যে কথা কেউ জানে না (প্রথম পর্ব)

অলংকরণ: মাসুক হেলাল

এক
নদীর তীর ঘেঁষে ফুটবল মাঠের মতো বিস্তৃত একটি খোলা জায়গা। এর পরই মৃদুলাদের বাড়ি। পুরোনো ধাঁচের, দোতলা। গেটের মুখে ডান পাশে রয়েছে একটি কৃত্রিম ঝরনা। অনবরত নির্মল ছন্দে জল পড়ছে। নতুন কেউ সামনের রাস্তা ধরে হেঁটে গেলে, অতীব চমৎকার ওই শিল্পকর্মটি দেখে না থেমে পারেন না। দেখতেই দুই চোখ জুড়িয়ে যায়। মনে হয়, বায়ু আর বিদ্যুৎ–সংযোগে মেঘনার উৎফুল্ল জলরাশির কিঞ্চিৎ এখানে উপচে পড়ছে।

দোতলার ঝুলবারান্দা–লাগোয়া ঘরটা মৃদুলার। বংশের বড় সন্তান হওয়ার সুবাদে ঘরটা তার। যদিও কাকাতো ভাই-বোনদের কারও কারও এ বিষয়ে ঘোরতর আপত্তি আছে। কিন্তু দাদুর ভয়ে স্পষ্ট স্বরে কেউ কিছু বলে না। আর আড়ালে-আবডালে চুপি-চুপি কখনো-সখনো কিছু-মিছু বললেও মৃদুলা গুরুত্ব দেয় না। ঘরটার বিশেষ বৈশিষ্ট্য আছে। শীতের দুপুরে মিষ্টি রোদ, শ্রাবণে বৃষ্টির ছাঁট, সহজ করে বললে ঋতুচক্রের প্রতিটি শোভা বারান্দায় বসে উপভোগ করা যায়।

আজ শুক্রবার, কলেজ বন্ধ। করোনাভাইরাসের প্রকোপ কাটিয়ে শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান ছন্দে ফিরছে। বহুদিন পর একটি অনুষ্ঠান হবে কলেজে। সাংস্কৃতিক অংশের দায়িত্ব মৃদুলার ওপর। কোনো প্রোগ্রাম হলেই ডাক পড়ে তার। সাংস্কৃতিক কার্যক্রমের জন্য কেন যে প্রতিষ্ঠানগুলোতে এক্সপার্ট ইনক্লুড করা হয় না, কে জানে! এগুলোরও তো প্রয়োজন আছে জীবনে। কিন্তু কে কাকে এ কথা বোঝাবে? কিছু দিন আগে একজন বড় মাথাওয়ালা লোকের কাছে বিষয়টি উত্থাপন করেছিল মৃদুলা। ভদ্রলোক গুরুত্ব দেননি। বলেছেন, মন দিয়ে পড়ালেখা করতে। আগে শুনলে রাগ হতো মৃদুলার, কিন্তু এখন সহ্য হয়ে গেছে। এসব বিষয় সে ওভারলুক করে চলে।

অভিজিৎ গেটের মুখে দাঁড়িয়ে আছে। সব সময় গেট ভেতর থেকে বন্ধ থাকে। আজ প্রথমবারের মতো এ বাড়িতে এসেছে সে। বাড়ির নিয়মকানুন কিছুই জানে না। তাঁর এক বান্ধবীর সূত্রে মৃদুলার সঙ্গে পরিচয়। সে ভালো নজরুলগীতি গায়। আর মৃদুলা রবীন্দ্রসংগীতে সেরার পুরস্কার বিজয়ী। দুজনের মধ্যে কালেভদ্রে কথা হয়, কোনো ভাবলেশ নেই। কিন্তু বন্ধুদের কেউ কেউ প্রেম, ভাব, ঢং ইত্যাদি বলে চাপিয়ে দিতে চায়। অভিজিৎ উত্তরে কিছু না বললেও গভীরভাবে ভেবে দেখেছে, মৃদুলার প্রতি কোনো ভালোলাগা নেই তাঁর। বন্ধুরা মজা নিচ্ছে নিক, শুধু শুধু কথা বাড়িয়ে জটিলতা তৈরির কী দরকার!

রিহার্সাল ছাড়া ভালো কিছু প্রেজেন্ট করা কঠিন। মৃদুলা হারমোনিয়াম নিয়ে বসেছে। বর্ষার গান, বর্ষাকে বরণ করে নিতে উদ্যোগ নিয়েছে কলেজ কর্তৃপক্ষ। ‘বাদল দিনের প্রথম কদমফুল করেছ দান’ কবিগুরু রবি ঠাকুরের গান। শুনলে প্রাণ জুড়িয়ে যায়। জীবনের স্রোতে পরতে পরতে রবীন্দ্রনাথের স্পর্শ অনুভব করে মৃদুলা। উদাত্ত কণ্ঠে গানটা গাইছে সে। সঙ্গে একটি চিৎকারের ধ্বনিও থেমে থেমে চড়াও হচ্ছে। দাদুর কণ্ঠস্বর। উত্তেজনা শরীরের জন্য ভালো নয়, দাদুর চিৎকার করা মানা, ডাক্তার নিষেধ করেছেন। হাই প্রেশার, হাই ব্লাড সুগারসহ নানান শারীরিক জটিলতায় ভুগছেন দাদু। মৃদুলা ছাড়া কারও কথা শোনেন না তিনি। এক দৌড়ে ওপর থেকে নিচে এলো মৃদুলা। দাদু দুই হাতে অভিজিতের জামার কলার ধরে থেমে থেমে উচ্চ স্বরে কথা বলছেন।
অভিজিতের প্রতি মৃদুলার সূক্ষ্ম দুর্বলতা আছে, এই ধারণা অবনীর। সাধারণত মেয়েরা কাচের চুড়ির মতো নিতান্ত তুচ্ছ বিষয়েও ভালোবাসা অনুভব করে। সযতনে গুছিয়ে রাখে তুচ্ছ থেকে তুচ্ছ, মূল্যবান থেকে দুর্মূল্যের প্রতিটি বস্তু। কিন্তু অভিজিতের দেওয়া হারমোনিটা খাটের নিচে পড়ে থাকতে দেখে ভাবনা বদলেছে অবনী। মেনে নিয়েছে মৃদুলা আলাদা ধাতের। তার মনের কাচে সহজে কেউ দাগ কাটতে পারবে না।

