নারী ও প্রেম সাইকোলজি (দ্বিতীয় পর্ব)

ছবি: এআই/বন্ধুসভা
ভালোবাসার উত্তাপে চুপ থাকা কখনো প্রতিবাদ হয়, কখনো মরে যাওয়ার মতো নীরবতা।

হ‍্যালো, নীলা?
আরে, কেমন আছিস বল!
ওসব ভালোমন্দ পরে হবে। আগে বল হয়েছে কী, হঠাৎ এই লেখা, কিসে কী? কিছুই তো বললি না। দেখ, সব খুলে বল আমাকে, প্লিজ!
আচ্ছা আচ্ছা বলছি শোন। লেখাটা ২২ সালের দিকে, মানে বছর তিনেক আগের ঘটনা।
তাহলে এত দিন পর শেয়ার দিচ্ছিস যে?
কী জানি কী মনে করে দিলাম! আমি সে সময় ক‍্যারিয়ার নিয়ে সবে সিরিয়াস হয়েছি। হঠাৎ পরিচয় হয় নিলয় চৌধুরীর সঙ্গে, ডাকনাম নীল। কত মিল তাই না? এ রকম আরও অনেক কিছুতে মিল আছে। বিষয়টা বেশ ইন্টারেস্টিং লেগেছে। এক–আধটু কথা চলতে চলতে ও একদিন ঘুরতে যাওয়ার কথা বলে। এরপর সোনালি পরশের মতো এক–আধটু কাছে আসার ইতিহাস তৈরি হয়।
তুই!
হ‍্যাঁ, আমি। একটু লাজুক হয়ে বলে, এটাই প্রথম ছিল এবং সে ভাগ‍্যবান, আমিও। কিন্তু যতটা ভাবছিস, ততটা না। এরপর কয়েকবার দেখা হওয়ার পর কোনো এক কারণে যোগাযোগ থেমে আছে। ওই সময়ে লিখে ফেললাম এই লেখা...
‘ব‍্যক্তিত্বশীল, ভীষণ আত্মমর্যাদাসম্পন্ন রমণীগণ কখনো কাহারও যোগ্য প্রেমিকা হইয়া উঠিতে পারে না। এরা স্মার্ট হওয়ার পাশাপাশি ভীষণ রকমের লাজুক স্বভাবের। এই কাননের ফুলমাল‍্য যে পুরুষ গলায় পরিবে, তাহার জীবন ধন‍্য হইবে। কেননা, তাহারা অর্ধেশ্বরকে সর্বস্ব বিলিয়ে দেওয়ার আকুতি নিয়ে বসে থাকে যুগের পর যুগ।’

থেমে আছে যোগাযোগ; তিন মাসের বিরতি। এই সময়টাতেই বাড়িতে বিয়ের চাপ প্রবল হয়ে উঠেছে। কিন্তু আমার অবস্থা হুমায়ূন আহমেদের ‘কোথাও কেউ নেই’–এর মতো। আমিও সম্মতি দিয়ে দিলাম, আর কত রাত একা থাকব, হাঁ হাঁ হাঁ। যাহোক, ইঞ্জিনিয়ার, বড় ব‍্যবসায়ীদের ভেতর থেকে বাছাইপর্ব চলছে। বয়সের পার্থক্যও খুব অল্প। মন্দ কিসে বল? এর মধ্যে হঠাৎ একদিন তার মেসেজ। কিছু কথা চলার পর আবার ঘুরতে যাওয়ার প্রস্তাব। আচ্ছা বেশ, গেলাম। মনের ভেতর জমানো কথার টিপি, অনেক কিছু জানার ইচ্ছা। দীর্ঘদিনের আকুতিভেজা হৃদয় নিয়ে হাজির হলাম ওর সামনে। কী জানি ওর মনে কী ভাসছিল!

