উপন্যাসের কেন্দ্রীয় চরিত্র সুজাতা। তিনি একটি মরদেহের মা, দেহটি তাঁর ছেলে ব্রতীর, যিনি একজন বিপ্লবী ছিলেন। গল্পটি সুজাতার স্মৃতিচারণা ও আত্মমুখী চিন্তার মাধ্যমে এগিয়ে চলে। তিনি ব্রতীর শৈশব, তার আদর্শবাদ, এবং বিপ্লবী হয়ে ওঠার পেছনের কারণগুলো তুলে ধরেন। পাশাপাশি, এটি সমাজের প্রতি তার উপলব্ধি ও একজন মায়ের শোকের গল্প। বিপ্লবী ব্রতীর মৃত্যুকে কেন্দ্র করে যে কাহিনি আবর্তিত হয়েছে, সেখানে কেবল একটি পরিবারের শোকচিত্র নয়, গোটা সমাজব্যবস্থার অন্তর্লীন বৈষম্য ও ভণ্ডামি উন্মোচিত হয়েছে। বইটি পড়তে পড়তে পাঠক বুঝতে পারে, শোকের প্রকৃতি শ্রেণি বা সম্পদভেদে আলাদা হয় না। একজন উচ্চবিত্ত মা যেমন সন্তানের মৃত্যুতে ভেঙে পড়েন, তেমনি একজন দরিদ্র মা–ও একই যন্ত্রণা বহন করেন। শোক এখানে শ্রেণিচিহ্ন মুছে দিয়ে মানুষকে মানুষ হিসেবে এক সারিতে দাঁড় করায়।
মহাশ্বেতা দেবীর ‘হাজার চুরাশির মা’ উপন্যাসের মূল রাজনৈতিক পটভূমি ১৯৭০-এর দশকের নকশাল আন্দোলন, যা ভারতের পশ্চিমবঙ্গে সংঘটিত হয়েছিল। এই উপন্যাস শোষিত ও বঞ্চিত শ্রেণির মানুষের ক্ষোভ, হতাশা এবং তাদের অধিকার আদায়ের সংগ্রামকে তুলে ধরেছে। লেখক এই আন্দোলনের ফলে তৈরি হওয়া সামাজিক ও রাজনৈতিক পরিবর্তনের প্রভাব এবং মধ্যবিত্ত পরিবারের ওপর এর প্রতিক্রিয়া দেখিয়েছেন। নকশাল আন্দোলন একটি কমিউনিস্ট আন্দোলনের নাম। এটি বিংশ শতাব্দীর সত্তর দশকে পশ্চিমবঙ্গের নকশালবাড়ি থেকে শুরু হয়ে ধীরে ধীরে বিভিন্ন অঞ্চলে ছড়িয়ে পড়ে। ক্রমে একটি সন্ত্রাসবাদী আন্দোলনে রূপ নেয়। বিদ্রোহের শুরু হয় ১৯৬৭ সালের ২৫ মে। নকশালবাড়ি গ্রামের কৃষকদের ওপর ভূস্বামীরা ভাড়াটে গুন্ডা দিয়ে অত্যাচার করেছিল। এরপর কৃষকেরা ভূস্বামীদের উৎখাত করে। এ আন্দোলনের নেতৃত্বে ছিলেন চারু মজুমদার।
‘হাজার চুরাশির মা’ কেবল একজন বিপ্লবীর মায়ের শোকগাথা নয়; বরং পুরো সমাজের প্রতিবিম্ব। শোকের ভেতর দিয়ে শ্রেণিভেদ মুছে যায়, সময় সবকিছু গ্রাস করে আবার নতুন অঙ্কুর জন্ম দেয়, আর মানুষের জীবনযন্ত্রণা বিপ্লবের পথ তৈরি করে।
