টেস্ট গ্রেটদের আলোচনায় মুশফিকুর রহিম থাকেন না কেন

বাংলাদেশের টেস্ট ক্রিকেট ইতিহাসের সেরা ব্যাটার মুশফিকুর রহিমএএফপি
২০১৭ সালে ওয়েলিংটন টেস্টের আগে ৫০ ম্যাচে মুশফিকুর রহিম ৩১.৯৭ গড়ে ২৭৫০ রান করেছিলেন। এর পর থেকে এখন পর্যন্ত ৪৮ টেস্ট খেলেছেন, প্রায় ৪৫ গড়ে রান করেছেন ৩৫৭৮।

মহেন্দ্র সিং ধোনি, কেভিন পিটারসেন, মাইক হাসি, অ্যালিস্টার কুক—প্রত্যেকেই ক্রিকেট ইতিহাসের অন্যতম সেরা ক্রিকেটার। সবাই সাবেক, অবসর নিয়েছেন অনেক বছর হয়ে গেছে। তবে তাঁদের আগে টেস্ট অভিষেক হওয়ার পরও এখনো আন্তর্জাতিক ক্রিকেট খেলে যাচ্ছেন মুশফিকুর রহিম। ২০০৫ সালে অভিষেক হওয়ার পর এখনো টেস্ট খেলছেন, এমন ক্রিকেটার বর্তমানে একজনই।

প্রথম ১২ টেস্টের পর মুশফিকুর রহিমের ব্যাটিং গড় ছিল ২০-এর নিচে। এরপর ধীরে ধীরে সব ফরম্যাটেই নিজেকে বাংলাদেশের ১ নম্বর উইকেটকিপার ব্যাটার হিসেবে প্রতিষ্ঠিত করেন। অভিষেকের পাঁচ বছর পর ২০১০ সালে আসে প্রথম সেঞ্চুরি; ভারতের বিপক্ষে রান তাড়ায় ৭ নম্বরে ব্যাটিং করতে নেমে খেলেন ১০১ রানের গুরুত্বপূর্ণ ইনিংস। দ্বিতীয় সেঞ্চুরি আসে আরও তিন বছর পর এবং চতুর্থ সেঞ্চুরি আসে এক বছর পর।

২০১৫ সালের শেষ নাগাদ মুশফিকের ব্যাটিং গড় বেড়ে দাঁড়ায় ৩২.৩১, যা একজন বিশ্বমানের ব্যাটারের জন্য মোটেই আদর্শ নয়। তবে বাংলাদেশের প্রেক্ষাপট বিবেচনায় তা যথেষ্ট ভালো। পাশাপাশি নেতৃত্বগুণ তো ছিলই। সব মিলিয়ে টাইগারদের অন্যতম ভরসায় পরিণত হন তিনি।

২০১৬ সালে মাত্র দুটি টেস্ট খেলেন মুশফিক। ঘরের মাঠে ইংল্যান্ডের বিপক্ষে ওই দুটি ম্যাচে ব্যাট হাতে তেমন অবদান রাখতে না পারলেও ঐতিহাসিক সিরিজ ড্র (১-১) করতে অধিনায়ক হিসেবে নেতৃত্ব দেন। পরের বছর ২০১৭ সাল থেকে মূলত তাঁর টেস্ট ক্যারিয়ার গ্রাফ ওপরে উঠতে শুরু করে।

বছরের প্রথম টেস্টে ওয়েলিংটনের বিরুদ্ধ কন্ডিশনে স্বাগতিক নিউজিল্যান্ডের বিপক্ষে পঞ্চম উইকেট জুটিতে সাকিব আল হাসানকে সঙ্গে নিয়ে ৩৫৯ রানের রেকর্ড জুটি গড়ে তোলেন মুশফিক। বোলার ছিলেন টিম সাউদি, ট্রেন্ট বোল্ট, নিল ওয়াগনার ও মিচেল স্যান্টনারের মতো বিশ্বসেরারা। এটি এখনো বাংলাদেশের ইতিহাসে যেকোনো উইকেটে সর্বোচ্চ জুটি। ১৫৯ রান করেছিলেন তিনি, যা ছিল এসইএনএ দেশগুলোর মাটিতে (সাউথ আফ্রিকা, ইংল্যান্ড, নিউজিল্যান্ড, অস্ট্রেলিয়া) এশিয়ান কোনো উইকেটকিপার ব্যাটারের প্রথম ১৫০+ স্কোর।

টেস্টে বাংলাদেশের প্রথম ডাবল সেঞ্চুরিটা শ্রীলঙ্কার বিপক্ষেই করেছেন মুশফিকুর রহিম
এএফপি

যদিও ম্যাচটি বাংলাদেশ হেরে যায়, তবু সেই স্কোর তাঁর মধ্যে আত্মবিশ্বাসের জন্ম দেয়। যা পরবর্তী বছরগুলোতে আরও আটটি সেঞ্চুরি করতে অনুপ্রেরণা জোগায়। সর্বশেষ সেঞ্চুরি করেন গত জুন মাসে গলেতে শ্রীলঙ্কার বিপক্ষে।

