নারী ও প্রেম সাইকোলজি (প্রথম পর্ব)

ছবি: এআই/বন্ধুসভা
ওকে নিয়ে বরাবরই আমার বেশ আগ্রহ। কিন্তু এই লেখা প্রথম দিন দেখেই চিন্তিত হয়ে পড়লাম। হিসাব মিলছিল না। এ জন্য ওকে তখনই কল দিই।

ঝুম বৃষ্টিতে চায়ের চুমুকে স্বামীর সঙ্গে বসে রায়নন্দিনী। বেলকনিতে দুলছে প্রিয়দর্শিনী ফুলগাছ। গাছজুড়ে ঝাঁপিয়ে আছে কমলা রঙের প্রিয়দর্শিনী এবং দোলনায় লতানো তরুলতা। ক‍্যাফে নিকেতন থেকে মৃদু সুর ভেসে আসছে রবীন্দ্রনাথের ‘আজি ঝরো ঝরো মুখর বাদর দিনে...’।

বৃষ্টিতে রোমান্টিক হয়ে যাওয়া কিংবা পুরোনো দিনের কথা মনে পড়ে যাওয়া বাঙালির চিরায়ত অভ‍্যাস। রায়নন্দিনী বলে উঠল, কী গো, গল্প শুনবে না? আমার কলেজজীবনের বিশেষ একজনের গল্প তোমাকে শোনাতে চাই। প্রায় ঝিমিয়ে পড়া স্বামী ঝম করে উঠেই একটু মজার ছলে বলে উঠল, হ‍্যাঁ হ‍্যাঁ, কেন নয়! বৃষ্টিতে পুরোনো প্রেমের কথা মনে পড়ে গেল নাকি? একটু দুষ্টু হেসে রায়নন্দিনী স্বামীর কাঁধে মাথা রেখে শুরু করে দিল...

আমার বান্ধবী নীলা রায়। বইপোকা, কর্মচঞ্চল, ভাবুক, সাংগঠনিক ব‍্যক্তিত্ব, দেশপ্রেমী ও সদা হাস্যোজ্জ্বল এক নারী। তবে শুধু এটুকু হলে চলবে? আরেকটা বিষয় বাদ পড়ে গেল। প্রেমময়ী। আর পাঁচজনের মতো সেভাবে প্রেম না করলেও আমিসহ বান্ধবীরা অনেকেই তার থেকে প্রেম সাইকোলজি ধার নিতাম। বুঝি না সে কীভাবে এত বুঝত। এই বৃষ্টিস্নাত রোমান্টিক দিনে তোমাকে ওর নিজের প্রেম সাইকোলজির একটা বিশেষ অংশ নিয়ে বলছি।

হুম অবশ্যই। কেন নয়!

বহু মানুষকে ওর প্রেমে পড়তে দেখেছি। কিন্তু সে এমন সুন্দর করে ইগনোর করত যে তারাও সম্মান নিয়ে চলে যেত। যেমন ধরো ক্লাসমেট, ওকে পছন্দ করে। নীলা তার সঙ্গে বারবার কথা বলে তাকে সূক্ষ্মভাবে বিশ্লেষণ করত। এরপর গল্পের ছলে ওর পছন্দের এমন এমন নমুনা বলে দিত, যা ওই ছেলেটার হওয়া মোটেও সম্ভব নয়। বাধ‍্য হয়ে ছেলেটা চুপিসারে কেটে পড়ত।

এরপর ধরো এক সিনিয়র ওকে ভালোবাসে। তাকে দেখিয়ে দেখিয়ে বেশি সুন্দর করে ফোনে কথা বলা, ফোন না এলেও কানে ধরে রাখা এবং সিনিয়রকে মুখে বলা, কই না তো, আমি প্রেম করি না। এভাবে সিনিয়রের মনে সন্দেহ ঢোকানোর ফলে একসময় সিনিয়রের চেষ্টা লঘু হয়ে যায়। আর নাছোড়বান্দা হলে বলে, কারও ব্যক্তিগত বিষয়ে নাক গলানো আনস্মার্টের কাজ। আর আমি আনস্মার্ট মানুষ পছন্দ করি না।

বাহ এসব তো চমৎকার ট্রিকস!

হুম। ও একটা কথা সব সময় বলে, ‘বালিকা তোমার প্রেমের পদ্ম দিয়ো না এমন জনকে, যে ফুলে ফুলে উড়ে মধু পান করে অবশেষে ভাঙে মনকে...’। এই গান আমার ওপর অনেক প্রভাব ফেলেছে হাইস্কুল থেকে। গানটা প্রতিটা মেয়ের শোনা ফরজ বলে মনে করি।

হ‍্যাঁ, হিসাবে ফরজই বলা যায়। আমি আজই এটা সামাজিক যোগাযোগমাধ্যমে স্ট্যাটাস দেব। এরপর বলো।

