মা বারান্দার সোফায় বসে পরিস্থিতি অবলোকন করছিল। মৃদুলাকে দেখে উঠে দাঁড়াল। ‘দেখো না মা, কী উটকো ঝামেলা। ছেলেটা বলছে, তোর দাদু নাকি ওর দাদুর জীবনটা ধ্বংস করে দিয়েছে।’ অভিজিতের সঙ্গে পরিচয় থাকলেও বাড়ির ঠিকানা, মোবাইল নম্বর আদান-প্রদান, গভীর সম্পর্ক কোনোটাই হয়নি। তাই নিশ্চিতভাবে অভিজিত তার কাছে আসবে না। এসব ভাবনা মাথায় থাকলেও মন উৎকণ্ঠায় পর্যুদস্ত। কী দিয়ে কী হয়! বাড়ির সামনে প্রতিবেশীদের অনেকে এসে জড়ো হয়েছে। সবাই মুখিয়ে আছে, কিছু একটা গন্ধ পেলেই খপ করে ধরবে। সমালোচনা, পরনিন্দার উৎসব চারপাশে। আর বাড়ির ছেলেমেয়েঘটিত বিষয় হলে তো ষোলোকলা পূর্ণ। কিন্তু সে ভয় নেই। মায়ের মুখে কথাটা শুনে বুকের ওপর থেকে পাষাণ সরে যাওয়ার মতো শান্তি অনুভব করে মৃদুলা।
অন্য দিন হলে কিছুক্ষণ মাকে জড়িয়ে ধরে থাকত সে। অথবা দাদুকে শান্ত করতে এগিয়ে যেত। জীবনের প্রতিটি মুহূর্ত পরিস্থিতিনির্ভর। নিজের প্রয়োজন ও সাবধানতা বিবেচনায় নিয়ে মানুষকে সিদ্ধান্ত নিতে হয়। অবনী যদিও একমত নয়, পরিস্থিতি বিবেচনায় নিয়ে মিথ্যাকে সত্য আর সত্যকে মিথ্যা কিংবা কর্তব্যের কাজটিকে এড়িয়ে যাওয়া আর যা–ই হোক পরিপূর্ণ জীবনের লক্ষ্য হতে পারে না। তা হোক আর না হোক, এ মুহূর্তে ওপরে চলে যাওয়াই নিরাপদ। অভিজিতের চোখে পড়লে ঘটনার আড়ালের ঘটনা উদ্ধার করা কঠিন হবে। দাদু চাপা স্বভাবের মানুষ। অবসরের পর সারাক্ষণ মুখের সামনে বই নিয়ে বসে থাকেন। প্রয়োজন ছাড়া টুঁ–শব্দটি করেন না।
কপালজুড়ে ঘাম মৃদুলার, চোখে-মুখে ভয়ের চিহ্ন। মা আশ্চর্য হলেন। ভয় পাওয়ার মেয়ে নয় সে। ছেলেমেয়েকে মায়ের থেকে ভালো দ্বিতীয় কেউ চিনতে পারে না, বুঝতে পারে না। তা ছাড়া পরিচিত মানুষের অপরিচিত স্বভাব মনকে উসকে দেয়, ভাবায়। এমন আগে কখনো হয়নি। ডাক্তার নিষেধ করার পর দাদুকে উচ্চস্বরে কথা বলতে শুনলেই চিৎকার করতে নিষেধ করে মৃদুলা। মানুষ প্রত্যাশাপরায়ণ। জীবনের অধিকাংশ সম্পর্ক নির্মিত হয় প্রত্যাশার ওপর। মা নিশ্চিত ছিলেন দাদুকে থামাতে এগিয়ে যাবে মৃদুলা। দাদুর পাশে গিয়ে দাঁড়াবে। কিন্তু এসবের কিছুই ঘটেনি।
অনেকখানি বিস্ময় নিয়ে মা জিজ্ঞেস করে ‘কী রে, গিয়ে থামা দাদুকে! ছেলেটা যা খুশি বলবে, আমাদের মেনে নিতে হবে। আশ্চর্য!’ যে প্রশ্নের উত্তরের ব্যাপকতা থাকে। তার উত্তর না দিয়ে এড়িয়ে যাওয়াই শ্রেয়। না হলে ঝামেলা বাড়বে বই কমবে না। এ ধারণা মৃদুলার। জীবনের প্রত্যেক ক্ষেত্রে বিষয়টা সে মেনে চলে। আজও ব্যতিক্রম ঘটেনি, অভদ্রতা জেনেও উত্তরে মাকে কিছু না বলে ওপরে উঠে যায় সে।