ভারতের নকশালবাড়ি আন্দোলন ও এর সঙ্গে জড়িত বিপ্লবীদের জীবন, সংগ্রাম ও মৃত্যু নিয়ে গড়ে ওঠা উপন্যাস। সমাজে সাম্য প্রতিষ্ঠার জন্য তরুণ বিপ্লবীদের আত্মত্যাগ এবং তাঁদের পরিবারের অন্তর্দাহ এখানে নিখুঁতভাবে ফুটে উঠেছে। এটি একাধারে সমাজের শোষণমূলক কাঠামোর তীব্র সমালোচনা এবং মানবিক সম্পর্কের করুণ চিত্রায়ণ। ১৯৭০-এর দশকে পশ্চিমবঙ্গের নকশাল আন্দোলনের উত্তাল সময়। শোষিত শ্রেণির অধিকার আদায়ের এই সংগ্রাম শুধুই একটি রাজনৈতিক বিদ্রোহ নয়, বরং একটি প্রজন্মের হতাশা ও ক্ষোভের বহিঃপ্রকাশ। একই সময়ে বাংলাদেশের মুক্তিযুদ্ধের ফলে চাপা পড়ে যায় নকশালবাড়ি আন্দোলনের পাশবিকতা।
পশ্চিমবঙ্গের লেখকেরা বাংলাদেশ বাংলাদেশ বলে কলম ধরে, পশ্চিমবঙ্গের যুবকদের জীবন তাঁদের কাছে মূল্যহীন হয়তো (কথাটি আফসোস করে বলেন মূল চরিত্র সুজাতা)।
উপন্যাসে সময়কে অত্যন্ত নির্মম অথচ পুর্নবীকরণের প্রতীক হিসেবে উপস্থাপন করা হয়েছে। লেখকের ভাষায় সময় শোকের চেয়ে বলশালী, শোক তীরভূমি আর সময় জাহ্নবী। সময় শোককে ঢেকে দেয়, তার ওপর স্তরে স্তরে পলি জমতে থাকে। একসময় সেই চাপা শোকের ভেতর থেকেও জন্ম নেয় নতুন অঙ্কুর, যার আঙুল আবার আকাশপানে ওঠার চেষ্টা করে। সময় এখানে ধ্বংসের পাশাপাশি পুনর্গঠনেরও প্রতীক, যে সময় শোককে গিলে খায় আবার আশার নতুন বীজ রোপণ করে।
সুজাতা ও সমুর মাকে কেন্দ্র করে লেখক তুলনা টেনেছেন দুই শ্রেণির নারীর মধ্যে। সুজাতার সামাজিক মর্যাদা, দামি পোশাক, অভিজাত গরিমা—সবকিছুর আড়ালে রয়েছে এক অজানা অন্ধকার। তিনি জানতেন না, ব্রতী কী করছিল, কী উদ্দেশ্যে নিজের জীবন বিসর্জন দিয়েছিল। অথচ সমুর মা, যাঁকে সমাজ অশিক্ষিত ও অবুঝ হিসেবে দেখে, তিনি জানতেন সন্তানের সংগ্রামের তাৎপর্য। তাই তিনি প্রকৃত অর্থেই বিজয়িনী। এই বিন্যাসে বোঝা যায়, সামাজিক উচ্চতা সব সময় সচেতনতার প্রতীক নয়, বরং সাধারণ মা-ই সন্তানের প্রকৃত অবস্থান অনুধাবন করেন। লেখক এখানে বোঝাতে চেয়েছেন, সুজাতা কোনো কিছুর কাছে নিজের আনুগত্য বা ভালোবাসা সমর্পণ করেননি। তিনি মুগ্ধ হননি পথচারীর হঠাৎ হাসিতে, ভেসে আসা গানের টুকরোয় কিংবা লাল গোলাপে। তাঁর হৃদয় আলোড়িত হয়নি উজ্জ্বল আলোর ঝলক বা ঝুলন্ত ফেস্টুনের রঙিন কাপড়ে।
