ফুটবল মাঠে যতটা ভূমিকা থাকে খেলোয়াড়ের, ততটাই থাকে সমর্থকদেরও। একটি নিখুঁত পাস, এক অসাধারণ গোল, কিংবা এক লড়াই—সবকিছু তখনই অর্থবহ হয়, যখন স্ট্যাডিয়ামের মানুষেরা একসঙ্গে গর্জে ওঠে। তাদের কণ্ঠের ঢেউ, পতাকার দোল, আর নিঃস্বার্থ সমর্থনের উষ্ণতায় ফুটবল হয়ে ওঠে এক জীবন্ত শিল্প। বিশ্বের হাজারো ক্লাবের মধ্যে এমন কিছু ক্লাব আছে, যাদের অস্তিত্বই গড়া সমর্থকদের ভালোবাসায়। সেই তালিকার একেবারে শীর্ষের দিকে আছে জার্মানির শ্রমজীবী মানুষের শহর ডর্টমুন্ডের গর্ব—বরুসিয়া ডর্টমুন্ড।
জার্মান ফুটবলে বায়ার্ন মিউনিখ রাজত্ব করে হয়তো ট্রফি দিয়ে, কিন্তু মানুষের হৃদয়ে রাজত্ব করে ডর্টমুন্ড। একটা ক্লাব, যেটি জন্ম নিয়েছিল ১৯০৯ সালে কোনো করপোরেট বিল্ডিংয়ে নয়, একটি ক্যাথলিক গির্জার পেছনের ছোট্ট ঘরে, কিছু তরুণের স্বপ্নে। তাঁরা চেয়েছিল এমন এক দল, যেটা হবে জনগণের ক্লাব। যেখানে ফুটবল হবে শ্রমিকের হাসি, মানুষের গর্ব, আর শহরের আত্মা।
শতাব্দী পেরিয়ে আজ ডর্টমুন্ড শুধু একটি ক্লাব নয়, এটি এক প্রতীক—জনমানুষের একাত্মতা, শ্রমের সৌন্দর্য, আর ফুটবলের প্রতি নিখাদ ভালোবাসার প্রতিচ্ছবি। তাদের সমর্থকেরা যেন এক বিশাল পরিবার। এখানে কোনো দর্শক নেই, সবাই অংশগ্রহণকারী, সবাই যোদ্ধা। এই যোদ্ধাদেরই বলা হয় ‘দ্য ইয়োলো ওয়াল’ বা হলুদ দেয়াল। সিগনাল ইদুনা পার্কের দক্ষিণ প্রান্তে দাঁড়িয়ে থাকা ২৫ হাজার মানুষ, যাদের কণ্ঠস্বর একসঙ্গে গেয়ে উঠলে মনে হয়, পৃথিবী যেন কেঁপে উঠছে। তারা গ্যালারিতে বসে শুধু খেলা দেখে না, খেলার অংশ হয়ে ওঠে। ব্যানার, পতাকা, ধোঁয়া, গান আর একযোগে নাচ—সবকিছু মিলে সিগনাল ইদুনা পার্ক হয়ে ওঠে যেন এক থিয়েটার, যেখানে আবেগই একমাত্র ভাষা। প্রতিপক্ষ খেলোয়াড়েরা অনেক সময় স্বীকার করেছেন—ডর্টমুন্ডে খেলা মানে মানসিক যুদ্ধে নামা। এই আবেগই ডর্টমুন্ড ফ্যানদের করে তুলেছে বিশ্বের অন্যতম সেরা।
২০১৩ সালের ৯ এপ্রিল—ফুটবল ইতিহাসে ‘মিরাকল অব ডর্টমুন্ড’ নামে অমর হয়ে আছে সেই রাত। উয়েফা চ্যাম্পিয়নস লিগ কোয়ার্টার ফাইনালে মালাগার বিপক্ষে ৯০ মিনিট পর্যন্ত ডর্টমুন্ড হেরে যাচ্ছিল। গ্যালারিতে হতাশ মুখ, কিন্তু কেউ মাঠ ছাড়েনি। ‘হলুদ দেয়াল’ তখন আরও জোরে গান গাইতে শুরু করে, আরও জোরে পতাকা নাড়ায়। তাদের সেই উন্মাদনা যেন মাঠের ঘাস পর্যন্ত ছুঁয়ে যায়—৯১ ও ৯৩ মিনিটে পরপর দুই গোল! ফেলিপে সানতানা বলটা গোললাইনের ভেতর ঠেলতেই স্টেডিয়ামটা বিস্ফোরিত হয়। হাজারো মানুষ চিৎকার করে কেঁদে ফেলেছিল, যেন এক মুক্তির ঘোষণা। পরে দলটির তারকা মার্কো রয়েস বলেছিলেন, ‘আমরা হারতে যাচ্ছিলাম, কিন্তু হলুদ দেয়ালের আওয়াজ আমাদের পায়ের নিচের মাটি ফিরিয়ে দিয়েছিল।’
