ইদানীং মামির রূঢ় আচরণ, ইতস্তত ভাব এবং কারণে-অকারণে মামার সঙ্গে ঝগড়া হওয়া দেখে অন্তর বেশ চিন্তিত হয়ে পড়ল। এসবের কারণ সে, ভালোভাবেই বুঝতে পারে। কিন্তু যাওয়ার জায়গা কোথায়? তবু একদিন মামাকে ডেকে বলল, ‘আমি আগামী মাস থেকে একটা মেসে থাকব বলে ঠিক করেছি।’
মামা নিজের ব্যর্থতা ঢাকার চেষ্টায় অনিচ্ছা সত্ত্বেও বললেন, ‘কেন রে? এখানে থাকতে কী অসুবিধা?’
‘অসুবিধা নেই। তবে তোমাকে আমার খুব প্রয়োজন। আতিক সাহেবের সঙ্গে একটু দেখা করতে হবে। কাজটা হয়ে গেলে আমাকে কষ্ট করে মেসে থাকতে হবে না।’
মামা প্রসন্ন হাসি হেসে বললেন, ‘তোর ভালো হলে অবশ্যই দেখা করব।’
ভৈরবের একটা কলেজে এবার অনার্স প্রথম বর্ষে পড়ছে অন্তর। ব্যবস্থাপনা বিভাগের শিক্ষার্থী। পড়ালেখায় যেমন মেধাবী, তেমনি কর্মঠ। খুব কষ্টে পড়ালেখা চালাতে হচ্ছে। দুটো টিউশন আছে। নিজের খরচ জোগাতে এ–ই একমাত্র ভরসা। বাবা গ্রামের সাধারণ গোমস্তা। ভবঘুরে হয়ে থাকাটাই যেন তার পরমাকাঙ্ক্ষা। আয় অল্প হলেও প্রায়ই নেশাগ্রস্ত হয়ে বাড়ি ফেরে। অসুস্থ মা। শরীরে পানি এসে গেছে। অভাবগ্রস্ত সংসার তাদের। ছোট বোনটা বড় হচ্ছে। এবার ষষ্ঠ শ্রেণিতে পড়ছে। ওরও তো একটা ভবিষ্যৎ আছে। সেটাও ভাবতে হয় অন্তরকে।
চিরকুটটাকে ছিঁড়ে ফেলতে ইচ্ছা হচ্ছিল। অন্তর তা করতে পারল না। ময়লার ঝুড়িতে রেখে দিল। মাঝেমধ্যেই এ রকম দু-একটা চিরকুট পেতে থাকল।
ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে পড়াশোনা করার খুব শখ ছিল। নানা কারণে তা আর হয়ে ওঠেনি। মামা ওকে ভৈরবে এনে একটা ব্যবস্থা করে দিয়েছিলেন। থাকতেও দিয়েছেন নিজ বাসাতেই। মামা যেহেতু ভৈরবেই থাকেন, তাই কিছুটা ভরসা পেয়ে অন্তর এখানেই ভর্তি হয়েছিল। কিন্তু ইদানীং মামির আপত্তি লক্ষ করে অন্যত্র চলে যাবে বলে স্থির করেছে সে।
পরদিন মামা অন্তরকে সঙ্গে নিয়ে আতিক সাহেবের বাসায় গেলেন। তাঁর একজন গৃহশিক্ষক দরকার। ছোট ছেলে আছে একটি। নাম রাফি। সে এবার তৃতীয় শ্রেণিতে পড়ছে। ওর পড়াশোনার খেয়াল রাখতে হবে। বিনিময়ে দোতলার চিলেকোঠায় থাকতে দেবে আর ভালোমন্দ খেতে দেবে।
আতিক সাহেব মামার পূর্বপরিচিত হওয়ায় এবং অন্তরের সৎগুণের কথা জেনে এমন শিক্ষক হাতছাড়া করতে রাজি হলেন না। সে–ও কিছুটা স্বস্তি পেল। থাকা-খাওয়ার চিন্তা করতে হবে না।
১ তারিখে মামা নিজে একটা ভ্যান ডেকে অন্তরের জিনিসপত্র পাঠানোর ব্যবস্থা করলেন। নিজেও সঙ্গে গেলেন। একমাত্র ভাগনেকে চাইলেও নিজের কাছে রাখতে না পারার দরুন সবার অগোচরে কেঁদে ফেললেন। সেদিন চিলেকোঠার বারান্দায় দাঁড়িয়ে অন্তর ভাবছিল, এবার হাতে কিছু টাকা হলেই মায়ের কাছে পাঠাতে হবে।