ছোট্ট জীবনে হাতেগোনা কয়েকজন মানুষের সঙ্গে একজনের বন্ধুত্ব হয়। কারও কারও ক্ষেত্রে সংখ্যাটা অত্যন্ত নগণ্য। আবার কারও ক্ষেত্রে আশাব্যঞ্জক। মৃদুলা দ্বিতীয় দলে, তার বন্ধু ভাগ্য ভালো। জীবনকে রাঙিয়ে দেওয়ার মতো কয়েকজন বন্ধু পেয়েছে। তাঁদের একজন অবনী। স্কুলজীবনের বন্ধু, তাঁকে খুব ভরসা করে মৃদুলা। যতটা বলা যায়, দুঃখ-ব্যথার কথা খুলে বলে। মনে আছে, কোর্ট-টাই পরা শিক্ষিত বাবা মায়ের গায়ে প্রথম যেদিন হাত তুলেছিল, মা শব্দ করে কাঁদেনি, চিৎকার করেনি। শুধু তাকে জড়িয়ে ধরে বলেছিল, ‘সোনা মা আমার, এ কথা কাউকে যেন বলো না। দাদু-ঠাকুমা, বাড়ির কেউ জানলে বাবার অসম্মান হবে, সবার সামনে আমরা ছোট হয়ে যাব।’ তখন নবম শ্রেণিতে পড়ে মৃদুলা। মায়ের কথামতো বাড়ির কাউকে কথাটা না বললেও বুকের ভার নামাতে স্কুল শেষে বাড়ি ফেরার পথে অবনীকে জড়িয়ে ধরে কথাটা বলেছিল সে।

সব বন্ধুবৃত্তেই দু–একজন বুঝদার বন্ধু থাকে। দাদুর ভাষ্যে, যে মানুষদের আত্মা বড় হয়, তারা খুব কম বয়স থেকেই জীবনকে উপলব্ধি করতে শিখে যায়। বিরূপ পরিস্থিতিতেও আসল-নকল মানুষ চিনতে পারে। তাদের আবেগ, অনুভূতি, কৃতজ্ঞতা প্রকাশের বোধ খুব প্রবল হয়। মৃদুলার প্রায়ই মনে হয়, অবনী তাদের একজন। কত জ্ঞান অবনীর, কী চমৎকার ভাবতে পারে। তাই বন্ধুর চেয়েও অবনীকে বেশি অভিভাবক ও মেন্টর মনে করে মৃদুলা। এই মনে করার শুরুটা ওই দিন থেকে, যেদিন মায়ের গায়ে হাত তোলার ঘটনাটা অবনীকে বলেছে সে। অবনী প্রত্যুত্তরে জিজ্ঞেস করেছিল, ‘তোর বাবা কি প্রায়ই এমন করে, নাকি আজই প্রথম।’ ‘না, আজই প্রথম’। মৃদুলার জবাব শুনে অবনী বলেছিল, ‘তাহলে বাবাকে ভুল বুঝিস না। কত রকম ঝামেলা থাকে জীবনে। মা-বাবার ঝামেলা মা-বাবা মিটিয়ে নেবে দেখিস।’ সেদিন কিন্তু ভুল বলেনি সে।

ওই ঘটনার পর অনেক বছর কেটে গেছে। গায়ে হাত তোলা তো দূরে থাকুক, বাবাকে কখনো মায়ের সঙ্গে গলা তুলে কথা বলতেও শোনেনি মৃদুলা। তাই অভিজিৎ প্রসঙ্গে অবনী যেদিন বলল, ‘কণ্ঠের মতো এই ছেলের চোখেও জাদু আছে। তোর সঙ্গে নিশ্চিত প্রেম হবে। তুই প্রস্তুত থাক।’ সেদিনই নিজেকে লুকিয়ে নিয়েছে মৃদুলা। তার কাছে ‘ভালোবাসা’ নিছকই একটি শব্দ নয়। ‘ভালোবাসা’ পৃথিবীর মতো বিশাল, সমুদ্রের মতো প্রবহমান। ঠিক প্রাচীরের মতো। প্রতিবন্ধক যেমন সম্পদের নিরাপত্তা দেয়। ভালোবাসাও তেমনি সম্পর্ক তথা সামগ্রিক জীবনের নিরাপত্তা দেয়। অথচ বর্তমানের অধিকাংশ ভালোবাসা মেসেঞ্জারে শুরু হয়ে মেসেঞ্জারেই শেষ হয়ে যায়। তাই মৃদুলা ভুল করেও অভিজিতের চোখের দিকে তাকায় না, কাছাকাছি যায় না। কিন্তু আজকের পরিস্থিতি ভিন্ন, দুই হাতে দাদুকে অভিজিতের কলার ধরে থাকতে দেখে মৃদুলা বিস্মিত। কেন এসেছে অভিজিৎ; আর দাদুই বা কেন কলার ধরে আছে? বিস্ময় আড়াল করে নিজের মনে প্রশ্ন করে সে।

সাংগঠনিক সম্পাদক, যশোর বন্ধুসভা