বল হাতে স্বপ্ন বুনেছিলেন, ইতিহাসে লিখেছেন বাংলাদেশের জয়গাথা

রুবেল হোসেন প্রমাণ করেছেন, একজন ফাস্ট বোলার শুধু বল ফেলেন না, দেশের ভাগ্য ঘুরিয়ে দেন, কোটি মানুষের হৃদয়ে জায়গা করে নেনফাইল ছবি

বাংলাদেশের ক্রিকেটে যখনই ফাস্ট বোলিংয়ের কথা আসে, তখন একটি নাম অনিবার্যভাবে উঠে আসে—রুবেল হোসেন। ছোট্ট শহর বাগেরহাটের সাধারণ এক ছেলে, যাঁর স্বপ্ন ছিল কেবল বল হাতে দৌড়ে এসে ব্যাটসম্যানকে হার মানানো। পাড়ার মাঠে গতি আর বাউন্সে প্রতিপক্ষকে চমকে দেওয়া সেই ছেলেটিই একদিন হয়ে উঠলেন বৈশ্বিক ক্রিকেটে ‘বাগেরহাট এক্সপ্রেস’।

২০০৯ সালে শ্রীলঙ্কার বিপক্ষে ওয়ানডে অভিষেকেই চার উইকেট নিয়ে সবাইকে তাক লাগিয়ে দেন রুবেল হোসেন। তখনই বোঝা গিয়েছিল, বাংলাদেশের ফাস্ট বোলিং আক্রমণে নতুন এক যুগের সূচনা হচ্ছে।

২০১১ বিশ্বকাপে চট্টগ্রামে ইংল্যান্ডের বিপক্ষে ম্যাচটির কথা ভোলা কঠিন। বাংলাদেশের সামনে ছিল ২২৫ রানের লক্ষ্য। ব্যাটসম্যানরা লড়াই করলেও ইংল্যান্ডকে ছোট স্কোরে আটকে রাখার নায়ক ছিলেন রুবেল। দারুণ লাইন-লেন্থ আর গতি দিয়ে তিনি বারবার প্রতিপক্ষকে চাপে ফেলে দেন। সেই ম্যাচে তাঁর তিনটি গুরুত্বপূর্ণ উইকেট বাংলাদেশকে শেষ পর্যন্ত জয়ের পথে নিয়ে যায়। গ্যালারিতে হাজারো দর্শক তখন একসঙ্গে চিৎকার করছিলেন, যেন প্রতিটি বলের সঙ্গে তাঁরা রুবেলের পাশে দাঁড়িয়ে আছেন।

আরও পড়ুন

এরপর আসে তাঁর ক্যারিয়ারের সবচেয়ে উজ্জ্বল অধ্যায়—২০১৩ সালের অক্টোবরে ঢাকায় নিউজিল্যান্ডের বিপক্ষে ওয়ানডে সিরিজ। সেই ম্যাচে রুবেল যেন ঝলসে উঠেছিলেন। মাত্র ১০ ওভারে ৬ উইকেট তুলে নিয়ে একাই ম্যাচের মোড় ঘুরিয়ে দেন। নিউজিল্যান্ডের রস টেইলর কিংবা টম ল্যাথামদের মতো ব্যাটসম্যানরা তাঁর শর্ট পিচ আর ইয়র্কারের সামনে টিকতে পারেননি। বিশেষ করে হ্যাটট্রিকের সেই মুহূর্ত—যখন তাঁর হাত উঁচু করে উদ্‌যাপন, সতীর্থদের ছুটে আসা, গ্যালারির উল্লাস—এখনো বাংলাদেশের ক্রিকেট ইতিহাসে স্মরণীয় হয়ে আছে।

