বিশ্বকাপ জয়ের নায়ক কেন উপেক্ষিত

যুব বিশ্বকাপ ফাইনালে ৭৭ বলে ৪৩ করে বাংলাদেশকে জিতিয়েছিলেন আকবর আলী। ফাইল ছবি

কোথাও যেন নীরবতা খেলা করে। এক সুর, যা বেজেও বাজে না। আকবর আলী—নামটি শুনলেই কানে আসে এক বিজয়গাথা, অনূর্ধ্ব-১৯ বিশ্বকাপ জয়ের অবিস্মরণীয় দিন। ২০২০ সালের সেই শীতের রাতে, তাঁর হাত ধরেই প্রথম বিশ্বমঞ্চে বাংলাদেশের পতাকা উঁচুতে উঠেছিল, ট্রফির ভারে। সেটি কেবল এক জয় নয়, কোটি স্বপ্নের এক বসন্ত।

২২ গজের ক্যানভাসে তাঁর ব্যাট কথা বলে স্থিতধীরতায়, উইকেটের পেছনে তাঁর গ্লাভস যেন দুর্ভেদ্য প্রাচীর। ভারতের বিপক্ষে অনূর্ধ্ব-১৯ বিশ্বকাপ ফাইনালের সেই চাপের মুহূর্তে তাঁর ইস্পাতকঠিন স্নায়ু আর অপরাজিত ৪৩ রানের ইনিংস ছিল নেতৃত্বের এক নীরব কবিতা।

ঘরোয়া ক্রিকেটে অপ্রতিরোধ্য স্বাক্ষর
আজ আকবরকে দেখলে মনে হয়, সে যেন ইতিহাসের এক উজ্জ্বল উদ্ধৃতি, যা সময়ের ধুলোয় একটু ম্লান। কিন্তু এই ম্লানতার আড়ালে চাপা পড়ে আছে ঘরোয়া ক্রিকেটের জ্বলন্ত পরিসংখ্যান এবং তাঁর একক দক্ষতায় ম্যাচ জেতানোর অসংখ্য গল্প। লিস্ট ‘এ’ ক্রিকেট (ওয়ানডে ফরম্যাট) কিংবা টি-টোয়েন্টি, যেখানেই তিনি নামছেন, হয়ে উঠছেন দলের মেরুদণ্ড। লোয়ার-মিডল অর্ডারে একজন ফিনিশার হিসেবে তাঁর ভূমিকা প্রায়ই দেখা যায়।

জাতীয় লিগে শতক করার পর আকবর আলী
ছবি: সংগৃহীত

সম্প্রতি বাংলাদেশ ইমার্জিং দলের হয়ে দক্ষিণ আফ্রিকা ইমার্জিং দলের বিপক্ষে তাঁর ব্যাটিং ছিল এক মহাকাব্য। ৩৩২ রানের বিশাল লক্ষ্য তাড়া করতে নেমে তিনি একাই খেলেছিলেন ১১০ বলে ১৩১ রানের এক অসাধারণ ইনিংস (১৪ চার, ২ ছয়)। যদিও সেই ম্যাচে দল জেতেনি, তবু তাঁর এই ইনিংস প্রমাণ করে—চাপের মুখে তিনি একাই ম্যাচের রং বদলে দেওয়ার ক্ষমতা রাখেন।

লিস্ট ‘এ’ ক্রিকেটে প্রায়ই দলের কঠিন মুহূর্তে তাঁর ব্যাট থেকে আসে ঝোড়ো গতিতে রান। যেমন, ৩০০ রানের বেশি তাড়া করে বাংলাদেশ ইমার্জিং দলের এক ঐতিহাসিক জয়ে তাঁর অবদান ছিল। মাত্র ২৪ বলে ৪১ রানের এক বিধ্বংসী ইনিংস, যা জয়ের ভিত গড়ে দিয়েছিল। প্রথম শ্রেণির ক্রিকেটেও তাঁর ধৈর্য অসাধারণ। জাতীয় ক্রিকেট লিগে (এনসিএল) তাঁর প্রথম শতক ছিল ১৬২ রানের অপরাজিত ইনিংস, যা দলের ইনিংসকে মজবুত ভিত্তি দিয়েছিল।

তাঁর ব্যাটিং এভারেজ প্রায়ই দলের অন্যতম সেরা থাকে। টি-টোয়েন্টি ফরম্যাটে তাঁর ছক্কা হাঁকানোর প্রবণতা প্রমাণ করে তিনি শুধু একজন স্থিতধীর ব্যাটসম্যান নন, একজন আধুনিক ক্রিকেটারের সব গুণই তাঁর মধ্যে বর্তমান। বহুবার অল্প রানেই গুরুত্বপূর্ণ ম্যাচ জিতিয়েছেন, যেমন রংপুর বিভাগের হয়ে ৯০ রানের সহজ লক্ষ্যও মাত্র ১১ ওভারে পার করে দিয়ে নেট রানরেটকে সুবিধাজনক স্থানে নিয়ে এসেছেন।

আরও পড়ুন
সেঞ্চুরির পর আকবর আলী
বিসিবি

তবু কেন এই বঞ্চনা? কেন এই উপেক্ষা? কেন তাঁর প্রাপ্য রাজপথ আজ এতটা সংকীর্ণ? যে যোগ্যতা তাঁকে বিশ্বজয়ীর আসনে বসাল, সেই একই যোগ্যতা কি তবে দেশের ক্রিকেটের দরবারে উপেক্ষিত? প্রশ্ন জাগে, কেন প্রতিভার এমন অমর্যাদা? কেন একজন নির্ভরযোগ্য উইকেটরক্ষক-ব্যাটসম্যানের নামটি জাতীয় দলের আলোচনায় এত ক্ষীণ? তিনি যেন এক নীরব সাধক, যাঁর তপস্যা পূর্ণ ফল দিতে পারেনি। হয়তো নির্বাচকদের খাতায় তাঁর পরিসংখ্যানের চেয়েও ভারী অন্য কোনো হিসাব! হয়তো ভাগ্যদেবী তাঁর কপালে লিখে রেখেছেন দীর্ঘ অপেক্ষার কঠিন পরীক্ষা।

ক্রিকেট হলো এক অনিশ্চিত খেলা, আর আকবর আলী যেন সেই অনিশ্চয়তার এক মূর্ত প্রতীক। তিনি এক উপেক্ষিত সূর্যমুখী, যার দিকে আলো ফেরাচ্ছে না আকাশ। তাঁর ভেতরের আগুন আজও জ্বলছে, কেবল সুযোগের বারান্দাটা বন্ধ।

আকবর, সত্যিকারের সোনা কখনো পুরোনো হয় না, শুধু অপেক্ষা করে তার উজ্জ্বলতা প্রমাণের জন্য। তোমার নীরবতা হোক তোমার শক্তি, তোমার এই বঞ্চনা হোক এক নতুন প্রতিজ্ঞা। ক্রিকেট–ঈশ্বর একদিন নিশ্চয়ই তাঁর আশীর্বাদের হাত বাড়াবেন, আর সেদিন তোমার ব্যাট কথা বলবে, আরও জোরে, আরও নির্ভয়ে।

লেখক: কর্মকর্তা, ভূমি মন্ত্রণালয়