প্রত্যেক ব্যক্তির মানসিক সুস্থতার অধিকার রয়েছে

চলুন আমরা সবাই শিখি—নিজেকে ভালোবাসতে, অন্যের অনুভূতি বুঝতে আর মনের যত্ন নিতে।

আমরা যখন মানসিক কষ্টের কথা বলি, তখন অনেকেই বলে—‘এটা তো কিছু না, একটু ধৈর্য ধরো। ঠিক হয়ে যাবে।’ কিন্তু ‘কিছু না’-এর মধ্যেই লুকিয়ে থাকে একজন মানুষের গভীর একাকিত্ব, অজানা ভয়, কিংবা নিঃশব্দ যুদ্ধ।

মানসিক স্বাস্থ্য মানে কেবল রোগমুক্ত থাকা নয়; বরং নিজের অনুভূতিগুলো চেনা, গ্রহণ করা এবং সেগুলোর সঙ্গে সুস্থভাবে বেঁচে থাকা। এটি এমন এক ভারসাম্য, যেখানে মন ক্লান্ত হলেও মানুষ আবার উঠে দাঁড়ায়—নতুন করে বাঁচার সাহস খুঁজে পায়।

আধুনিক এই যুগে আমরা অনেক কিছু অর্জন করছি, কিন্তু হারাচ্ছি মনোযোগ, ধৈর্য ও সহমর্মিতা। মুঠোফোনের আলোয় মুখ উজ্জ্বল হলেও, হৃদয়ের ভেতর অনেক সময় অন্ধকার। তাই দরকার প্রতিদিন কিছু সময় নিজের সঙ্গে থাকা। সকালে বা রাতে কয়েক মিনিট চোখ বন্ধ করে নিজের শ্বাস শুনুন, অনুভব করুন আপনি জীবিত আছেন—সেটাই একধরনের মানসিক যত্ন।

মানসিক স্বাস্থ্য দিবসের এই সময় আমাদের মনে করিয়ে দেয়, আমি যেমন আছি, তেমনই ঠিক আছি। সাহায্য চাওয়াটা দুর্বলতা নয়, বরং সুস্থ হওয়ার প্রথম সাহসী পদক্ষেপ।

প্রতিবছর ১০ অক্টোবর পালন করা হয় বিশ্ব মানসিক স্বাস্থ্য দিবস। এই দিনের উদ্দেশ্য হলো মানুষের মধ্যে মানসিক স্বাস্থ্য সম্পর্কে সচেতনতা বৃদ্ধি, মানসিক সমস্যাগুলোর সামাজিক কথা বলা কমিয়ে আনা এবং সেবা নিশ্চিত করার দাবি জানিয়ে নীতিমালা গঠন ও প্রয়াস চালিয়ে যাওয়া। এবারের দিবসের প্রতিপাদ্য ‘সেবায় প্রবেশযোগ্যতা—দুর্যোগ ও বিপর্যয়ে মানসিক স্বাস্থ্য’।

এই প্রতিপাদ্যের মাধ্যমে বিশ্বজনীন মূল বার্তা—বিপর্যয়, যুদ্ধ, মহামারি, প্রাকৃতিক আঘাত বা অন্য কোনো জরুরি পরিস্থিতিতে মানসিক স্বাস্থ্যসেবা যেন প্রত্যেকের নাগালে পৌঁছায়। বিশেষভাবে খেয়াল করা যায়, বিপর্যয় ও জরুরি অবস্থা, যেমন প্রাকৃতিক বিপর্যয় (বন্যা, ভূমিধস, ঘূর্ণি), সংকট (যুদ্ধ, অভিবাসন), মহামারি ইত্যাদি মানুষের জীবন ও পরিবেশকে অনিশ্চয়তার মধ্যে ফেলে দেয়। এর ফলে মানুষের মানসিক অবস্থা অস্থির হয়ে ওঠে, উদ্বেগ ও হতাশা, ভয়, শোক, চলমান নিরাপত্তাহীনতা অনুভূত হতে পারে।