গোধূলির আলো তখন সোনালি রঙে গাছে গাছে ছায়া ফেলেছে। হালকা হাওয়া বইছে, পাতার ঝিরঝির শব্দ আর দূরের পাখির ডাক মিলেমিশে যেন এক বিষণ্ন সুর বাজাচ্ছে চারপাশে। আমরা পাশাপাশি বসেছিলাম বোটানিক্যাল গার্ডেনের এক শান্ত কোণে। শব্দহীন নীরবতা যেন অদৃশ্যভাবে আমাদের জড়িয়ে রেখেছে। গল্প চলছে, এমন সময় ওর কাছে আসা খুব একটা স্বাভাবিক লাগেনি আমার। হঠাৎ করেই খুব কাছে এসে ঠোঁট স্পর্শের চেষ্টা, সুযোগ না দেওয়াতে জড়িয়ে ধরে চেষ্টা এবং তা আবারও। মুহূর্তেই তার প্রতি ধারণা বদলে গেল আমার, ভেঙে গেল সব সৌন্দর্য...। অথচ এইখানে বসে কি সুন্দর ইতিহাস গড়তে পারতাম আমরা! প্রতিটা ঘাস, প্রতিটা নিশ্বাস আর প্রতিটা অনুভূতি মিলে জন্ম দিতে পারত এক নতুন পৃথিবীর। তার অদৃশ্য রাগ চোখে পড়ে আমার। সুযোগ হারানোর পর মনে হলো সে যেন বলতে চাইছে, এসব না করলে যোগাযোগ রক্ষা করে আর কী হবে এবং সেটাই সে করেছিল। আমি চুপ ছিলাম। ভালোবাসার উত্তাপে চুপ থাকা কখনো প্রতিবাদ হয়, কখনো মরে যাওয়ার মতো নীরবতা। আমি মরে যাওয়ার মতো নীরব হয়েছিলাম। যে সম্মান তাকে দিয়েছি, সে সম্মান সে ধরে রাখতে পারিনি। একটা দীর্ঘশ্বাস ছেড়ে কিছুক্ষণ চুপ থেকে নীলা বলে, আমি বাড়ি এসে প্রেম সাইকোলজির অঙ্ক মেলালাম।

আরও পড়ুন

১. কয়েক মাসের পরিচয়, থেমে থেমে কথা হওয়া—ওসবের জন্য এটুকু পরিচিতি যথেষ্ট নয়। ভালোভাবে চেনার আগ্রহের চেয়ে জৈবিক চাহিদার বহিঃপ্রকাশ নিঃসন্দেহে ক্ষণিকের চাহিদা ছাড়া কিছু নয়।
২. আমি যদি এসবে রাজি হতাম, তাহলে সে তখন ভাবত, আমি তার চাহিদার ওপর নতিস্বীকার করেছি। ভবিষ্যতে আরও বড় দাবি করতে পারত। এটা ভালোবাসা নয়, মানসিক চাপে ফেলে নিয়ন্ত্রণ করা। এ জন্য এটাকে এগিয়ে নিয়ে যাওয়া যাবে না।
৩. না বলার পর সে কিছুটা হতাশ সুরে বলেছিল, ‘হিসাবে তো অপরিচিত, তাহলে ঘুরতে আসাটাই তো তোমার ঠিক হয়নি।’ তখন বুঝলাম, নিজেই তো অপরিচিত ভাবছে, আবার এত দ্রুত চুমু দেওয়া, জড়িয়ে ধরার চেষ্টা চালাচ্ছে; তার মানে শুধু এসব হলেই তো তার চেকমেট।

বুঝলি, একটু গভীর চিন্তা করলে নিজের মর্যাদা কিসে, তা চিনতে সময় লাগে না। তবে আমার যুক্তিতে এমন ঘটনার সম্মুখীন হলে নারী-পুরুষ যে কারোরই দ্রুত বিয়ে করে নেওয়া উত্তম। পৃথিবীর সব থেকে বড় চাহিদা হচ্ছে টাকা ও যৌন। এই চাহিদার ছিটেফোঁটা স্বাদও যদি মানুষ পায়, তা পূর্ণরূপে পাওয়ার জন্য ব‍্যাকুল হয়ে ওঠে, এগুলো এতটাই ভয়ানক। আর যদি সে বিয়ে না করে, তাহলে এই ব‍্যাকুলতা অবৈধতার দিকে এগিয়ে নিয়ে যাবে, যা ধ্বংসলীলায় ভরপুর ভবিষ্যতের এক টগবগে উদাহরণ হবে। তবে যার প্রতি দুর্বলতা আছে, অনুভূতি আছে, তাকে এড়িয়ে চলা খুবই কষ্টসাধ‍্য রে!

