আমি চিরবিদ্রোহী বীর

কাজী নজরুল ইসলাম (১১ জ্যৈষ্ঠ ১৩০৬—১২ ভাদ্র ১৩৮৩)প্রতিকৃতি: মাসুক হেলাল

বাংলা সাহিত্যের আকাশে যে নক্ষত্র অগ্নিশিখার মতো দীপ্ত হয়ে উঠেছিলেন, তিনি কাজী নজরুল ইসলাম। আমাদের জাতীয় কবি। আমরা তাঁকে বলি বিদ্রোহী কবি। তিনি ছিলেন বজ্রের মতো উচ্চারণে মুক্তির ডাক, আবার বাঁশির সুরে প্রেমের মৃদু গান। তাঁর জীবনের প্রতিটি অধ্যায়ে দেখতে পাই সংগ্রাম, প্রতিবাদ আর মানবতার অমোঘ জাগরণ।

নজরুলের কবিতা শুধু শব্দ নয়, ছিল একেকটি স্লোগান, একেকটি অস্ত্র। তাঁর কবিতায় শুনি স্বাধীনতার শব্দ, পাই জেগে ওঠার আহ্বান। তিনি যে উচ্চারণ করেছিলেন, তা শুধু কাব্যের সৌন্দর্য নয়, তা ছিল জাতির আত্মপরিচয়ের ঘোষণা। পরাধীনতার অন্ধকার ভেদ করতে তিনি কলমকে বানিয়েছিলেন অগ্নিশিখা, আর সুরকে রূপ দিয়েছিলেন বিপ্লবের শপথে। তাঁর লেখা পড়লেই বোঝা যায়, কীভাবে একজন কবি পুরো জাতির বুকে আগুন ধরিয়ে দিতে পারেন।

বিদ্রোহী কবি আজ দেহে নেই, কিন্তু তাঁর বজ্রধ্বনি আজও বাতাসে প্রতিধ্বনিত হয়—

নজরুল ছিলেন সাম্যের কবি। তাঁর চোখে মানুষ মানেই মানুষ—যেখানে ধর্ম, বর্ণ, গোত্র, জাতি কোনো ভেদাভেদ নেই। তিনি গেয়েছেন মিলনের গান, শিখিয়েছেন ভালোবাসার পথ। হিন্দু-মুসলিম মিলনের অগ্রদূত হিসেবে তিনি বলেছিলেন, একে অপরকে আঘাত করলে মানুষ আসলে নিজেকেই আঘাত করে। তাঁর প্রেমে যেমন আছে শিউলি ফুলের কোমলতা, তেমনি আছে শাণিত তরবারির ঝলক। এ কারণেই তাঁর সাহিত্য একসঙ্গে বিদ্রোহ আর প্রেমের অনন্য সংমিশ্রণ।

নজরুলের জীবনে এসেছে বহু বাধা। তাঁর কলম বারবার শৃঙ্খলিত হয়েছে, তাঁকে কারাবন্দী করা হয়, তবু তিনি দমে যাননি। প্রতিটি বাঁধন ভেঙে নতুন করে জেগেছেন। এমনকি বন্দিজীবনেও তিনি লিখেছেন গান-কবিতা, যা মানুষকে অন্যায়ের বিরুদ্ধে দাঁড়ানোর প্রেরণা জুগিয়েছে।

তাঁর অবদান শুধু কবিতায় সীমাবদ্ধ নয়। সংগীতে তিনি রচনা করেছেন হাজারো গান, যেখানে একদিকে আছে ইসলামি গান, অন্যদিকে আছে শ্যামাসংগীত, কীর্তন, পল্লিগীতি। এর মাধ্যমে তিনি দেখিয়ে দিয়েছেন সৃষ্টির কোনো দেয়াল নেই, গান ও কবিতারও কোনো ধর্ম নেই। শিল্পই মানুষের সর্বজনীন পরিচয়।

আরও পড়ুন

জীবনের শেষভাগে দীর্ঘ অসুস্থতায় কবি নীরব হয়ে যান। কিন্তু তাঁর নীরবতা সৃষ্টিকে স্তব্ধ করতে পারেনি। স্বাধীন বাংলাদেশ তাঁকে বরণ করে নিয়েছিল জাতির হৃদয়ে। রাষ্ট্রীয় মর্যাদায় তাঁকে জাতীয় কবি হিসেবে স্বীকৃতি দেওয়া হয়, যা আজও আমাদের গর্ব।

আজ জাতীয় কবি কাজী নজরুল ইসলামের প্রয়াণদিবসে আমরা শুধু একজন কবিকে নয়, একজন দিশারিকে স্মরণ করি। তাঁকে স্মরণ করা মানে ভেতরে ঘুমিয়ে থাকা সাহসকে জাগানো, প্রতিবাদের শপথ নেওয়া, মানবতার পতাকা উঁচু করা।

বিদ্রোহী কবি আজ দেহে নেই, কিন্তু তাঁর বজ্রধ্বনি আজও বাতাসে প্রতিধ্বনিত হয়—
‘আমি চিরবিদ্রোহী বীর, বিশ্ব ছাড়ায়ে উঠিয়াছি একা চির-উন্নত শির!’