মেঘবালিকা

অলংকরণ: মাসুক হেলাল
আমি অবশ্য তেমন প্রকৃতিপ্রেমী নই। তবু ওর ভালো লাগাগুলোকে নিজের ভালো লাগায় পরিণত করতে চেয়েছি কেবল ওকে বোঝার প্রয়াসে।

প্রকৃতির সঙ্গে নিবিড় সখ্য গড়ে উঠুক—এ কথাটা প্রায়ই বলে মোহিনী। আমি তখন হাসি চেপে বলি, ‘আমি ভালোবেসেছিলাম বলেই মরে গেছি। কাজল কালো চোখ জোড়ায় একবার তাকিয়েছিলাম বলে প্রকৃতির অন্য কিছুর সঙ্গে আর সখ্য গড়ে ওঠেনি।’

আমার এমন বেখাপ্পা কথায় সে মুচকি হেসে চোখ সরিয়ে নেয়। এরপর জানালার বাইরে তাকিয়ে থাকে, যেখানে মেঘ জমে আছে নিশ্চল আকাশের ধূসর ক্যানভাসে।

মোহিনীর পছন্দের তালিকায় বৃষ্টি আর সমুদ্র শীর্ষে। এসব নিয়ে কথা বলতে গেলে তার চোখের উচ্ছ্বসিত আলো ঢেউ খেলে যায়।
আমি অবশ্য তেমন প্রকৃতিপ্রেমী নই। তবু ওর ভালো লাগাগুলোকে নিজের ভালো লাগায় পরিণত করতে চেয়েছি কেবল ওকে বোঝার প্রয়াসে। কিন্তু মোহিনীকে বোঝা সহজ নয়। সে এক রহস্যময় নদী; চলতে চলতে কখন কোথায় বাঁক নেয় তা বোঝার সাধ্য কারও নেই। তবু যেন অলক্ষ্যে আমার হৃদ্‌–আকাশে সে অপ্সরা হয়ে বিচরণ করে সর্বক্ষণ।

পান থেকে চুন খসলেই রাগে তেতে ওঠে। তবু ওর একটা জায়গায় খুব আটকে যাই, সেটা হলো—ওর গানের গলা। গান ধরলে পৃথিবী থেমে যায় শুনতে; যেন সুরের দেবতা আশীর্বাদে তুষ্ট করেছেন নিজ হাতে। সুধাময়ী কণ্ঠে হৃদয় নিংড়ানো সুরে ডুবে এক নতুন মোহিনীকে আবিষ্কার করি আমি। বিগত কিছুই মনে রাখার চেষ্টা করি না, বিস্মৃতের মতো ভুলে যাই। তার হাসির রেখায় উড়িয়ে দিই সবকিছু।

আমাদের সম্পর্ক ভাঙা-গড়ার দোলাচলে জোড়া লেগেছে বহুবার। তবু কোথাও যেন এক অনামা দূরত্ব থেকে গেছে। একদিন বৃষ্টিভেজা দুপুরে অনুরক্ত হয়ে আমি বলেছিলাম, ‘চলো, আজ দুজন দুজনার হাত ধরে শহরের অচেনা রাস্তায় হারিয়ে যাই। ঝুম বৃষ্টিতে ভিজব দুজন একসা হয়ে।’
সে একটু হাসল, কিছু বলল না।

কিছুক্ষণের মধ্যেই ছাদে গিয়ে ভিজতে শুরু করল। আমি চিলেকোঠার ছোট্ট জানালাটার পাশে দাঁড়িয়ে দেখলাম, সে দুহাত মেলে খোলা চুল ভিজিয়ে নিচ্ছে, বৃষ্টি ছুঁয়ে দেখছে আর হাসছে।

আরও পড়ুন

মোহিনীর পছন্দ বৃষ্টি, আর আমার পছন্দ মোহিনী। মেঘের তলায় দাঁড়িয়ে মনে হলো, আমি যেন তার ভালোবাসার নাগাল পাইনি কোনো দিন, শুধু ছায়ার মতো পাশে থেকেছি আজীবন।

চাপা ক্ষোভ আর অভিমানে মনে হলো, যদি বৃষ্টি হয়ে জন্মাতাম! নির্দ্বিধায় কেউ না কেউ সুখানুভবের সঙ্গে গায়ে মাখত। বৃষ্টিরূপী আমিও চুলের আলতো স্পর্শে শিরশির করে গড়িয়ে পড়তাম পিঠ বেয়ে। তখন হয়তো মোহিনীর গায়ে মিশে থাকতাম, চুলের ফাঁকে গড়িয়ে পড়তাম, আর চোখের কাজল ধুয়ে দিতাম স্নিগ্ধ ধারায়।
আবার ভাবি, যদি অন্তত কাজল হয়ে জন্মাতাম! তাহলে সে হয়তো সযত্নে চোখে মেখে রাখত, তার ঘন কালো পল্লবের কোণে সারাক্ষণ লেপ্টে থাকতাম গভীর আশ্লেষে। কিন্তু না, প্রকৃতি আমাকে মানুষরূপেই পাঠিয়েছে, এক নিঃসঙ্গ, নির্জন মানুষ হিসেবে। আশপাশে মানুষে ভরপুর, তবু যেন আমি একা।

তবু আজন্ম এক শখ আমার থেকে গেছে, যদি কোনো দিন সমুদ্র হয়ে জন্ম নিই! তখন হয়তো কোনো এক বিষণ্ন বিকেলে মোহিনীর মন খারাপ হলে সে যাবে সমুদ্রের পাড়ে। আর আমি—আমার ঢেউয়ের শব্দে তাকে আলতো করে জড়িয়ে ধরব। তখনই ঘটবে দুঃখের সঙ্গে প্রচ্ছন্ন দুঃখের সাক্ষাৎ।

মোহিনী হয়তো বুঝবে, আমি শুধু ভালোবেসেছিলাম বলেই মরে গেছি। তবু আমি আছি—প্রতিটি বৃষ্টিধারায়, আনমনে গুনা জোয়ারের প্রতিটি ঢেউয়ে এবং তার ভালোবাসার ছায়ায়।

শিক্ষার্থী, চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয়