ফুটবলে বদলে যাওয়া নতুন বাংলাদেশ

বাংলাদেশ জাতীয় ফুটবল দলছবি: প্রথম আলো

বাংলাদেশের ফুটবল একটা দীর্ঘ সময় ধরে একঘেয়েমি পারফরম্যান্সে বন্দী ছিল। ফলে দর্শকপ্রিয় এই শীর্ষ খেলার অঙ্গনে বাংলাদেশ নামটি ছিল কেবলই হতাশার। অতীতের বাজে ইতিহাস ও সংকট–খরা কেটে এখন এসেছে নতুন সম্ভাবনার জোয়ার। এ জোয়ারে গা ভাসিয়েছে নতুন সম্ভাবনার ফুটবল ও আপামর সাধারণ মানুষ।

একটা সময় দেশের মাটিতে খেলা হলে দর্শকশূন্যতায় খাঁ খাঁ করত স্টেডিয়াম। এখন স্টেডিয়াম কানায় কানায় পরিপূর্ণ হয়ে যায়। টিকিটের পর্যাপ্ত জোগান দিতে হিমশিম খেতে হচ্ছে ফেডারেশনকে।

এই নতুন সম্ভাবনার জোয়ারের নেপথ্যে কয়েকজন ফুটবলারের আগমন। তাঁরা প্রবাসী বাংলাদেশি বা বাংলাদেশি বংশোদ্ভূত। বিদেশের বিভিন্ন ক্লাবে খেলেও জাতীয় দল হিসেবে বেছে নিয়েছে বাংলাদেশকে। এ কারণে বাংলাদেশও আগের থেকে শক্তিমত্তার দিক দিয়ে এগিয়েছে। নতুন বাংলাদেশের ফুটবল উন্মাদনার সারথিদের অন্যতম যাঁরা—

বাংলাদেশ অধিনায়ক জামাল ভূঁইয়া
ছবি: শামসুল হক

জামাল ভূঁইয়া
বাংলাদেশে প্রবাসী বাংলাদেশি ফুটবলারদের যাত্রা শুরু হয় জামাল ভূঁইয়ার হাত ধরে। ডেনমার্কপ্রবাসী মা–বাবার কাছে বেড়ে ওঠা জামাল ভূঁইয়া স্থানীয় ফুটবল ক্লাবের মাধ্যমেই ছোটবেলা থেকে ফুটবলের যাত্রা শুরু করেন। কোপেনহেগেনের বিভিন্ন স্তরে খেলেছেন নিয়মিত। মা–বাবার কাছে বাংলাদেশের কথা শুনতে শুনতেই এ দেশের হয়ে জার্সি গায়ে জড়ানোর স্বপ্ন দেখেন।

২০১১ সালে প্রথমবার আসেন বাংলাদেশে ট্রায়াল দিতে। সেবার ট্রায়ালে পরিপূর্ণ আস্থার জায়গায় নিজেকে অধিষ্ঠিত করতে না পারায় ফেরত যেতে হয়। পরবর্তী সময়ে ২০১৩ সালে পরিপূর্ণভাবে দেশের জার্সি গায়ে ওঠে তাঁর। পরের গল্পটা সফলতার।

খুব দ্রুতই বাংলাদেশ ফুটবলের মাঠের মধ্যমণি হয়ে উঠলেন তিনি। ধারাবাহিক ভালো করার ফলস্বরূপ ২০১৮ সালে তাঁর বাহুতে অধিনায়কের বন্ধনী যুক্ত হয়। বাংলাদেশের হয়ে এখন অবধি ৯০টি আন্তর্জাতিক ম্যাচে অংশগ্রহণ করেছেন জামাল ভূঁইয়া। পাশাপাশি কলকাতার মোহামেডান ও আর্জেন্টিনার তৃতীয় বিভাগের দল সো দে মায়োর মতো ক্লাবে খেলার অভিজ্ঞতা রয়েছে তাঁর।

