মুঘল সম্রাট আকবর ভারতবর্ষে তাঁর সাম্রাজ্যকে ১২টি রাজ্যে ভাগ করেন। সেই রাজ্যগুলো ছিল কাবুল, লাহোর, মুলতান, দিল্লি, আগ্রা, অবধ, ইলাহাবাদ, বিহার, মালওয়া, আজমির ও গুজরাট। তখন এর প্রতিটি রাজ্যকে একেকটি সুবাহ বলা হতো। একজন মুঘল গভর্নর এসব রাজ্য শাসন করতেন। গভর্নরদের বলা হতো সুবেদার। সে সময় বাংলা নামে এক বিশাল বিস্তৃত সুবাহ ছিল। বর্তমান বাংলাদেশ, ভারতের পশ্চিমবাংলা, বিহার, উড়িষ্যা, মধ্যপ্রদেশ ও আসাম নিয়ে এ অঞ্চল ছিল। সুবে বাংলা ছিল মুঘল সাম্রাজ্যের সবচেয়ে বড় রাজ্য। এর আয়তন ছিল ১ লাখ ৯০ হাজার মাইল। লোকসংখ্যা ছিল প্রায় ৮ কোটি।
তখন ১৬১০ সাল। এ সময় থেকে মুঘলরা বাংলার ঢাকাকে নান্দনিক বাগান, দুর্গ, সমাধি, প্রাসাদ ও মসজিদ নির্মাণের মধ্য দিয়ে নগর গড়ে তোলে। সে সময় ঢাকার নাম ছিল জাহাঙ্গীরনগর। তখন বাংলার সবচেয়ে নামকরা বাণিজ্যিক পণ্য ছিল ঢাকার মসলিন। তাই ঢাকাকে তারা মুঘল সাম্রাজ্যের বাণিজ্যিক রাজধানী করেছিল। সে সময় বাংলা ছিল পৃথিবীর সবচেয়ে ধনী অঞ্চল। বিশ্বের মোট উৎপাদনের ১২ শতাংশ ছিল এখানে। এটা ছিল ইউরোপের মোট উৎপাদনেরও বেশি। এই বাংলার প্রথম শাসক ছিলেন ইসলাম খান। তাঁর নামেই পুরান ঢাকার নামকরণ হয় ইসলামপুর।
বাংলার শেষ নবাব সিরাজউদ্দৌলা ছিলেন মুঘলদের উত্তরসূরি। সিরাজের সময় এখানে ইস্ট ইন্ডিয়া কোম্পানির ঘাঁটি ছিল। কোম্পানির সেনাপাতি রবার্ট ক্লাইভ সিরাউদ্দৌলাকে খুব একটা গুরুত্ব দিতেন না। তিনি নবাবের সেনাপতি মীর জাফরের সঙ্গে ষড়যন্ত্র করতেন। সেটা ১৭৫৭ সালের কথা। বাংলার রাজধানী তখন নদীয়া জেলায়। নদীয়া ছিল কলকাতা থেকে প্রায় ৯৩ মাইল উত্তরে মুর্শিদাবাদের কাছে। এখানে পলাশী নামে একটি গ্রামে কোম্পানির সেনাপতি রাবার্ট ক্লাইভের সঙ্গে সিরাজউদ্দৌলার যুদ্ধ হয়। এ যুদ্ধে নবাব পরাজিত হন। তখন বিশাল সুবে বাংলার শাসন চলে যায় ইস্ট ইন্ডিয়া কোম্পানির হাতে। কোম্পানি বাংলার নাম দিয়েছিল বেঙ্গল প্রেসিডেন্সি।
কলকাতাকে রাজধানী করে কোম্পানি এ অঞ্চল শাসন করতে থাকে। প্রায় দেড় শ বছর কলকাতা বাংলার রাজধানী ছিল। কোম্পানির শোষণ-বঞ্চনা, অত্যাচারে প্রায় শুরু থেকেই এ জনপদের মানুষ তাদের বিরুদ্ধে আন্দোলন-সংগ্রাম, বিপ্লব-বিদ্রোহে জীবন দিতে থাকে। এ দেশে ব্রিটিশবিরোধী প্রথম স্বাধীনতাসংগ্রাম ছিল ফকির–সন্ন্যাসীদের। সেটা ছিল ১৭৭০ থেকে ১৮০০ সাল পর্যন্ত প্রায় তিন দশকের এক রক্তক্ষয়ী সংঘর্ষ। এরপর ১৮০০ সাল থেকে প্রায় ছয় দশক ধরে ফরায়েজি, তাঁর ছেলে দুদু মিয়া ও তীতুমীররা ব্রিটিশের বিরুদ্ধে আন্দোলন করেন। কোম্পানি বাংলা দখলের ঠিক ১০০ বছর পর ১৮৫৭ সালে সিপাহিরা বিদ্রোহ করেন। এই বিদ্রোহ ছিল ব্রিটিশের বিরুদ্ধে প্রথম সংগঠিত স্বাধীনতাযুদ্ধ।
বাংলার মতো এত বড় রাজ্য ব্রিটিশদের শাসন করা সম্ভব ছিল না। তার ওপর তাদের ষড়যন্ত্র ছিল বড় রাজ্যকে ভেঙে ছোট করে দুর্বল করা। যেন তারা প্রতিবাদী না হয়। তাই কয়েক দশক ধরে ইংরেজদের বাংলা ভাগের পরিকল্পনা ছিল। অবশেষে ১৯০৫ সালের ১৬ অক্টোবর লর্ড কার্জন ঢাকাকে রাজধানী করে পূর্ব বাংলা ও আসাম নিয়ে গঠন করেন পূর্ব বাংলা ও আসাম প্রদেশ। আর কলকাতাকে রাজধানী করে পশ্চিম বাংলা, বিহার, উড়িষ্যা নিয়ে গঠন করেন পশ্চিম বাংলা প্রদেশ। ইতিহাসে এটিই বহুল আলোচিত ১৯০৫ সালের বঙ্গভঙ্গ। ১৭৫৭ সাল থেকে ১৯০০ সাল পর্যন্ত বাংলার বিপ্লব-বিদ্রোহের তেমন কোনো গান, কবিতা, স্লোগান, গ্রাফিতি পাওয়া যায় না। তবে বাংলায় বঙ্গভঙ্গ আন্দোলন থেকে এর প্রচলন দেখা যায়। সেই সুবে বাংলা থেকে হাঁটতে হাঁটতে এসেছি বাংলাদেশে।
চলবে…
লেখক ও গবেষক