‘নতুন মানুষ। নতুন পরিচয়। মা ভৈঃ। ভয়ের কিছু নেই। আমাদের হাতে এখন রাইফেল। পেটে ভাত। আর পাশে নারী। রাইফেল, রোটি, আওরাত। মা ভৈঃ। ভয়ের কিছু নেই।’
১৯৭১ সাল। বাংলার আকাশ তখন বারুদের ধোঁয়ায় আচ্ছন্ন, বাতাসে লাশের গন্ধ, আর প্রতিটি নিশ্বাসে মৃত্যুর হিমশীতল স্পর্শ। ঠিক সেই চরম অনিশ্চয়তার মুহূর্তে, যখন জীবন আর মৃত্যুর ব্যবধান কেবল একটি বুলেটের শব্দ, তখন এক অকুতোভয় কলমযোদ্ধা রচনা করেছিলেন আমাদের ইতিহাসের এক দগদগে দলিল। আনোয়ার পাশার ‘রাইফেল, রোটি, আওরাত’, কেবল কোনো উপন্যাস নয়; এটি একাত্তরের রণাঙ্গন থেকে ভেসে আসা তাজা রক্তের ঘ্রাণমাখা এক জীবন্ত মহাকাব্য।
উপন্যাসটির গভীরে ডুব দেওয়ার আগে এর স্রষ্টা এবং সৃষ্টির প্রেক্ষাপট জানাটা জরুরি। নতুবা এই লেখার ওজন অনুভব করা অসম্ভব। আনোয়ার পাশা, ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের বাংলা বিভাগের এক ধীমান ও শান্ত শিক্ষক, যিনি একাত্তরের সেই ভয়াল কালরাত্রিতে নিজের চোখে দেখেছিলেন পাকিস্তানি হায়েনাদের পৈশাচিকতা। বাংলা সাহিত্যের ইতিহাসে এই উপন্যাসটির স্থান একেবারে শীর্ষে। কারণ, এটিই মুক্তিযুদ্ধের পটভূমিতে রচিত প্রথম উপন্যাস।
সবচেয়ে রোমহর্ষক ব্যাপার হলো, এই উপন্যাসটি কোনো নিরাপদ আশ্রয়ে বসে, যুদ্ধজয়ের পর স্মৃতিচারণা করে লেখা হয়নি। আনোয়ার পাশা এটি লিখেছিলেন ১৯৭১ সালের মে থেকে জুন মাসের মধ্যে, যখন তিনি অবরুদ্ধ ঢাকায় মৃত্যুর সঙ্গে লড়ছেন। প্রতিটি শব্দ তিনি গেঁথেছিলেন বুকের ভেতর চেপে রাখা কান্না আর ক্রোধ দিয়ে। ভাগ্যের কী নির্মম পরিহাস, যে স্বাধীনতার স্বপ্ন তিনি এই উপন্যাসের পাতায় বুনেছিলেন, সেই স্বাধীন দেশের মাটিতে পা রাখার সৌভাগ্য তাঁর হয়নি। ১৪ ডিসেম্বর, বিজয়ের মাত্র দুই দিন আগে, আলবদর বাহিনী তাঁকে বাসা থেকে তুলে নিয়ে গিয়ে নির্মমভাবে হত্যা করে। অসংখ্য বুদ্ধিজীবীর সঙ্গে তাঁকে মিরপুর বুদ্ধিজীবী স্মৃতিসৌধের নিকট নির্মমভাবে হত্যা করা হয়। কিন্তু শিল্পীকে হত্যা করা গেলেও তাঁর শিল্পকে হত্যা করা যায় না। শিল্পী বেঁচে থাকেন তাঁর শিল্পে। যুদ্ধপরবর্তী বাংলাদেশ সরকার শিল্পীকে তাই ভুলে যায়নি। ‘রাইফেল, রোটি, আওরাত’ উপন্যাসের জন্যই স্বাধীনতার পর তাঁকে ভূষিত করা হয় স্বাধীনতা পুরস্কারে (মরণোত্তর)।
উপন্যাসের মূল চরিত্রের নাম সুদীপ্ত শাহীন। ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের ইংরেজি বিভাগের অধ্যাপক। বউ আমিনাসহ তিন সন্তান নিয়ে থাকতেন বিশ্ববিদ্যালয়ের টিচার্স কোয়ার্টারের ২৩ নম্বর ভবনে। ২৫ মার্চ হানাদার বাহিনীর আক্রমণে ২৩ নম্বর ভবনের সবাই মারা গেলেও বেঁচে যান তিনি এবং তাঁর পরিবার। চারপাশে লাশের সারি। ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের প্রখ্যাত অধ্যাপকেরা নিহত হয়েছেন সপরিবার। রাতের আঁধারে ইয়াহিয়া খানের লেলিয়ে দেওয়া পশুরা মেরে ফেলেছে তাঁরই সহকর্মীদের। গণহত্যা করেছে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের ছাত্রছাত্রীদের। রেহাই পায়নি শহরের সাধারণ জনগণ। শিক্ষক হিসেবে নিজের সন্তানতুল্য ছাত্রদের রক্ষা করতে না পারার আক্ষেপ, সহকর্মীদের মধ্যে ব্যতিক্রমী হয়ে নিজে জীবিত থাকার যে অপরাধবোধ, এসবই কুরে কুরে খাচ্ছিল সুদীপ্তকে। লেখক যেন সুদীপ্ত শাহিনের মাঝেই সে সময়ের হতাশা এবং আক্ষেপ প্রকাশ করেছেন।
সুদীপ্তর বন্ধু ফিরোজ। ছাত্রাবস্থায় পড়াশোনা এবং কাব্যচর্চা করে সময় পার করলেও পরে যোগ দিয়েছেন রাজনীতিতে। বুঝেছেন বাঙালির মুক্তির জন্য শুধু পড়াশোনা করে লাভ নেই। করতে হবে প্রতিবাদ। সরব রাজনীতিতে অংশ নিয়ে যেতে হবে ক্ষমতায়। তবেই না দীর্ঘ তেইশ বছরের যে বৈষম্য, বাঙালির যে দৈন্য, তা ঘুচবে। কিন্তু ইয়াহিয়া আর তা হতে দিল কই? সাধারণ নির্বাচন দেবে না তো দেবেই না। আর যখন দিল, তখন বাংলার জনগণ ভোট দিয়ে দিল আওয়ামী লীগকে। বাঙালিকে কি ক্ষমতা দেওয়া যায় নাকি? তারা হলো প্রজার জাতি, শোষিত হবার জন্যই তাদের জন্ম। তাই তো ইয়াহিয়া বন্ধ করে দিল সাধারণ অধিবেশন। এরপর আলোচনার নাম করে আসল দেশে। হুট করে মাঝরাতে পালিয়ে চলে গেল পাকিস্তানে আর লেলিয়ে দিয়ে গেল তার পোষা সেনাবাহিনীকে। এই সেনাবাহিনী বোঝে শুধু তিনটি জিনিস। রাইফেল, রোটি আর আওরাত! সারা দিন রাইফেল নিয়ে মানুষ মারো। মানুষ? সে হতে পারে শিশু, যুবক, বৃদ্ধ-বৃদ্ধা। কেবল যুবতী অর্থাৎ আওরাত পেলেই তাকে ধরে নিয়ে যায়। ক্ষুধা লাগলেই রোটি পেটে চালান করে। আর রাতভর আওরাত নিয়ে ফুর্তি! ‘রাইফেল, রোটি, আওরাত’ উপন্যাসের এই নামকরণ মূলত পাকিস্তানি হানাদার বাহিনীর এই স্থূল মানসিকতাকে নির্দেশ করতেই করা হয়েছে।
উপন্যাসের অন্যতম গুরুত্বপূর্ণ কাল্পনিক চরিত্র শিল্পী আমন। ২৫ মার্চ রাতে যিনি হারিয়েছেন তাঁর সন্তানকে। আর স্ত্রীকে তারা ধরে নিয়ে গেছে তাদের নির্মিত যৌনপল্লিতে। এই দুঃখ সইতে না পেরে উন্মাদ হয়ে যান তিনি। সুদীপ্তর সঙ্গে তাঁর দেখা হয় নীলক্ষেত মোড়ে। মিলিটারি দেখে চিৎকার করে বলছিলেন, ‘হাম গোলি করেগা, গোলি খায়েগা।’ মিলিটারি আর বসেই থাকবে কেন? ছুড়ল গুলি। তাতে সুদীপ্তের প্রাণও যেত। কিন্তু ধাক্কা দিয়ে সরিয়ে দিলেন শিল্পী আমন নিজেই। হয়তো তাঁর নিজ পুত্র-কন্যাকে বাঁচাতে না পারার আক্ষেপের কিছুটা হলেও মিটিয়ে নিলেন মনে মনে। বিনিময়ে গুলি খেয়ে লুটিয়ে পড়লেন রক্তাক্ত দেহ নিয়ে। শিল্পী আমনের মতো চরিত্রের দেখা আমরা পাই মুনীর চৌধুরী রচিত ‘কবর’ নাটকের মুর্দা ফকিরের মাঝে কিংবা আখতারুজ্জামান ইলিয়াস রচিত ‘চিলেকোঠার সেপাই’-এর আনোয়ারের মাঝে।