জুনে ভুটানের বিপক্ষে ম্যাচে গোল করেন হামজা চৌধুরী
প্রথম আলো

হামজা চৌধুরী
ইংলিশ প্রিমিয়ার লিগে খেলা প্রথম বাংলাদেশি ফুটবলার। লেস্টার সিটির সঙ্গে চুক্তিবদ্ধ হামজা দেওয়ান চৌধুরী গত মৌসুমে লোনে খেলেছেন ইংল্যান্ডের আরেক ক্লাব শেফিল্ড ইউনাইটেডে। মৌসুম শেষে আবারও ফিরে এসেছেন লেস্টারে।

১৯৯৭ সালের ১ অক্টোবর ইংল্যান্ডের লাফবারা শহরে জন্ম হামজার। মা বাংলাদেশি ও বাবা ক্যারিবিয়ান অঞ্চলের দ্বীপ দেশ গ্রানাডার। বাবা-মায়ের বিচ্ছেদের পর হামজার মা রাখিয়া চৌধুরী আবার বিয়ে করেন বাংলাদেশি-ব্রিটিশ দেওয়ান গোলাম মোর্শেদ চৌধুরীকে। এই পরিবারেই বেড়ে ওঠা হামজার। সং বাবা ও মা-দুজনের বাড়িই হবিগঞ্জ জেলার বাহুবল উপজেলায়।

২০১৭ সালের সেপ্টেম্বরে ইএফএল কাপের ম্যাচ দিয়ে লেস্টার সিটির হয়ে অভিষেক হয় পেশাদার ফুটবলে। কিছুদিন পর টটেনহাম হটস্পারের বিপক্ষে ইংলিশ প্রিমিয়ার লিগে অভিষেক। এরপর লেস্টার সিটির অনূর্ধ্ব-২৩ দলের অধিনায়কও হয়েছেন। ২০১৮ সালে ইংল্যান্ডের অনূর্ধ্ব-২১ দলে হয়ে প্রথমবারের মতো মাঠে নামেন। মোট সাতটি ম্যাচে অনূর্ধ্ব-২১ দলের হয়ে ইংল্যান্ডকে প্রতিনিধিত্ব করেছেন।

তারিক কাজী
ছবি : বাফুফে

সেখানেই খেলার ইচ্ছা ছিল। তবে জাতীয় দলে ডাক না পাওয়ায় আন্তর্জাতিক অঙ্গনে মাতৃভূমি বাংলাদেশকে প্রতিনিধিত্ব করার সিদ্ধান্ত নেন। গত ২৫ মার্চ এশিয়ান কাপের বাছাইপর্বে ভারতের বিপক্ষে ম্যাচ দিয়ে বাংলাদেশের জার্সিতে অভিষেক হয় এই মিডফিল্ডারের।

তারিক কাজী
বাবা শহীদুল কাজী গত শতাব্দীর আশির দশকে ফিনল্যান্ডপ্রবাসী হন। মায়ের জাতীয়তা ফিনিশ। বাবার গ্রামের বাড়ি নওগাঁয়। বাবার মুখে শুনে পিতৃভূমির প্রতি তৈরি হয় গভীর টান। বাবাই চাইতেন ছেলে যেন বাংলাদেশের প্রতিনিধিত্ব করে।

কিশোর বয়স থেকে প্রতিভাবান ফুটবলার হিসেবে পরিচিতি পান তারিক। ফিনল্যান্ডের শীর্ষ লিগের ক্লাব তামপিরেন ইলভসে ক্যারিয়ার শুরু হয়। ক্লাবটির হয়ে উয়েফা ইউরোপা লিগের বাছাইপর্বেও একটি ম্যাচ খেলেছেন। পেশাদার ফুটবলে অভিষেকের আগেই ফিনল্যান্ডের অনূর্ধ্ব-১৬ দলে সুযোগ পান। খেলেছেন অনূর্ধ্ব-১৭ ও অনূর্ধ্ব-১৯ দলেও। ফিনল্যান্ড জাতীয় দলে খেলার যথেষ্ট সম্ভাবনা ছিল তাঁর; কিন্তু তারিক হৃদয়ে বাংলাদেশকে ধারণ করেন বলেই মাত্র ২০ বছর বয়সে ইউরোপের ফুটবল ছেড়ে চলে আসেন ঢাকায়।