হুম। তাহলে তুই কি বিয়েটা সে সময়ই করেছিলি?

বিষয়টা ও রকমই দাঁড়ায়। আগেই তো বলেছি, এমনিতে ওই সময়ে দেখাশোনা চলছিল, আগুনে ঘি ঢালার মতো আমিও তোড়জোড়ে লেগে গেলাম। খুব কম সময়ের ব‍্যবধানে বিয়েও করে নিলাম আবিরের সঙ্গে। আজ তিন বছর তিন দিন হলো।
তারপর, আমাদের দুলাভাই স্বামী হিসেবে কেমন?
সে স্বামী হিসেবে ১০০–তে ১০০। কিন্তু বরাবরই দেশে থাকতে চেয়েছি। বেশি অর্থকড়ি পছন্দ নয়, এতটা লাক্সারি জীবনযাপন আমার পছন্দ নয়। কিন্তু মানুষ যা চায়, সৃষ্টিকর্তা তার বিপরীতটাই দিয়ে দেন। আমি যে এখনো সাদামাটা থাকি, ছিন্নমূলদের সঙ্গে বেশি সময় কাটাই; এটাতেই আমার প্রশান্তি।

সত‍্যি করে বল তো, তুই সুখে আছিস তো?

বিশ্বাস কর, অন্যদের থেকে বেশি ছাড়া কম নয়। যার স্বামী কেয়ারিং ও পরনারীতে আসক্ত নয়, তার থেকে সুখী দুনিয়ায় কেউ নেই। এ ছাড়া আমি তো চেয়েছিলাম এক হাতে যেহেতু দশ দিক সামলানোর শক্তি আছে, সেহেতু অনেক ছেলেমেয়ে নেব, সংসার সামলাব আবার কর্মক্ষেত্রেও কিছু একটা করব। সন্তান হলে আমার দেশের নারীরা তাঁদের কর্মক্ষেত্রে আনতে লজ্জা পায় বা দ্বিধাগ্রস্ত হয়; ফলে দেখাশোনার জন্য আরেকজনকে রাখে। আহারে, বাচ্চাগুলো মায়ের ছোঁয়া পায় না! আমার ভীষণ ইচ্ছা, দু-তিনটাকে কোলে করে, বেবি কারে করে কর্মক্ষেত্রে নিয়ে যাব, সামলিয়ে চলব। এতে তারা অন‍্যদের চেয়ে বেশি ছাড়া কম মার্জিত হবে না। আর তুইও জানিস, আমি কয়েক বছর থেকে অন‍্যদের আদর্শের কারণ হতে পেরেছি। বর্তমানে সেটা বাড়ছে বৈ কমছে না। আমার দর্শন তো আর পাঁচজনের মতো হলে চলবে না। এতে ওর আপত্তি তো দূরের কথা, বরং আমাকে নিয়ে গর্ববোধ করে। এটা হচ্ছে আমার বাড়তি সুখ।

না রে পাগলী, টিকিয়ে রেখে আর কী করব বল। তার হয়তো একটা ব‍্যক্তিগত জীবন ছিল। আর আমাদের ওভাবে কোনো পরিকল্পনা এগিয়েছিল নাকি!

হ্যাঁ, আমি এখনো তোর নানান কর্মকাণ্ড, চলাফেরা ফলো করি। কর্মক্ষেত্রের বিষয়ে ওমন তো কখনো ভেবে দেখিনি! বেশ অনুপ্রাণিত হলাম। আমিও সেটাই করব এবার থেকে। কিন্তু যদি সব একসঙ্গে সামলাতে না পারিস?
সোজা কথা, চাকরি ছেড়ে দেব, অথবা কম পরিসরে করব। তাতে অর্থ কম উপার্জন হয় হোক। সংসার সামলিয়ে তবেই না বাইরের দুনিয়া। আমার সংসার সামলানো ফরজ, কর্মক্ষেত্রে যাওয়াটা ফরজ নয়। যে যেখানে যতটুকু সময় দিতে পারবে, সেই অনুযায়ী তাকে সেটা করতে হবে।

তোর সঙ্গে যতই কথা বলি, ততই অবাক হই, সম্মান বেড়ে যায়। এখন বুঝিরে, স‍্যার কেন তোকে ভবিষ্যৎ প্রজন্মের উজ্জ্বল নক্ষত্র বলত।
হাঁ হাঁ, কী যে বলিস!
আচ্ছা, ওই ‘কে তুমি’ কবিতাটা কি বোটানিক্যাল গার্ডেন থেকে আসার পর লিখেছিলি?