ব্রতীর বিপ্লবী হয়ে ওঠা কোনো আকস্মিক ঘটনা নয়। ব্রতী যখন বদলে যেতে শুরু করে; সে কিছু কিছু বই পড়ে বা বুলি শুনেই বদলে যায়নি। সমুর মতো দরিদ্র বাবা-মায়ের সন্তান, লালটুকের মতো ভাগ্যপ্রহৃত অপমানিত যুবক এবং অন্য মানুষদের জীবনের জ্বালা নিজের রক্তমাংসের অনুভব করেই ব্রতী বদলেছিল। জীবনই তাকে বদলে যেতে বাধ্য করে। সে নিজের জীবন ত্যাগ করেছে, যদিও সে চাইলে সহজেই বিলেতে পড়াশোনা করে ফিরে এসে উচ্চপদে চাকরি করতে পারত, সমাজের অভিজাত স্তরে জায়গা করে নিতে পারত। তবু সে বেছে নিয়েছিল সংগ্রামের পথ। এটাই এই উপন্যাসের প্রাণ—মানুষকে তার বাস্তবতা বিপ্লবী করে তোলে, কেবল তত্ত্ব নয়।
উপন্যাসে সমাজকে দেখানো হয়েছে বহুমুখী ভণ্ডামিতে পূর্ণ। সুজাতা বলেন, যে সমাজে নগ্ন শরীর লজ্জার নয়, বরং সহজ আবেগই লজ্জার, সেই সমাজে মানবিকতা হারিয়ে যায়। সম্পর্কগুলো ভেতরে–ভেতরে বিষিয়ে গেলেও সবাই মধুর মুখোশ পরে থাকে। অন্যদিকে একই সমাজ ক্ষুধার্তদের অন্ন কেড়ে নিয়ে ক্ষমতাবানদের ভোগবিলাস নিশ্চিত করে।
‘হাজার চুরাশির মা’ কেবল একজন বিপ্লবীর মায়ের শোকগাথা নয়; বরং পুরো সমাজের প্রতিবিম্ব। শোকের ভেতর দিয়ে শ্রেণিভেদ মুছে যায়, সময় সবকিছু গ্রাস করে আবার নতুন অঙ্কুর জন্ম দেয়, আর মানুষের জীবনযন্ত্রণা বিপ্লবের পথ তৈরি করে। এই বই পড়ার পর পাঠককে ভাবতে হয়, যে সমাজ জীবিতদের অধিকার কেড়ে নেয়, মৃতদের অধিকারকেই বড় করে তুলে ধরে, সেই সমাজ কি পরিবর্তনের মুখোমুখি না হয়ে পারে?
আরও কয়েকটি উক্তি পাঠককে দীর্ঘ সময় ভাবিয়ে রাখে
• অল্প বয়সে স্বভাবে যে যে অনুশাসন ঢুকিয়ে দেওয়া হয়, আর সেগুলো অতিক্রম করা যায় না।
• সলিটারি সেলে থাকলে মানুষের মন ক্ষিপ্ত হয়ে যায়। লাশঘরের ডাক্তারের ছুরির মতো।
• এখন বোধহয় আমাদের মতো মেয়েকে বিয়ে করা ধীমান রায়ের কবিতা লেখার মতো আরেকটা ফ্যাশন।
• যে সমাজকে ব্রতীরা নিশ্চিহ্ন করতে চেয়েছিল, সেই সমাজ বহুজনের ক্ষুধিত অন্ন কেড়ে নিয়ে এদের সযত্নে রাজভোগে লালন করে, বড় করে। সে সমাজে জীবনের অধিকার মৃতদের, জীবিতদের নয়।
এই উপন্যাস একদিকে গভীর বেদনার, অন্যদিকে সংগ্রামের দৃঢ় অনুপ্রেরণা। পড়ার পর এটি পাঠকের মনে দীর্ঘস্থায়ী ছাপ ফেলে যায়, যার ভার থেকে সহজে বেরিয়ে আসা যায় না।
শিক্ষার্থী, ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়