‘রাইফেল, রোটি, আওরাত’-এ আরও একশ্রেণির কুম্ভকর্ণের দিকে দৃষ্টিপাত করা হয়েছে। আপামর বাঙলার চিরাচরিত ‘মীর জাফর’ শ্রেণি। যারা বর্ণে বাঙালি, কিন্তু বর্ণচোরা। গিরগিটির মতো রং পাল্টানো যাদের স্বভাব। ভুট্টো সাহেব ক্ষমতায় আছেন? তাহলে পাকিস্তান জিন্দাবাদ! বাংলা ভাষা হলো মালাউনদের ভাষা, প্রচণ্ড হিন্দুয়ানি। আবার ভুট্টো সাহেব রসাতলে গেল, নির্বাচনে আওয়ামী লীগের হলো বিজয়। তখনই আর রবীন্দ্রনাথটা না পড়লে আর হচ্ছে না। এমনই চরিত্র ড. খালেক। ফিরোজ রাজনীতি করে, তাই সে বোঝে এরাই বাংলার সবচেয়ে বড় শত্রু। এরাই বাংলাদেশকে অধঃপাতে নিয়ে যাচ্ছে। একই রকম আরেকজন চরিত্র হচ্ছে ফিরোজের দুঃসম্পর্কের চাচা গাজী সাহেব। ভুট্টোর আমলে করেছেন জামায়াতে ইসলামী। পরে তার পতন হলে ঘেঁষতে চেয়েছেন আওয়ামী লীগের দিকে। ২৫ মার্চের পরে আবার পুরোনো গোঁফেই তা দেওয়া। ভাগ্যক্রমে ফিরোজ তার নিজ পরিবার, সুদীপ্ত শাহিনের পরিবার নিয়ে আশ্রয় নিতে যায় গাজী সাহেবের বাসায়। সেখানেই ছিল রাজারবাগ পুলিশ লাইনে পাকিস্তানি আর্মির বিরুদ্ধে বিদ্রোহ করা কিছু পুলিশ। তিনি তাদের ভুলিয়ে ভালিয়ে রেখে দিয়েছিলেন এত দিন। ফিরোজদের সামনেই কজন পাকিস্তানি আর্মি ডেকে এনে আলবাত ধরিয়ে দিয়ে তৃপ্তির ঢেকুর তুললেন! পরে জানা গেল, তার কাছে নির্দেশ এসেছে ফিরোজকেও হাত করার। সে আওয়ামী লীগের বড় নেতা। সে যদি দেশবাসীর উদ্দেশে পাকিস্তানের এহেন কৃতকর্মের সাফাই গেয়ে কিছু বলে, তাহলে দেশবাসী কিছুটা আশ্বস্ত হবে। এবং বহির্বিশ্বের নাক গলানো একটু কমবে। ফিরোজের আদর্শ তো আর এত সস্তা নয় যে চাইলেই কিনে নেওয়া যায়। তীব্র ঘৃণা আর প্রতিশোধ নেওয়ার তীব্র আগুন বুকে নিয়ে ফিরোজ সবাইকে নিয়ে ফিরে চললেন।
সাহিত্যের বিচারে ‘রাইফেল, রোটি, আওরাত’ বাংলা সাহিত্যের ইতিহাসে এক অনন্য মাপকাঠি স্থাপন করেছে, যাকে ছুঁতে পেরেছে খুব কম সাহিত্য। ভবিষ্যতের স্বপ্নদ্রষ্টা হিসেবে আনোয়ার পাশার সাহসের জুড়ি মেলা ভার। মার্চ-এপ্রিল মাসের পাকিস্তানি মিলিটারির তীব্র প্রতাপের মুখে থেকেও তিনি স্বপ্ন দেখেছেন, বাংলার দামাল ছেলেরা যুদ্ধ করবে। যুদ্ধ করে দেশের স্বাধীনতা ছিনিয়ে আনবে। সাহিত্য? সে পরে অনেক করা যাবে। এখন করতে হবে যুদ্ধ। যারা যুদ্ধের ভাষা ছাড়া আর কিছুই বোঝে না, তাদের সঙ্গে জিততে হলে যুদ্ধই করতে হবে। বাঙালি আজ মরতে শিখেছে। ‘রাইফেল, রোটি, আওরাত’ আমাদের স্বোপার্জিত স্বাধীনতার পেছনের গল্পের অকাট্য দলিল, যেখানে সুদীপ্ত শাহিন অপ্রতিরোধ্য অবিনাশী বাঙালির আশা–আকাঙ্ক্ষার সংকল্প প্রত্যয়।
শিক্ষার্থী, আন্তর্জাতিক সম্পর্ক বিভাগ, ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়