২০২০ সালে দেশে আসামাত্র তারিককে লুফে নেয় ঢাকার ক্লাব বসুন্ধরা কিংস। ২০২১ সালের ৩ জুন আফগানিস্তানের বিপক্ষে বিশ্বকাপ বাছাইপর্বের ম্যাচ দিয়ে জাতীয় দলের জার্সি গায়ে অভিষেক হয় তাঁর। এর পর থেকে জাতীয় দলের হয়ে নিয়মিত খেলে যাচ্ছেন। বাংলাদেশ দলের রক্ষণভাগের কান্ডারি বলা হয় তাঁকে। জাতীয় দলের হয়ে ম্যাচ খেলেছেন ২৭টি, ডিফেন্ডার হলেও নামের পাশে দুটি গোল করার কৃতিত্ব রয়েছে।

বাংলাদেশের জার্সিতে অভিষেক ম্যাচে দারুণ খেলেছেন শমিত সোম
ছবি: শামসুল হক

শামিত সোম
২৭ বছর বয়সী শামিতের জন্ম কানাডায়। মা–বাবা দুজনই বাংলাদেশি। বাবার বাড়ি মৌলভীবাজারে এবং মায়ের বাড়ি ব্রাহ্মণবাড়িয়ায়। এফসি এডমন্টন ক্লাবের মাধ্যমে তাঁর পেশাদার ফুটবলযাত্রা শুরু হয়। তিনি বর্তমানে কানাডিয়ান লিগের সর্বোচ্চ স্তরের ক্লাব ক্যাভালরি এফসির হয়ে খেলেন। ঘরোয়া লীগে ভালো পারফরম্যান্সের পুরস্কার হিসেবে ২০২০ সালে কানাডা জাতীয় ফুটবল দলের হয়ে অভিষেক ঘটে। এর আগে কানাডার বয়সভিত্তিক বিভিন্ন দলের হয়েও খেলেছেন।

কানাডিয়ান জাতীয় দলের হয়ে মাত্র দুটি ম্যাচ খেলেছেন শামিত সোম। এরপর আর ডাক পাননি তিনি। পরবর্তী সময়ে বাংলাদেশের হয়ে খেলার প্রস্তাব দেওয়া হলে তিনি রাজি হন। বাংলাদেশি পাসপোর্ট পাওয়ার পর ফিফায় আবেদন করেন। ফিফা অনুমোদনের পর গত ১০ জুন ঢাকায় সিঙ্গাপুরের বিপক্ষে এশিয়ান কাপ বাছাইপর্বে বাংলাদেশ হয়ে তাঁর অভিষেক হয়। অভিষেক ম্যাচে শামিত সোম দুর্দান্ত ঝলক দেখিয়েছেন।

এ ছাড়া ইতালির তৃতীয় সারির একটি দলে খেলা ফাহমিদুল ইসলাম, ইংলিশ ক্লাব সান্ডারল্যান্ড এফসির বয়সভিত্তিক দলে খেলা (বর্তমানে বসুন্ধুরা কিংস) কিউবা মিচেল, ওয়েলশ ফুটবল ক্লাব গোয়েত্রে ইউনাইটেড এফসিতে খেলা সামির মিয়া, কাতারের আল-ওয়াকরাহ এফসিতে খেলা নাবিল ইফরান ও যুক্তরাষ্ট্রপ্রবাসী ফুটবলার জায়ান আহমেদসহ অনেক প্রবাসী ফুটবলার বাংলাদেশের নাম বিশ্ব ফুটবলে উজ্জ্বল করতে অপেক্ষায় আছেন। এরই মধ্যে অভিষেক হয়েছে ফাহমিদুল ইসলামের। অভিষেকের অপেক্ষায় আছেন জায়ান আহমেদ।

সাধারণ সম্পাদক, ময়মনসিংহ বন্ধুসভা