২০১৭ সালে ওয়েলিংটন টেস্টের আগে ৫০ ম্যাচে মুশফিকুর রহিম ৩১.৯৭ গড়ে ২৭৫০ রান করেছিলেন। এর পর থেকে এখন পর্যন্ত ৪৮ টেস্ট খেলেছেন, প্রায় ৪৫ গড়ে রান করেছেন ৩৫৭৮। এই সময়ের মধ্যে (১৮ জুন ২০২৫ পর্যন্ত) মাত্র চারজন খেলোয়াড় তাঁর চেয়ে বেশি গড়ে বেশি রান করেছেন। তাঁরা হলেন কেন উইলিয়ামসন (৪৯ ম্যাচে ৬১.৭ গড়ে ৪৬২৮ রান), স্টিভেন স্মিথ (৬৮ ম্যাচে ৫৩.৫৯ গড়ে ৫৬৮১ রান), জো রুট (১০০ ম্যাচে ৪৯.৭৭ গড়ে ৮৪১২ রান) ও মার্নাশ লাবুশেনে (৫৮ ম্যাচে ৪৬.১৯ গড়ে ৪৪৩৫ রান)।

তবু কেন আধুনিক ক্রিকেটের সেরা টেস্ট ব্যাটারদের মধ্যে মুশফিকুর রহিমের নাম উচ্চারিত হয় না?

কারণ অনেকগুলো। প্রথমত, ক্যারিয়ারের প্রথম ১০ বছরে মুশফিকুর রহিমের ব্যাটিং গড় মাত্র ৩০। পরবর্তী ১০ বছরে দুর্দান্ত খেলার পরও গড় এখনো ৪০ (৩৮.১) ছুঁতে পারেনি। অন্যদিকে আধুনিক ক্রিকেটের সেরা টেস্ট ব্যাটারদের গড় ৫০+ বা এর কাছাকাছি। কেন উইলিয়ামসন ৫৪.৯, স্টিভেন স্মিথ ৫৬.০, জো রুট ৫১.৩ এবং বিরাট কোহলি ৪৬.৯।

দ্বিতীয়ত, টেস্ট ক্রিকেটের কাঠামোর ভারসাম্যহীনতা। বিশেষ করে এসইএনএ দেশগুলোতে বাংলাদেশের ম্যাচ খেলতে না পারা। ২০১৭ সাল থেকে মুশফিক মাত্র ছয়টি টেস্ট খেলেছেন এ দেশগুলোতে। এর মধ্যে নিউজিল্যান্ডে দুটি (ব্যাটিং গড় ৯৪.৫০) ও চারটি সাউথ আফ্রিকায় (ব্যাটিং গড় ১৯)। এই সময়ের মধ্যে ইংল্যান্ড ও অস্ট্রেলিয়ায় কোনো টেস্ট খেলার সুযোগ হয়নি বাংলাদেশের। অন্যদিকে দেশের মাটিতেও এ দেশগুলোর বিপক্ষে মাত্র ছয়টি টেস্ট খেলার সুযোগ হয়; সাউথ আফ্রিকা, নিউজিল্যান্ড ও অস্ট্রেলিয়ার বিপক্ষে দুটি করে ম্যাচ। ২০১৬ সালের পর ইংল্যান্ড আর খেলতে আসেনি।

ওয়েলিংটনের বিরুদ্ধ কন্ডিশনে স্বাগতিক নিউজিল্যান্ডের বিপক্ষে পঞ্চম উইকেট জুটিতে সাকিব আল হাসানকে সঙ্গে নিয়ে ৩৫৯ রানের রেকর্ড জুটি গড়ে তোলেন মুশফিক।

ভালো কিংবা খারাপ দিক বলুন, এশিয়ান ব্যাটারদের সেরা বিবেচনার অন্যতম মানদণ্ড ধরা হয় পশ্চিমা এ দেশগুলোর বিপক্ষে পারফরম্যান্স। যেখানে তাদের বিপক্ষে ১৪ টেস্ট খেলা মুশফিকুর রহিমের ব্যাটিং গড় মাত্র ২১.৯২। এই সীমাবদ্ধতাগুলো তাঁর ক্যারিয়ারে প্রভাব ফেলেছে।

কোনো সন্দেহ নেই যে বাংলাদেশের টেস্ট ক্রিকেট ইতিহাসের সেরা ব্যাটার মুশফিকুর রহিম। কিন্তু দুর্ভাগ্যজনকভাবে বৈশ্বিক মানের হিসেবে তিনি সেই স্বীকৃতি কখনোই পাবেন না।

উইজডেনের একটি ইংরেজি আর্টিকেল থেকে অনূদিত