হ‍্যাঁ, ওই দিনের সার্বিক বিষয় ‘কে তুমি’ লেখাতে ফুটে উঠেছে। ওটা আসলে কবিতা হয়ে উঠেছে কি না, জানা নেই। মনের ভেতর থেকে যা এসেছে, তা–ই লিখে ফেলেছিলাম খুবই অল্প সময়ের মধ‍্যে।
কিন্তু তুই তো একটু চেষ্টা করলে সম্পর্কটাকে টিকিয়ে রাখতে পারতিস।
না রে পাগলী, টিকিয়ে রেখে আর কী করব বল। তার হয়তো একটা ব‍্যক্তিগত জীবন ছিল। আর আমাদের ওভাবে কোনো পরিকল্পনা এগিয়েছিল নাকি!
মানে, বিষয়টা কী, খুলে বল। তুই যে পরিমাণ লাজুক আর চাপা স্বভাবের, শেষ পর্যন্ত কিছুই মন খুলে বলিস না।

এত বছর হয়ে গেল, এখন মন খুলে না বললে কখন বলব বল। ও এমনি মজা করে দু-একসময় বলত, কিন্তু সিরিয়াস ছিল না। আর আমার দিক থেকে বলতে গেলে, আমার মনে হয় ওর অনেক দিনের প্রেম আছে, যাকে সে বিয়ে করতে চায়। অধিকাংশ ছেলেরাই পারমানেন্ট একটাকে ঠিক রাখে, আর যখন যেখানে থাকে, সেখানে একটা করে প্রেমিকার খোঁজ করে। আর মেয়েরাও প্রতিষ্ঠিত, বাইকওয়ালা দেখে প্রেম করার জন্য মাতাল হয়ে যায়। এটা–সেটা কিনে দেওয়া, বিভিন্ন রেস্টুরেন্টে নিয়ে যাওয়ার ফলে সন্তুষ্ট থাকে। তাতে নিজের চরিত্র বিসর্জন গেলেও তাদের যায় আসে না। বর্তমান দুনিয়াটা এভাবেই চলে আসছে। যার হব পুরোটাই তার হব, এটা হচ্ছে আমার মূলকথা। যাহোক, ওর কাহিনিটা এমন হওয়ার সম্ভাবনা বেশি। তবে পুরোপুরি শিওর না।

হ‍্যাঁ, হতেই পারে। তা মেয়েটা কে হতে পারে?

সে পড়েছে রাজশাহী বিশ্ববিদ্যালয়ে, আমি কীভাবে বুঝব বল। হতে পারে অনার্স চলাকালে কেউ অথবা এলাকার কেউ। ওর ফেসবুক কভারফটোতে তো দেখেছিলাম সানজিদা নামে একটা মেয়ের তোলা ছবি ২০১৮ সাল থেকে ঝুলছে। এখনো চেঞ্জ করেনি। বিশেষ ভালোবাসা না থাকলে এমনটা করার কথা নয়।
বুঝলাম।
নিশ্চিতভাবে কাউকে নিয়ে এভাবে বলাটা ঠিক নয়। শুধু তোর সঙ্গে অনেক কথা হলো, তাই বললাম। তবে সচরাচর এমনটাই হয়ে থাকে।
তাহলে এই হচ্ছে ইতিহাস।
হুম, এই হচ্ছে ইতিহাস।

রায়নন্দিনীর স্বামীও বলে ওঠে, এই হচ্ছে ইতিহাস! ফিসফিসিয়ে বৃষ্টি ঝরছে, যেন সহস্র জন্মের জমা করে রাখা প্রেমকাহিনির নীরব সাক্ষী হতে এসেছে তারা। ক্যাফে নিকেতন থেকে ভেসে আসছে—
‘যদি মন কাঁদে তবে চলে এসো, চলে এসো এক বর্ষায়...’

(সমাপ্ত)

কার্যনির্বাহী সদস্য, যশোর বন্ধুসভা