এই উন্মাদনার আরও এক নিদর্শন ২০১৭ সালের রেভিয়ার ডার্বি-শালকে ম্যাচ। প্রথমার্ধে ডর্টমুন্ড ৪-০–তে এগিয়ে ছিল, কিন্তু দ্বিতীয়ার্ধে শালকে চারটি গোল করে ম্যাচ ড্র করে ফেলে। এমন ভাঙা হৃদয়ের মুহূর্তেও ডর্টমুন্ড ফ্যানরা গান থামায়নি। তারা ‘ইউ উইল নেভার ওয়াক এলোন’ গাইতে থাকে। কেউ কেউ চোখের জলে ভেসে গেলেও দাঁড়িয়ে থাকে একই জায়গায়। তাদের কাছে হার মানে ক্লাবকে ছেড়ে যাওয়া নয়, বরং আরও শক্ত হয়ে পাশে থাকা। সেই রাতটা প্রমাণ করে দিয়েছিল, ডর্টমুন্ড ফ্যানদের ভালোবাসা জয়ের থেকেও বড়।
তবে এই ভালোবাসার অন্ধকার দিকও আছে। তাদের ডার্বি ম্যাচের দিনের উত্তেজনা কখনো কখনো রাস্তায় সংঘর্ষে রূপ নেয়। শহরের বিভিন্ন এলাকায় ফ্যান ক্লাবের মধ্যে সংঘাত, আতশবাজি, ধোঁয়া—সবই যেন আবেগের ভয়ংকর প্রকাশ। এই ফ্যানবেস যতটা সুন্দর, ততটাই অনিয়ন্ত্রিত। তাদের পাগলামি ভয় জাগায়, কিন্তু তার পেছনের ভালোবাসা অস্বীকার করা যায় না।
ডর্টমুন্ডের ফ্যানরা শুধু খেলার সময় নয়—ক্লাবের সংকটে, আর্থিক দুঃসময়ে, এমনকি অবনমনের ঝুঁকিতে থাকলেও ক্লাবের পাশে থাকে। ২০০৫ সালে যখন বরুসিয়া ডর্টমুন্ড প্রায় দেউলিয়া হয়ে যাচ্ছিল, তখন ফ্যানরা নিজেদের অর্থে ক্লাব বাঁচানোর উদ্যোগ নেয়। কেউ টিকিট আগাম কিনেছে, কেউ নিজের বেতনের অংশ দান করেছে। এই ভালোবাসা শুধুই ফুটবলের প্রতি নয়, একে অপরের প্রতিও।
তাদের টিফো বা বিশাল ব্যানারগুলো কেবল শিল্প নয়, একপ্রকার প্রতিবাদও। একবার তারা বিশাল এক ব্যানারে লিখেছিল, ‘আমাদের শক্তি আমাদের ঐক্যেই নিহিত।’
তাদের কাছে ফুটবল মানে সমাজ, একতা, আর সমানাধিকারের বার্তা। এই সাংস্কৃতিক দিকই ডর্টমুন্ডকে করে তুলেছে অন্য রকম।
এ ক্লাবের ঐতিহ্য গড়ে উঠেছে পরিশ্রম আর আত্মত্যাগে। তাদের সংস্কৃতি তৈরি হয়েছে শ্রেণিহীন সমাজের স্বপ্ন থেকে। ফ্যানরা তাই কেবল দর্শক নয়, তারা এক ঐতিহাসিক আন্দোলনের অংশ, যেখানে ফুটবল হয়ে উঠেছে পরিচয়, এক শহরের প্রতীক, আর জনগণের বিশ্বাস।
ফুটবলের মঞ্চে খেলোয়াড় বদলায়, কোচ বদলায়, কিন্তু ‘দ্য ইয়োলো ওয়াল’ অপরিবর্তিত থাকে। তারা হারলেও গান গায়, জয় পেলেও কাঁদে। তাদের জন্য ফুটবল মানে জীবনযাপন। সিগনাল ইদোনা পার্কের আলো যখন নিভে যায়, গ্যালারি যখন খালি হয়ে পড়ে, তখনো দেয়ালের প্রতিধ্বনি শোনা যায়, ‘এক্টে লাইবে বা সত্যিকারের ভালোবাসা।’
বন্ধু, ভৈরব বন্ধুসভা