এরপর ধরো, কোনো ছেলে একটা মেয়েকে অল্প কিছুদিনের পরিচয়ে খুব প্রশংসা করছে, মিষ্টি মিষ্টি কথা বলছে, অথবা এটা–সেটা কিনে দিচ্ছে; তখনই সব মেয়েরা গলে যায় মোমের মতো। অথচ এটাই মিথ্যা ভালোবাসার সব থেকে বড় একটা উদাহরণ। যখন দেখবে এতে কাজ হচ্ছে, তখন প্রায় প্রায় ঘুরতে যাওয়া ও নিজের ইনোসেন্ট ভাবকে বিশ্বাস করাতে থাকবে, তুমিই প্রথম, যাকে এত সময় দিচ্ছি...,একদম ভিন্ন লাগে..., এত চেনা চেনা মনে হয়...ইত্যাদি ইত্যাদি। এরপর শুরু হয় হাত ধরা, মুভি দেখা, চুমু দেওয়া এবং আরও গভীর কিছু। মেয়েরা আসলে খুব বোকা হয় জানো! এ যুগে ছেলেরা প্রতারিত হলেও মেয়েদের সংখ্যাটাই বেশি।

আমারও সেটাই মনে হয়।

যাহোক, এরপর যখন দেখা যাবে কোনো ছেলে দূর থেকে অথবা কাছে থাকলেও কিছুটা আড়ালে থেকে তাকে দেখে, কথা বললে নার্ভাস থাকে ও এমন উত্তর দিতে পারে না, যেটাতে মেয়ে গলে যেতে পারে, অল্প সময়ের ব‍্যবধানের পরিচিতিতে কাছে আসার বদলে বন্ধুত্বপূর্ণ সম্পর্ক গড়তে ও সমস্যাগুলো শুনতে আগ্রহ প্রকাশ করে, মেয়েটার ইচ্ছাকে মর্যাদা দেয়, তারাই প্রকৃত ভালোবাসে। প্রকৃত ভালোবাসায় আবেগ, মায়া এগুলো থাকে বেশি, কিন্তু প্রকাশ থাকে কম। আর মিথ্যা ভালোবাসায় এর বিপরীতটা ঘটে। অথচ মেয়েরা এমন ছেলেদের পাত্তা দিতে চায় না।

তোমার এত অভিজ্ঞতা কোথা থেকে হলো!

আরে এসব বিশ্লেষণ নীলার থেকে শিখেছি। কয়েক দিন আগে ওর একটা লেখা আমাকে বেশ নাড়া দিয়েছে। দাঁড়াও, তোমাকে দেখাচ্ছি। লেখার নাম ‘কে তুমি’।

‘কে তুমি বলো!
তুমি তো সেই, যার দেখায় শীতল হয় আঁখি
তুমি তো সেই, চাইলেও যার ওপর চড়াও হওয়া যায় না
তুমি তো সেই, যে অধিকার দখলের সাহস দেখিয়েছ নীলার প্রতি
তুমি তো সেই, যার ভেতর খুঁজে পাই নিজ সত্তা
তুমি সেই, যে প্রথম দেখাতে খুব পরিচিত
যার উষ্ণ পাঁজরের ছোঁয়া মিশে থাকে সারাক্ষণ
যার প্রতিটা হৃৎস্পন্দন শোনার অপেক্ষায় ব‍্যাকুল হয় মন
যার প্রশান্তির বুকে কাটাতে ইচ্ছে হয় অনন্তকাল
যার ঘন ঘাসের ছোঁয়া ভেঙে ফেলে সব ধৈর্যকে
এত পরিচিত, এত পরিচিত, এত পরিচিত, কে তুমি!
অথচ শোনালে বিপরীত লিঙ্গের বিকর্ষণ অর্থ সমস্যা
অথচ জানালে ক্লোজ না হলে দেখা করে কী হবে
অথচ চিনলেই না আমাকে; আমার দামি ভালোবাসাকে
অথচ বুঝলে না কথার ছুরিকাঘাত ম‍্যারিয়ানা খাতের চেয়ে আমার হৃদয়ের অতল গভীরে গিয়ে লেগেছে, এলোপাতাড়ি আক্রমণে ক্ষত–বিক্ষত হয়েছি আমি।
কীভাবে বোঝাই বলো, ভীষণ সম্মানের তোমাকে অবৈধ উল্লাসে অপমান করতে চাইনি
বলো কীভাবে বোঝাই, তোমাকে শুধু একটুকরো পেতে চাই না
বলো না কীভাবে বোঝাই, তোমাতে একবার ডুব দিলে আর উঠতে পারব না
আর কীভাবে বোঝাই, তোমার ছোঁয়ায় লাজুকতা ছেয়ে ধরে আমার আপাদমস্তক।’

ওকে নিয়ে বরাবরই আমার বেশ আগ্রহ। কিন্তু এই লেখা প্রথম দিন দেখেই চিন্তিত হয়ে পড়লাম। হিসাব মিলছিল না। এ জন্য ওকে তখনই কল দিই।

(চলবে...)

কার্যনির্বাহী সদস্য, যশোর বন্ধুসভা