জ্যাক ক্যালিস—ক্রিকেটবিশ্বে পূর্ণতার প্রতিশব্দ

দক্ষিণ আফ্রিকার কিংবদন্তি অলরাউন্ডার জ্যাক ক্যালিসফাইল ছবি: এএফপি

জ্যাক হেনরি ক্যালিস নামটি কেবল একজন ক্রিকেটারের পরিচয় নয়, এটি ক্রিকেটবিশ্বে পূর্ণতার প্রতিশব্দ। দক্ষিণ আফ্রিকার এই কিংবদন্তি অলরাউন্ডার যেন নীরবতায় এঁকে গেছেন এক সুবিশাল মহাকাব্য। তাঁর মধ্যে ছিল না অতিরিক্ত আবেগ, আগ্রাসী প্রদর্শন—ছিল কেবল এক অনন্য স্থিরতা। তিনি ছিলেন ক্রিকেটের সেই সুপ্রাচীন বটগাছ, যার ছায়ায় পুরো দল পেত আশ্রয় ও আস্থা।

ক্যালিসের ব্যাটিং ছিল ধ্রুপদি সংগীতের মতো নিখুঁত, দুর্ভেদ্য প্রাচীরের মতো দৃঢ়। উইকেটে দাঁড়ালে মনে হতো তিনি যেন ধ্যানমগ্ন ঋষি, যিনি জানেন কীভাবে বোলারদের প্রতিটি অস্ত্র নিষ্ক্রিয় করতে হয়। তাঁর ব্যাট থেকে রান আসত ফলন্ত বৃক্ষের মতো—নীরবে, নিয়মিতভাবে, সৌন্দর্যে লাবণ্যময়।

আরও পড়ুন

টেস্টে ১৩,২৮৯ ও ওয়ানডেতে ১১,৫৭৯ রান—সংখ্যাগুলো প্রমাণ করে ক্যালিস ছিলেন দীর্ঘ দৌড়ের অদম্য ঘোড়া। বিশ্বের কঠিনতম পিচেও তাঁর ব্যাট থেকে আলো ছড়িয়েছে। অস্ট্রেলিয়ার সিডনি ক্রিকেট গ্রাউন্ডে তাঁর ব্যাটিং গড় প্রায় ৭০-এর কাছাকাছি, আর নিজ দেশের নিউল্যান্ডসে তিনি যেন নিজের হাতে আঁকা ক্যানভাসে ইতিহাস লিখেছেন। বিদায়ী ইনিংসেও সেই গৌরবের ছোঁয়া ছিল স্পষ্ট।

বল হাতে ছিলেন শীতল-মাথার শিকারি; সুইং ও সিমের সূক্ষ্ম জাদুতে ক্যালিস বিশ্বের বাঘা ব্যাটসম্যানদের বারবার ফাঁদে ফেলেছেন। টেস্টে ২৯২ ও ওয়ানডেতে ২৭৩ উইকেট—এই সংখ্যাগুলো তাঁর অলরাউন্ড শ্রেষ্ঠত্বের জীবন্ত সাক্ষ্য।

তিন ফরম্যাট মিলিয়ে ক্যালিসের মোট রান ২৫,৫০০-এর বেশি, উইকেট ৫৭৭ এবং ক্যাচ শতাধিক; ক্রিকেট ইতিহাসে এই কীর্তি একমাত্র তাঁর। তিনি ছিলেন এমন একজন, যিনি কখনো দলের বোঝা হননি; বরং যেটি দরকার, সেটিই ঠিক সময়ে উজাড় করে দিয়েছেন।

বিদায়ী টেস্টে ভারতের বিপক্ষে মাঠে নামছেন জ্যাক ক্যালিস।

অলরাউন্ড কীর্তির উজ্জ্বল অধ্যায়, ১৯৯৮ সালে ক্যালিসের হাত ধরেই দক্ষিণ আফ্রিকা প্রথমবারের মতো জেতে আইসিসি চ্যাম্পিয়নস ট্রফি, যেখানে তিনি নির্বাচিত হন টুর্নামেন্টের সেরা খেলোয়াড়। আবার ২০০৫ সালের ডারবানের কিংসমিডে শ্রীলঙ্কার বিপক্ষে তাঁর দ্বিশতক (২০৩ রান) ও পাঁচ উইকেট নেওয়ার কীর্তি ক্রিকেট ইতিহাসে অমর হয়ে আছে।

অ্যাডিলেড টেস্টের (২০১২) কথা আলাদা করে বলতেই হয়— ইনজুরিতে কাতর ক্যালিস নেমেছিলেন ৯ নম্বরে ব্যাট করতে, দল তখন প্রায় হারের মুখে। কিন্তু ব্যথা সহ্য করে ৫৮ রানের এক অমূল্য ইনিংস খেলেন ফাফ ডু প্লেসির সঙ্গে, যা দক্ষিণ আফ্রিকাকে রক্ষা করে ফলোঅন থেকে। সেটিই ছিল তাঁর মানসিক দৃঢ়তা ও দলের প্রতি নিঃশর্ত ভালোবাসার চূড়ান্ত উদাহরণ।

জ্যাক ক্যালিস।

১৯৯৫ সালের ১৪ ডিসেম্বর ইংল্যান্ডের বিপক্ষে ডারবানে অভিষেকের পর থেকে শুরু হয় ক্যালিসের দীর্ঘ ১৮ বছরের পথচলা। ২০১৩ সালে বিদায়ী টেস্টে ভারতের বিপক্ষে তিনি শতরান করে (১১৫) প্রমাণ করে যান—স্থিরতা, নিষ্ঠা ও পরিপূর্ণতা কখনো ম্লান হয় না।

জ্যাক ক্যালিস কখনো প্রচারের আলো চাননি। তিনি ছিলেন নীরব কারিগর। যিনি শুধুই কাজ দিয়ে নিজের পরিচয় গড়েছেন। দুই দশকের এই মহাযাত্রা প্রমাণ করে, ক্রিকেটে ধারাবাহিকতা, অধ্যবসায় ও আত্মনিবেদনই প্রকৃত পরিপূর্ণতার পথ।

তিনি চিরকাল ক্রিকেট ইতিহাসে স্থিরতা, নির্ভরতা ও নীরব মহিমার এক উজ্জ্বল দৃষ্টান্ত হয়ে থাকবেন—২৫ হাজারি ক্লাবের একমাত্র সদস্য, জ্যাক হেনরি ক্যালিস।

লেখক: কর্মকর্তা, ভূমি মন্ত্রণালয়