ছবি পোস্ট করেছে, সেদিন দেখিস হৃদয়ে রক্তক্ষরণ হয় কি না। যত্ত সব ছাগলের দল।

: আমিও বড় হব। আমার ওপর তোমার কি বিশ্বাস নেই! আমার মেধা, সততা, দৃঢ়তা, নৈতিকতা নিয়ে কি তোমার সংশয় আছে! নিয়তির বিচার কী হবে জানি না। কিন্তু নিজের প্রতি তো আমার শতভাগ বিশ্বাস আছে।

: কত দিনের পরিচয়? এত আবেগ, চোখ দুটো তো টলমল করছে, জল পড়বে এখনই। চোখ মোছ। এত মায়া জমল কী করে বল তো?

: কারও প্রতি মায়া তৈরি হওয়ার জন্য অগণিত মুহূর্তের তো প্রয়োজন নেই। একটিমাত্র মুহূর্তই যথেষ্ট।

: জার্মানির বিশ্ববিদ্যালয় থেকে না মেইলের রিপ্লাই আসছে। যাওয়ার বন্দোবস্ত করছিস তো ঠিকমতো?

: মা তো রাজি হচ্ছেন না। বাবারও আপত্তি আছে। ভাবছি, না করে দেব।

: মা-বাবা, না, নদী! আচ্ছা, তুই আমার সঙ্গে কোনো গল্প ফাঁদছিস না তো? নদীর কি বাস্তবে সত্যিই কোনো অস্তিত্ব আছে, ছবি দেখাতে পারবি? তা ছাড়া মেয়েটার নাম কি সত্যিই নদী?

: আসল নাম নদী না। আচ্ছা আগে বলো তো, তুমি কি কখনো নদীর বুকে খুব ভোরে সূর্যোদয়ের সময় জলের নাচন দেখেছ? দেখেছ, জল কেমন নাচতে নাচতে শান্ত হয়ে যায়। ও যখন কথা বলে, আস্তে আস্তে চারপাশের সব মায়াময় পরশে ভরে যায়। তাই ওর নাম রেখেছি নদী।

: বাছার আমার পছন্দ আছে, মানতে হবে। তবে তুই শেষ, তোকে আর বাঁচানো গেল না। তুই কোথাও গিয়ে ঘুরে আয়। মৃণ্ময়দের সঙ্গে না তোর সিলেট যাওয়ার কথা ছিল। গেলি না কেন? না যাওয়ার কারণও নিশ্চয়ই নদী।

: ওকে কেন দোষারোপ করছ, আশ্চর্য! নদীর কী দোষ! যদি ধরেও নিই আমার আগ্রহের বিষয়টা ও টের পেয়েছে, তাতেই-বা দোষ দিই কেমন করে। আমার যেমন ওকে ভালো লাগার, ভালোবাসার অধিকার আছে; একইভাবে ওরও আমাকে মনে না ধরলে, মন না চাইলে পছন্দ না করার, ভালো না বাসার অধিকার আছে। কেউ ভালোবাসে বোঝালেই তাকেও যে ভালোবাসতে হবে, এমন তো কোনো নিয়ম নেই।

: বাপ রে, বোধ তো অশীতিপর বৃদ্ধের মতো টনটনে। তবে মেয়েরা তো বেশির ভাগ ক্ষেত্রেই মুক্তা ফেলে দিয়ে  শামুক বুকে টেনে নেয়। তোর নদীও নিশ্চয়ই সে কাজটাই করবে?

চলবে…