পূর্ণিমা কিংবা ঘোর অমানিশায় ছাদে একাই সময় কাটানোর মতো দূরদৃষ্ট মেনে নিতে আজ কোনো আপত্তি অবশিষ্ট নেই। কলেজ, টিউশন এবং সন্ধ্যার পর সম্পূর্ণ একাকী বাস; এই নিঃসঙ্গ জীবন অন্তরের কাছে ক্রমে বিষাদে পরিণত হতে হতে একসময় পূর্ণ অভ্যস্ততায় পরিণত হলো। পাঠ্যবইয়ের পাশাপাশি প্রতি মাসেই খরচের একটা অংশ দিয়ে বেশ কিছু গল্প-উপন্যাসের পুরোনো বই কিনে পড়তে লাগল সে। প্রতি ইয়ারে নিজের ভালো রেজাল্টের পাশাপাশি ওর ছাত্রদের পড়ালেখায়ও বেশ উন্নতি হয়েছে। তৃতীয় ও চতুর্থ শ্রেণির পরীক্ষার ফল বেশ ভালো করেছিল দেখে রাফির মা-বাবা অন্তরের প্রতি মনে মনে বেশ সন্তুষ্ট।
জীবনের সব আনন্দ একদিকে ফেলে নিজের লক্ষ্যে যেতে যেতে একদিন পায়ের কাছে হলুদ রঙের একটুকরো কাগজ কোথা থেকে উড়ে এসে পড়ল। হাতে নিয়ে দেখল সেখানে লেখা রয়েছে, ‘অন্তরেরই মানুষ তুমি অন্তরেই থাকো।’
অন্তর মন্ত্রমুগ্ধের মতো লেখাটার দিকে চেয়ে রইল। এটা যে আদ্রিতার লেখা, সেটা সহজেই আঁচ করতে পারল সে। রাফির বড় বোন আদ্রিতা। ইন্টার সেকেন্ড ইয়ারে পড়ে। সংসারের বড় মেয়ে নাকি লাজুক প্রকৃতির হয়, কিন্তু ও সম্পূর্ণ উল্টো। চঞ্চলতাই ওর বিশেষ বৈশিষ্ট্য।
রাফি দিনে দুইবার পড়তে আসে। সকাল সাতটায় ও বিকেল সাড়ে চারটায়। বিকেলে পড়া শেষ হতে হতে সন্ধ্যা ছয়টা বেজে যায়। রাফিকে নিয়ে যাওয়ার ছলে আদ্রিতা রোজ দু-একবেলা দেখা করতে আসে। অবশ্য কথা হয় কম। কিন্তু চোখ দিয়ে নানা কথা বলে যায়। যার অর্থ অন্তর বুঝে। তবু সে অবুঝের ভান করে থাকে। এভাবেই দিন চলে যাচ্ছিল। কিন্তু স্মার্টফোনের যুগে এভাবে চিরকুট পেলে কে স্থির থাকতে পারে?
চিরকুটটাকে ছিঁড়ে ফেলতে ইচ্ছা হচ্ছিল। অন্তর তা করতে পারল না। ময়লার ঝুড়িতে রেখে দিল। মাঝেমধ্যেই এ রকম দু-একটা চিরকুট পেতে থাকল। একদিন লিখল, ‘আমি আপনার প্রতি ভীষণ রাগ করেছি। আপনি আমার সঙ্গে ভালোভাবে কথা বলেন না কেন? কথা বলতে কী এত সমস্যা?’
অন্তর মুচকি হেসে চিরকুটটা ঝুড়িতে রাখল। সে জানে, ওর এক পা ফেলতে একাধিকবার ভাবতে হয়। নিজেকে আড়ালে–আবডালে রাখার যত চেষ্টা। কখনো কখনো অদৃশ্য হয়েও থাকতে হয়। সব খেয়াল আসন্ন ভবিষ্যতের দিকে। অন্য কোনো দিকে তাকানোর একবিন্দু অবসর নেই।
বিকেল গড়িয়ে এল। অন্তর ছাদের এক কোণে দাঁড়িয়ে। এ সময় পকেটে রাখা ফোনটা হঠাৎ বেজে ওঠে। মায়ের ফোন। কল কেটে দিয়ে সে কলব্যাক করল। মায়ের কান্না ভেসে এল কানে, ‘তোর বাবা আজকে টাকা চাইছিল। টাকা না পাইয়া মোমেনার কানের দুলগুলান নিয়া গেছে। আমি আর কী করতাম? তুই বাড়িতে আয় বাবা।’
অন্তর আহত গলায় বলল, ‘কিছুদিন পরই আমার পরীক্ষা শুরু হবে। এখন কী করে আসব?’
‘আমার এত দুঃখ ছিল রে বাবা!’ বলেই মা ফুঁপিয়ে কাঁদতে লাগলেন।
অন্তর কী করবে, তা ভেবে পেল না। নিজেকে অনেক বেশি অসহায় লাগছে। ফোন কেটে দিয়ে দৃষ্টিসীমা ছাড়িয়ে নানা রঙের দালানগুলোকে দেখছিল। কখন যে চোখ ভিজে আসে, বুঝতেই পারল না। পাশে দাঁড়িয়ে কে যেন জিজ্ঞেস করল, ‘মন খারাপ?’
