দ্য ফিজ—এক অজেয় ক্রিকেটীয় কাব্য

মোস্তাফিজের ক্রিকেট ক্যারিয়ারে অসংখ্য সাফল্য রয়েছে, যা তাঁকে এক অনন্য উচ্চতায় নিয়ে গেছেএসিসি

ক্রিকেটের ২২ গজে এমন কিছু মুহূর্ত আসে, যা কেবল ম্যাচের ফলাফল নয়, বরং এক নতুন গল্পের জন্ম দেয়। বাংলাদেশ ক্রিকেটে সেই গল্পের এক নিভৃতচারী নায়ক মোস্তাফিজুর রহমান। তাঁর মুখে হয়তো বাগ্মিতার জোয়ার থাকে না, কিন্তু হাতে ধরা বলটি কথা বলে। সেই কথার সৌন্দর্য কাটারের ভাষায়, স্লোয়ারের ইশারায় আর নিখুঁত ইয়র্কারের ছন্দে ছড়িয়ে পড়ে। তিনি নীরব কবি, যাঁর প্রতিটি ডেলিভারিই একেকটি কাব্য।

মোস্তাফিজের আগমন ও উত্থান এক স্বপ্নের উন্মোচন। ২০১৫ সালের সেই গ্রীষ্মের দুপুর, যখন বাংলাদেশের ক্রিকেট দিগন্তে নতুন সূর্যের আগমন ঘটে। প্রতিপক্ষ ভারত, আর মঞ্চে এক তরুণ, যাঁর হাতে এক জাদুকরী কাটার। সিরিজের প্রথম দুই ওয়ানডেতেই ১১ উইকেট শিকার করে বিশ্বকে চমকে দেন, যা ক্রিকেটের ইতিহাসে এক অনন্য রেকর্ড। তাঁর কাটার এতটাই রহস্যময় ছিল যে ভারতের মতো শক্তিশালী ব্যাটিং লাইনআপ দিশাহারা হয়ে পড়ে। সেই সিরিজেই তিনি রাতারাতি ‘দ্য ফিজ’ উপাধি লাভ করেন এবং বিশ্বকে জানান দেন, বাংলার ক্রিকেটে এক নতুন রূপকথার জন্ম হয়েছে।

উইকেট নেওয়ার পর মোস্তাফিজুর রহমান
শামসুল হক

মোস্তাফিজুর রহমান বাংলাদেশ ক্রিকেটের এক গুরুত্বপূর্ণ স্তম্ভ। তাঁর পারফরম্যান্স বহুবার দলকে জয় এনে দিয়েছে এবং আন্তর্জাতিক ক্রিকেটে বাংলাদেশের ভাবমূর্তি উজ্জ্বল করেছে। তাঁর একক অবদানেই ২০১৫ সালে ভারতের বিপক্ষে ঐতিহাসিক সিরিজ জয় পায় বাংলাদেশ। ২০১৮ সালের এশিয়া কাপে পাকিস্তানের বিপক্ষে তাঁর অসাধারণ বোলিং দলকে ফাইনালে নিয়ে গিয়েছিল। গুরুত্বপূর্ণ সময়ে তাঁর উইকেট শিকারের ক্ষমতা দলের জন্য এক বড় আশীর্বাদ।

বিশ্বকাপের মতো বড় মঞ্চেও মোস্তাফিজ শ্রেষ্ঠত্ব প্রমাণ করেছেন। ২০১৯ বিশ্বকাপে মাত্র ৮ ম্যাচে ২০ উইকেট নিয়ে টুর্নামেন্টের চতুর্থ সর্বোচ্চ উইকেট শিকারি হন। তাঁর এই পারফরম্যান্স আন্তর্জাতিক মঞ্চে বাংলাদেশের সামর্থ্য প্রমাণ করে। তিনি বহুবার এমন পরিস্থিতিতে বল হাতে এসেছেন, যখন জয়ের আশা প্রায় শেষ হয়ে গিয়েছিল। তাঁর স্লোয়ার, কাটার ও ইয়র্কারের দারুণ মিশ্রণ প্রতিপক্ষকে শেষ মুহূর্তে বিভ্রান্ত করে দেয় আর দলকে এনে দেয় বহু প্রত্যাশিত জয়।

মোস্তাফিজের ক্রিকেট ক্যারিয়ারে অসংখ্য সাফল্য রয়েছে, যা তাঁকে এক অনন্য উচ্চতায় নিয়ে গেছে। অভিষেকের পরপরই তিনি মর্যাদাপূর্ণ আইসিসি ইমার্জিং প্লেয়ার অব দ্য ইয়ার (২০১৫) পুরস্কার জিতে নেন। ২০১৬ সালে সানরাইজার্স হায়দরাবাদের হয়ে আইপিএল শিরোপা জেতেন এবং সেরা উদীয়মান খেলোয়াড় নির্বাচিত হন।

আরও পড়ুন

একজন শিল্পীর জীবনে যেমন বিরতি থাকে, তেমনি মোস্তাফিজের ক্যারিয়ারেও নেমে এসেছিল ইনজুরির কালো ছায়া। কাঁধের ব্যথা, গোড়ালির যন্ত্রণা বারবার তাঁকে মাঠের সবুজ ক্যানভাস থেকে দূরে সরিয়ে দিয়েছে। কিন্তু তিনি ভেঙে পড়েননি। প্রতিটি আঘাত থেকে ফিরে এসেছেন আরও অভিজ্ঞ ও শক্তিশালী হয়ে। তাঁর নীরবতার গভীরে লুকিয়ে আছে সেই দৃঢ়তা, যা বারবার লড়াই করার প্রেরণা দিয়েছে। ইনজুরিকে গল্পের একটি অংশ বানিয়েছেন, যার শেষে রয়েছে বীরত্বপূর্ণ প্রত্যাবর্তন।

সাতক্ষীরার প্রত্যন্ত গ্রাম থেকে উঠে আসা এই তরুণ আজ কোটি মানুষের অনুপ্রেরণা। তিনি প্রমাণ করেছেন, মেধা আর পরিশ্রমের সমীকরণে যেকোনো স্বপ্নই সত্যি হতে পারে। মোস্তাফিজ শুধু একজন বোলার নন, তিনি আমাদের ক্রিকেট রূপকথার এক নীরব কবি। তাঁর প্রতিটি ডেলিভারিতে মিশে আছে স্বপ্ন, প্রতিটি সাফল্যে মিশে আছে বাংলার মানুষের ভালোবাসা।

আজও যখন ২২ গজে মোস্তাফিজের হাত ঘুরে বল আসে, ক্রিকেটপ্রেমীরা এক নতুন রোমাঞ্চ অনুভব করেন। তাঁর কাটার, হাসি, নীরবতা—সব মিলিয়েই তিনি আমাদের ‘ফিজ’, এক অজেয় ক্রিকেটীয় কাব্য।

লেখক: কর্মকর্তা, ভূমি মন্ত্রণালয়