আরও পড়ুন

জরুরি অবস্থায় সাধারণ স্বাস্থ্যসেবা, যেমন ডাক্তার, ওষুধ, হাসপাতালে ভর্তি, এগুলো চলতে থাকে। এগুলো গুরুত্ব পায়। মানসিক স্বাস্থ্যসেবা প্রায়ই পরে আসে বা বাদ পড়ে। এ কারণে মানসিক যন্ত্রণাগুলো দীর্ঘমেয়াদি হতে পারে। তখন ঘটতে পারে অনেক অনাকঙ্ক্ষিত মৃত্যু; শারীরিক ও মানসিক ট্রমা, যা দীর্ঘমেয়াদি হয়। এ সময় বেশ কিছু কারণে বিপর্যয় ও জরুরি অবস্থায় মানসিক স্বাস্থ্যসেবা পৌঁছানো কঠিন হয়।

পরিকাঠামোর ধ্বংস ও সংকুচিত অবস্থা
হাসপাতাল, স্বাস্থ্যকেন্দ্র, মনঃস্বাস্থ্য ক্লিনিক বা সংশ্লিষ্ট কেন্দ্রীয় অবকাঠামো ধ্বংস হতে পারে। রাস্তা যোগাযোগ বিঘ্নিত হতে পারে।

মনোচিকিৎসক, সমাজসেবা কর্মী, কাউন্সেলর, মনঃপরামর্শদাতার সংখ্যা জরুরি চাহিদার তুলনায় কম। বিশেষ করে দূরবর্তী এলাকায়, সংকট অঞ্চলে তাঁরা পৌঁছাতে পারবেন না বা তাঁদের সংকটকালীন কাজ পরিচালনায় প্রস্তুতি না–ও থাকতে পারে।

মানসিক স্বাস্থ্যকে অবমূল্যায়ন ও সামাজিক ভয়
অনেক সময় মানুষ মানসিক সমস্যাগুলোকে জরুরি সমস্যা হিসেবে বিবেচনা করে না। সংকটকালে খাবার, পানি ও আশ্রয়ের ব্যবস্থা বেশি অগ্রাধিকার পায়। পাশাপাশি সামাজিক লজ্জা, মন্দ বিশ্বাস বা মানসিক রোগের কলঙ্কের ভয়ে অনেকেই সেবা নিতে পিছপা হয়। অনেক সেবাদাতা বা স্বাস্থ্যকর্মী মানসিক স্বাস্থ্য ও মনঃসমর্থন বিষয়ে পর্যাপ্ত প্রশিক্ষিত না–ও থাকতে পারেন।

বাংলাদেশের প্রেক্ষাপট ও সম্ভাবনা
বাংলাদেশ একটি বিপর্যয়প্রবণ দেশ। বন্যা, ঘূর্ণিঝড়, নদীভাঙন, ভূমিধস ইত্যাদি প্রায় নিয়মিত ঘটে। এগুলো শুধু শারীরিক ক্ষতি নয়, মানসিক উদ্বেগ, আতঙ্ক ও হতাশা সৃষ্টি করে।

দেশের অভিজ্ঞতা থেকে দেখা যায়—
সচেতনতা এখনো সীমিত—অনেক মানুষ মানসিক সমস্যাকে ভয়, কলঙ্ক বা পাগলামি হিসেবে দেখে। ফলে সমস্যার শুরুতেই সেবা খোঁজা হয় না।
জনসাধারণ ও সামাজিক সংগঠনগুলোর মধ্যে মানসিক স্বাস্থ্য শিক্ষা কম।
স্বাস্থ্যব্যবস্থায় মানসিক স্বাস্থ্যকে প্রাধান্য দেওয়া কম হয়েছে; অধিকাংশ জেলা হাসপাতালে মানসিক স্বাস্থ্যবিশেষজ্ঞ বা মনঃপরামর্শ কেন্দ্র নেই। বাস্তব ও দুঃখজনক হলেও এটা সত্যি।
দুর্যোগ–পরবর্তী অঞ্চলে বাস্তবিকভাবে সেবাদান স্বল্প ও স্থায়ী নয়। আর্থসামাজিক দুর্বলতা থাকায় সেবাগুলোর খরচ বহন করা কঠিন।

প্রত্যেক ব্যক্তির মানসিক সুস্থতার অধিকার রয়েছে, শারীরিক সুস্থতার মতোই। চলুন আমরা সবাই শিখি—নিজেকে ভালোবাসতে, অন্যের অনুভূতি বুঝতে আর মনের যত্ন নিতে।

লেখক: সাইকোথেরাপিস্ট ও মানসিক–বিষয়ক প্রশিক্ষক, কনসালট্যান্ট, সিটি হাসপাতাল লিমিটেড এবং সভাপতি ঢাকা মহানগর বন্ধুসভা।