ঝুলবারান্দা থেকে বাড়ির সামনের উঠান দেখা যায় না। তারপরও বারান্দায় এসে দাঁড়াল মৃদুলা। দাদুর কণ্ঠস্বর শোনা যাচ্ছে, বলে যাচ্ছেন তিনি। আগামাথা কিছু বোঝা যাচ্ছে না। অনেকটা সুর ছাড়া গানের মতো। খারাপ লাগছে মৃদুলার। শেষ পর্যন্ত দাদুর ভাগ্যেও অপবাদ ছিল। তিনি সর্বজন শ্রদ্ধেয় মানুষ। এ তল্লাটের কেউ তার সামনে গলা তুলে কথা বলে না। সবচেয়ে বড় কথা মানুষটা অসুস্থ, উত্তেজিত হওয়া নিষেধ। আচ্ছা আমি ছাড়া কি কেউ নেই বাড়িতে? মা নিজে গিয়ে কি দাদুকে থামাতে পারে না, দুটো কড়া কথা শুনিয়ে দিতে পারে না অভিজিতকে!
মৃদুলার ওপর যারপরনাই অসন্তুষ্ট হয়েছেন মা। মৃদুলার জন্য অনেক করেছে দাদু। আর ভালোবাসা! যেবার জন্ডিস হলো মৃদুলার। বাবা তখন অফিসের কাজে দেশের বাইরে। কাকাদের কারও ছুটি নেই। প্রত্যেকেই নিজেদের কাজে ব্যস্ত। স্থানীয় ডাক্তারদের কেউ দায়িত্ব নিলেন না। বাঁচা-মরা নিয়ে সংশয়। দাদুও দেশের বাইরে তখন, চিকিৎসা নিতে গিয়েছেন। উপায় না পেয়ে শেষমেশ তাকে জানানো হলো। চিকিৎসা গ্রহণ মাঝপথে রেখে দেশে ফিরলেন দাদু। সুচিকিৎসার ব্যবস্থা হলো মৃদুলার। ডাক্তার সৃষ্টিকর্তার ওপর বিশ্বাস রাখতে বললেন। দাদু স্থির করলেন মৃদুলা সুস্থ হয়ে উঠলে কিছু অসহায় মানুষকে পেট পুরে খাওয়াবেন। মৃদুলা ভালো হয়ে উঠল। দাদু অসহায়-বঞ্চিত মানুষদের নিয়ে উৎসবের আয়োজন করলেন।
শিশুকালের কোনো ঘটনা নয় যে মৃদুলা ভুলে যাবে। সব মনে আছে। তখন উচ্চমাধ্যমিক দ্বিতীয় বর্ষে পড়ে সে। বড় হলে সন্তান পরিবর্তন হয়ে যায়। তাই বলে এতটা, মৃদুলা কি সত্যিই কিছু মনে রাখেনি? আজ তো দাদুর পাশে দাঁড়ানোর দিন। অথচ কর্তব্য না করে সে কিনা এড়িয়ে গেল! আমি তো এমন সন্তান চাইনি। ভাবতে ভাবতে এগিয়ে গেল মা। চেঁচামেচি কিছুটা কমেছে। অভিজিতের জামার কলার ছেড়ে দূরে দাঁড়িয়ে আছেন দাদু। অভিজিতও দাঁড়িয়ে আছে। তার হাতে একটি পাটের আঁশে তৈরি সোনালি রঙের ব্যাগ। মাকে দেখে লজ্জা পেলেন দাদু, মুখ অন্যদিকে ঘুরিয়ে নিলেন। জীবনের সবচেয়ে কষ্টের ও নির্মম যন্ত্রণার দিন তাঁর। দুঃস্বপ্নেও কোনো দিন যা ভাবেননি তাই ঘটেছে।
(চলবে)
সাংগঠনিক সম্পাদক, যশোর বন্ধুসভা