২০১৫ সালের বিশ্বকাপে আবারও ইংল্যান্ড। অ্যাডিলেডের সেই ম্যাচে বাংলাদেশের জন্য সবকিছুই ছিল ভাগ্য বদলে দেওয়ার মতো। প্রথমে ব্যাট হাতে মাহমুদউল্লাহ রিয়াদের ঐতিহাসিক সেঞ্চুরি, এরপর বল হাতে রুবেলের আগুনঝরা বোলিং। ৪৯ রানে ৪ উইকেট, যার মধ্যে ইয়ান বেল ও জস বাটলারের মতো ব্যাটসম্যানদের ফেরানো ছিল ম্যাচ ঘোরানোর মোড়। শেষ উইকেটের পর তাঁর দৌড়ে গিয়ে উল্লাস, সতীর্থদের আলিঙ্গন আর দর্শকের চোখের জল—সব মিলে ইতিহাস তৈরি করে। সেই জয়ই বাংলাদেশকে প্রথমবারের মতো কোয়ার্টার ফাইনালে তুলে দেয়।

তবে ক্রিকেটার–জীবনে সবকিছু সহজ ছিল না। ইনজুরি বারবার তাঁকে থামিয়ে দিয়েছে, ফিটনেস নিয়ে সমালোচনা হয়েছে। একসময় অনুশীলনে শৃঙ্খলা না মানার কারণে কেন্দ্রীয় চুক্তি থেকেও বাদ পড়েন। নতুন প্রজন্মের ফাস্ট বোলারদের ভিড়ে তাঁর অবস্থান নড়বড়ে হয়ে যায়। তবু প্রতিবার মাঠে নেমে তিনি দেখিয়েছেন সাহস, দেখিয়েছেন লড়াইয়ের মানসিকতা।

বাংলাদেশের ক্রিকেটে যখনই ফাস্ট বোলিংয়ের কথা আসে, তখন একটি নাম অনিবার্যভাবে উঠে আসে—রুবেল হোসেন
এএফপি

রুবেলের পরিসংখ্যান হয়তো বিশ্বের সেরা ফাস্ট বোলারদের কাতারে থাকবে না—টেস্টে ২৭ ম্যাচে ৩৬ উইকেট, ওয়ানডেতে ১০৪ ম্যাচে ১২৯ উইকেট আর টি–টোয়েন্টিতে ২৮ উইকেট। কিন্তু প্রতিটি সংখ্যার ভেতরে লুকিয়ে আছে একেকটি গল্প, একেকটি আবেগ। কখনো মিরপুরের গ্যালারির গর্জন, কখনো দূরদেশের মাঠে বাংলাদেশের প্রথম জয় ছিনিয়ে আনার স্মৃতি।

২০২১ সালে নিউজিল্যান্ড সফর ছিল তাঁর শেষ আন্তর্জাতিক ম্যাচ। হয়তো শেষটা স্বপ্নের মতো হয়নি। তাঁর ক্যারিয়ারের প্রতিটি অধ্যায় একেকটি শিক্ষা হয়ে থাকবে। বাংলাদেশের ক্রিকেটকে তিনি শিখিয়েছেন—ফাস্ট বোলিং দিয়েও ম্যাচ জেতানো যায়, একজন বোলারও হতে পারেন নায়ক, প্রতিটি ডেলিভারি দিয়েও লেখা যায় ইতিহাস।

আজ রুবেল হোসেন জাতীয় দলের বাইরে। কিন্তু তাঁর নাম উচ্চারিত হলে এখনো বাংলাদেশের ক্রিকেটপ্রেমীরা মনে করেন এক যোদ্ধার কথা। রুবেল হোসেন প্রমাণ করেছেন, একজন ফাস্ট বোলার শুধু বল ফেলেন না, দেশের ভাগ্য ঘুরিয়ে দেন, কোটি মানুষের হৃদয়ে জায়গা করে নেন। তাঁর প্রতিটি স্পেল, প্রতিটি ইয়র্কার, প্রতিটি উদ্‌যাপন বাংলাদেশের ক্রিকেট ইতিহাসে চিরকাল অমর হয়ে থাকবে।

বন্ধু, ভৈরব বন্ধুসভা