অন্তর ঘাড় ঘুরিয়ে দেখল, আদ্রিতা রেলিং ধরে দাঁড়িয়ে আছে অন্যদিকে মুখ করে।
ওর এ সময় এখানে আসার কথা নয়। সন্ধ্যার পর ছাদে আসা নিষেধ। অস্থির হয়ে অন্তর বলল, ‘আপনি এখন ছাদে এসেছেন কেন? নিচে চলে যান প্লিজ।’
আদ্রিতা তর্জনী উঁচু করে বলল, ‘আমার ছাদে আমি এলে আপনার কী তাতে?’
‘সন্ধ্যার পর এখানে আসা বারণ আছে। প্লিজ, আপনি চলে যান।’
‘আবারও আমাকে আপনি করে বলছেন? কতবার না বলেছি বয়সে আমি আপনার ছোট, সে কথা কানেই নিচ্ছেন না যে?’
‘কানে নিয়েছি অনেক আগেই। সে কথা বলে কীই-বা হবে?’
আদ্রিতা এবার আরেকটু কাছে এসে বলল, ‘বাবা আপনাকে বাসা থেকে তাড়িয়ে দেবে, এই ভয়ে?’
অন্তর ছিটকে সরে এল। তারপর থেমে থেমে বলল, ‘বিচ্ছিরি ব্যাপার হয়ে যাবে। আপনি চলে যান প্লিজ।’
আদ্রিতা মুখ ভেংচি দিয়ে বলল, ‘এত প্লিজ প্লিজ করবেন না তো। অসহ্য লাগে।’ বলেই সে কাপড় শুকানোর দড়ি থেকে শুকনা কাপড়গুলো নিয়ে নিচে চলে গেল।
অন্তর লম্বা শ্বাস ফেলে কিছুক্ষণ দাঁড়িয়ে রইল। তারপর ঘরে গিয়ে বসতেই দ্রুত অন্ধকার নেমে আসে। এখানে প্রথা অনুযায়ী সন্ধ্যা হওয়ার সঙ্গে সঙ্গেই লোডশেডিং শুরু হয়। অন্ধকারে ঘরে বসে থাকতে ভালো লাগে না। একটা চেয়ার এনে সে বাইরে বসে রইল। মনে মনে ভাবছিল, এই সময়ে বৃষ্টি হলে ভালো হতো। অভ্যাসবশত চেয়ারে হেলান দিয়ে আকাশের দিকে তাকিয়ে স্থির হয়ে বসে রইল। হঠাৎ হঠাৎ ওর চোখের পাতা নড়ে ওঠে। আকাশে মেঘ নেই। মেঘমুক্ত আকাশে তারা ফুটেছে। এইমাত্র একটা তারা খসে পড়ল। অন্তর চেয়ে দেখল। চোখের পলকে কীভাবে জ্বলজ্বল করতে থাকা তারাটা অদৃশ্য হয়ে গেল! আরেকটা বিষয় দেখতে ভালো লাগছে, পিলপিল করে হেঁটে যাচ্ছে একটি তারা। যেন সে কোথাও ভ্রমণে বেরিয়েছে। একজন সঙ্গী থাকলে ভালো হতো। তারাদের কি সঙ্গী আছে? নাকি ওরা সত্যিই নিঃসঙ্গ?
আকাশের গ্রহ, তারা, চাঁদ, সূর্য—এরা সবাই একাকী। আরও একজন একাকী আছে—অন্তর। ঠিক যেন কোনো এক ছুটন্ত তারা কিংবা পিলপিল পায়ে হেঁটে চলা নিঃসঙ্গ ভ্রমণকারী।
বাবার কথা মনে পড়ছে ওর। ‘এত পড়ালেখার দরকার নেই,’ বাবা মুখ বিকৃত করে বলতেন। কিন্তু কোনো দিনই স্কুলে যেতে বাধা দিতেন না। এমনকি সে যেদিন ভৈরব চলে আসবে, সেদিনও বাবা বাসস্ট্যান্ডে এসেছিলেন। পকেট থেকে ১০০ টাকার তিনটা নোট বের করে বলেছিলেন, ‘কিছু কিনে খাস। এর বেশি সামর্থ্য নেই আমার।’ অথচ এক বছর ধরে বাবা ঠিকভাবে কথা বলতে চান না। তাঁর মতে, ছেলে বড় হয়ে সংসারের হাল না ধরে উল্টো ফাঁকি দিচ্ছে। যা তাঁর প্রত্যাশার বাইরে। এখন ছেলের উদ্দেশে তাঁর একটাই কথা, ‘তোমার দিন তুমি দেখো।’
ঘুমে অন্তরের চোখ বুজে আসছিল। কাজের মেয়েটা এসে বলল, ‘স্যার, আফনের খাওন আনছি।’
চোখ খুলে দেখল। তারপর উঠে দাঁড়াল বেশ ধীরভাবে। ধীর পায়ে হেঁটেই ঘরে ঢুকল। আজ হয়তো পড়তে বসতেও মন চাইবে না।
চলবে...
বন্ধু, ভৈরব বন্ধুসভা