ইনজুরির কারাগারে বন্দী এক জাদুকরের গল্প
ফুটবলের সবুজগালিচায় এক ছন্দময় কবি, যার তুলিতে রয়েছে শিল্প আর পায়ে মায়াবী জাদু। কিন্তু নিয়তির নিষ্ঠুর পরিহাসে, তাঁর সেই বর্ণিল ক্যানভাসে বারবার পড়েছে বিষাদের কালো ছায়া—ইনজুরি!
ফুটবল ভুবনের এক বিষণ্ন কাব্য তিনি—নেইমার দ্য সিলভা সান্তোস জুনিয়র। ব্রাজিলের সমুদ্রসৈকত থেকে উঠে আসা এক প্রতিভার নাম, যার পায়ে সাম্বার ছন্দ আর চোখে বিশ্বজয়ের স্বপ্ন। ব্রাজিলের বিখ্যাত ক্লাব সান্তোসের হয়ে যখন প্রথম মাঠে নামলেন, মনে হলো যেন এক নতুন যুগের দূত, ফুটবলের ব্যাকরণ ভেঙে লেখা এক দুরন্ত কবিতা। তাঁর ড্রিবলিংয়ে ছিল বিদ্যুতের গতি, প্রতিপক্ষের ডিফেন্স যেন তাঁর কাছে ধুলার প্রাসাদ, নিমেষে তা গুঁড়িয়ে দিতেন নিজের শৈল্পিক ছোয়ায়।
বার্সেলোনার নীল-মেরুন জার্সিতে যখন মেসি-সুয়ারেজের সঙ্গে গড়ে তুললেন সেই ভয়ংকর ‘এমএসএন’ত্রয়ী, তখন ফুটবল বিশ্ব হাঁ করে তাকিয়ে দেখল এক অভূতপূর্ব সুর-সংগম। মনে হচ্ছিল, বিশ্ব ফুটবলের মুকুট বুঝি তাঁরই হাতে উঠবে। সেই মুকুট জয়ের স্বপ্নে বার্সেলোনা ছেড়ে প্যারিসে পাড়ি জমালেন। কিন্তু বিধাতা হয়তো অন্য কিছু লিখে রেখেছিলেন ভাগ্যে।
নেইমারের ক্যারিয়ারটা যেন ঝোড়ো বাতাসের মুখে পড়া এক প্রস্ফুটিত গোলাপের মতো। যতবারই সেই সৌন্দর্য মেলে ধরতে চেয়েছে, ততবারই আঘাত হেনেছে কালবৈশাখী। একটির পর একটি ইনজুরি এসে কেড়ে নিয়েছে পায়ের জাদুকরি ছন্দ। ২০১৪ সালের বিশ্বকাপ কোয়াটার ফাইনালে ৮৮ মিনিটে কলম্বিয়ান উইং-ব্যাক হুয়ান জুনিগার হাঁটু দিয়ে পিঠে আঘাত করায় চোটে পড়েন নেইমার। ডাক্তারদের মতে, চোটটি দুই সেন্টিমিটার এদিক-ওদিক হলে তাঁর ফুটবল ক্যারিয়ার শেষ হয়ে যেতে পারত। এর পর থেকে গোড়ালিতে বারবার আঘাত, প্রতিটি চোটই যেন একেকটি স্বপ্নের সমাধি। ফুটবলের মহারণগুলোতে যখন তাঁর উপস্থিতি ছিল সবচেয়ে বেশি প্রয়োজন, ঠিক তখনই তিনি পড়ে রইলেন ডাগআউটে আহত সিংহের মতো।
বিশ্বকাপের মাঠে তাঁর পিঠের সেই ভয়ংকর চোট! পুরো ব্রাজিলের কান্না যেন মিশে গিয়েছিল তাঁর চোখের জলে। সেমিফাইনালে দলের সেই ঐতিহাসিক বিপর্যয়, আর নেইমারকে মাঠের বাইরে বসে অসহায়ের মতো তা দেখতে হয়েছিল। এ যেন এক ট্র্যাজিক হিরোর গল্প, যিনি সর্বস্ব দিয়েও শেষ হাসিটা হাসতে পারলেন না।
নেইমারের প্রতিটি প্রত্যাবর্তন ছিল এক একটি প্রতিজ্ঞা—এবার আর থামবেন না। কিন্তু ভাগ্যের নির্মম পরিহাসে, সেই ফিনিক্স পাখি বারবার উড়তে গিয়েই ডানা ভেঙেছে। পুরো ক্যারিয়ারজুড়েই সাফল্যের শিখর আর হতাশার অতল গহ্বর পাশাপাশি হেঁটেছে। শতকোটি টাকার বিনিময়ে পিএসজিতে যাত্রা, সেখান থেকে সৌদি আরবের ক্লাব আল-হিলালে পাড়ি জমানো—সবটাই যেন এই অস্থিরতা আর অনিশ্চয়তার ছাপ বহন করে।
নেইমার যেন এক হতভাগা নক্ষত্র। তাঁর প্রতিভা প্রশ্নাতীত, দক্ষতা অবিস্মরণীয়। তবু ফুটবল ইতিহাসের পাতায় তিনি হয়তো থেকে যাবেন ‘যদি’ আর ‘কিন্তু’র এক দীর্ঘশ্বাস হয়ে। হয়তো বলা হবে, যদি ইনজুরি না থাকত, তবে তিনি কোথায় পৌঁছতে পারতেন?
তবু যখনই নেইমার সবুজ মাঠে নামেন, সেই ক্ষণিকের ঝলকে তাঁর ভেতরের শিল্পীসত্তা জেগে ওঠে। মনে হয়, একলহমায় যেন ফিরে এসেছেন সেই দুরন্ত ব্রাজিলীয় যুবক, যার পায়ে ছিল বিশ্বজয়ের নেশা। নেইমার তাই শুধু একজন ফুটবলার নন, তিনি এক অসমাপ্ত উপাখ্যান, এক চিরন্তন হতাশার কাব্য, যা বারবার ফুটবলপ্রেমীদের মনে করিয়ে দেয়, প্রতিভা অমর হলেও শরীর বড় ভঙ্গুর।
তাঁর পায়ের ইনজুরিগুলো যেন আত্মার ক্ষত। এই ক্ষত নিয়েই তিনি ফুটবলের মাঠে এক বিষণ্ন কিংবদন্তি।