হুমায়ূন আহমেদ যেভাবে জীবনকে ভালোবাসতে শিখিয়েছেন

হুমায়ূন আহমেদ (৩ নভেম্বর ১৯৪৮—১৯ জুলাই ২০১২)ছবি: নাসির আলী মামুন, ফটোজিয়াম
ঘুম আসছিল না। কৌতূহল মেটাতে আবার বইটি হাতে নিলাম। একটানা প্রায় ২০ পৃষ্ঠা পড়ে ফেললাম।

দশম শ্রেণিতে পড়ার সময় হুমায়ূন আহমেদ সম্পর্কে জানি। তখন তিনি বেঁচে ছিলেন। তবে তাঁর লেখার সঙ্গে সখ্য বাড়ে ওনার মৃত্যুর পর। ২০১৬ সাল অনার্সে পড়ি। শখের বশে বই পড়তে উৎসুক হলাম। ভৈরব বইমেলা থেকে কিনেছিলাম তাঁর লেখা একটি বই। শীতের রাত যত বাড়ে, নীরবতা তত বাড়ে। রাত ১২টার পর ‘যখন গিয়েছে ডুবে পঞ্চমীর চাঁদ’ বইটি শেলফ থেকে নামিয়ে পড়তে বসি। সবাই ঘুমিয়ে গেছে, চারদিক যেন অদ্ভুত নীরবতা বিরাজ করছে তখন।

গা ছমছমে লেখা, কিছুক্ষণ পরপর অজানা শঙ্কায় হৃদয় কেঁপে উঠছে। গল্পের শুরুতেই বুঝে যাই মিজান সাহেব নামের লোকটা তার বউকে মারার পরিকল্পনা করছে। পড়তে পড়তে ভয় পেয়ে বইটা টেবিলে রেখে বাতি নিভিয়ে লেপ মুড়ি দিলাম।

যদিও ভৌতিক নাটক দেখতে বেশ পছন্দ করি; কিন্তু এই বই পড়ে মনে হলো, আমার চোখের সামনে ঘটছে, আর সব আমি দেখছি। টিভি নাটক কিংবা ভৌতিক সিনেমা দেখে রোমাঞ্চিত হলে তা মনে দাগ কাটে না। তবে এই বই যেন আমার কল্পনার জগৎ নিয়ে খেলছে। চোখ বন্ধ করলেও চোখে ভাসছে গল্পের দৃশ্যপট। ‘আচ্ছা, রুবাকে কেন মারবে? কী হবে তারপর?’

ঘুম আসছিল না। কৌতূহল মেটাতে আবার বইটি হাতে নিলাম। একটানা প্রায় ২০ পৃষ্ঠা পড়ে ফেললাম। মিজান তার বউকে হত্যা করে কী সুন্দর দাওয়াত খেতে গেল, আবার স্বাভাবিকভাবে ফিরে এল। আবার কী ভয়ংকর ব্যাপার, ‘মৃত রুবা শ্বাস ফেলছে, কালো জিব বের করে পানি খেতে চাইছে।’

এটা কি মিজানের কল্পনা? নাকি সত্যিই এমন কিছু ঘটছে। দ্বিধায় পড়ে যাই। কিছুক্ষণ বিরতি নিয়ে পুনরায় বইটি পড়া শুরু করি। এবার একটানে বইটি শেষ করে ফেলি। শেষ দৃশ্যের গভীরতা মনে দাগ কাটে। বই পড়ার আনন্দ অবগাহন করি। তখন থেকেই হুমায়ূন স্যার আমাকে মুদ্রিত বই পড়তে বাধ্য করলেন। ভৈরব বন্ধুসভায় যুক্ত হওয়ার পর পাঠচক্রের কারণে পড়া হয় অসংখ্য লেখকের বই।

একদিন ঘর গোছাতে গিয়ে খুঁজে পাই ‘নয় নম্বর বিপদ সংকেত’ সিনেমার সিডি। সিডির ওপরে লেখা হুমায়ূন আহমেদের নাম ও ছবিতে চোখ আটকে যায়। সিনেমাটি আমি দেখেছিলাম ২০০৭ সালে তৃতীয় শ্রেণিতে পড়ার সময়। তার মানে হুমায়ূন আহমেদকে আমি তখন থেকেই চিনি! সিডি-ক্যাসেটের যুগ। ‘নয় নম্বর বিপদ সংকেত’ আমার দেখা এখন পর্যন্ত বাংলা চলচ্চিত্রজগতে সবচেয়ে মজার, আবেগের ও অপরূপ দৃশ্যের এক চিত্র।

আচ্ছা মিসির আলি হুমায়ূন আহমেদ নন তো? প্রশ্ন থেকেই যায় মনে। একজন লেখক এতগুলো চরিত্রের মধ্যে বাস করেন কীভাবে?

এখন ইউটিউবে হুমায়ূন আহমেদের টেলিফিল্ম ও নাটক দেখি। যত দিনে এই নন্দিত কথাসাহিত্যিককে চিনলাম, তখন তিনি আর পৃথিবীতে নেই। ‘নন্দিত নরকে’ দেখেছি আর অজান্তে চোখের পানি ফেলেছি। ‘দ্বারুচিনি দ্বীপ’ আবেগ মেশানো এক অনন্য সৃষ্টি তরুণদের জন্য। ‘দূর–দ্বীপ–বাসিনী’ গানটি আমাকে সমুদ্রে নিয়ে যায়। ‘দারুচিনি দ্বীপ’ সিনেমা আমাকে সমুদ্রের প্রতি প্রেম সৃষ্টি করায়।

হুমায়ূন আহমেদকে আরও জানতে ইচ্ছা করে, বুঝতে ইচ্ছা করে। দেখা শুরু করি তাঁর লেখা নাটকগুলো, লেখায় খুঁজে পাই জীবনবোধের ছাপ। প্রতিটি চরিত্র যেন আমাদের চেনা। মধ্যবিত্ত জীবনের ছোট আশা, বিবর্ণ করুণ চিত্রকে বর্ণাঢ্য ও নাটকীয় করেছেন চমৎকারভাবে। কী বিস্ময়কর!

হুমায়ূন আহমেদের অনবদ্য সৃষ্ট চরিত্র, আমি যাকে পছন্দ করি ‘মিসির আলি’ রহস্য উন্মোচনে যুক্তিবাদী এক জাদুর বাক্স যেন। আরও আছে হিমু, বাকের ভাই, শুভ্র। আচ্ছা মিসির আলি হুমায়ূন আহমেদ নন তো? প্রশ্ন থেকেই যায় মনে। একজন লেখক এতগুলো চরিত্রের মধ্যে বাস করেন কীভাবে?

হুমায়ূন আহমেদের বই পছন্দ করে না—এমন মানুষ নেই বললেই চলে। আমিও বেশ আগ্রহ নিয়ে তাঁর বই পড়ি। কিন্তু তাঁর লেখা গান অসম্ভব ভালো লাগার। সন্ধ্যায় হালকা শব্দে ‘আমার ভাঙা ঘরে, ভাঙা চালা, ভাঙা বেড়ার ফাঁকে অবাক জোছনা ঢুইকা পড়ে হাত বাড়াইয়া ডাকে, হাত ইশারায় ডাকি কিন্তু মুখে বলি না...’ হৃৎস্পন্দন বেড়ে যায় দুঃখবোধের এই গানটি শুনলে। পরক্ষণেই মনে হয় শুনছি দুঃখের গান, কিন্তু অনুভব করছি শান্তি। ইশ্‌! অবাক জোছনা আমার হাতে ধরা দেয় না।

‘যদি মন কাঁদে তুমি চলে এসো এক বরষায়’—কীভাবে সম্ভব এত মধুর করে ডেকে বর্ষায় ভিজিয়ে সব কষ্ট ধুয়ে-মুছে নিয়ে যেতে পারে গানের মাধ্যমে?
রাতের আকাশে যখন চাঁদটি ভরা জোছনায় আলোকিত করে চারপাশ, তখন মনের অজান্তেই গেয়ে উঠি ‘চাঁদনি পসরে কে আমার স্মরণ করে/ কে আইসা দাঁড়াইছে গো আমার দুয়ারে।’  

বৃষ্টিবিলাস, বর্ষার কদম, একা চাঁদের সৌন্দর্য অবলোকন, চোখের কাজল, কপালের টিপ, নীল শাড়ি, নীল চুড়িকে যেন বাংলা সাহিত্যে সূক্ষ্ম রূপ দিয়েছেন গল্পের এই জাদুকর।

হুমায়ূন আহমেদ, কেন আপনি আমাদের ছেড়ে গেলেন, কেন আরও কয়েকটি বছর আমাদের মধ্যে বেঁচে থাকলেন না? তাহলে আরও কিছু অমর চরিত্র, কালজয়ী কিছু লেখা পেত পাঠক। তিনি শিখিয়েছেন অশ্লীলতা ছাড়াও ভালো সিনেমা বানানো যায়। সৃষ্টি করেছেন হাজার হাজার পাঠক। আমাদের ভালোবাসতে শিখিয়েছেন বৃক্ষকে, বিশাল সমুদ্রপরিমাণ ছাপা শব্দ, কথা, ছবি, উপলব্ধি। আপনিই বলেছিলেন, মানুষ মরে গেলে তার কিছু থাকে না—শুধু কিছু ভালোবাসা থেকে যায়, আর থেকে যায় কিছু ভুল। আপনার সব সৃষ্টকর্ম পাঠক ও দর্শকদের কাছে ভালোবাসার ফুল হয়ে সুবাস ছড়াবে হাজার হাজার বছর।

বন্ধু, ভৈরব বন্ধুসভা