যদি প্রিয়জন আত্মঘাতপ্রবণ হয়: লক্ষণ ও করণীয়

পরিবারের সদস্যদের মনোযোগ দিয়ে শুনতে হবে আসলে সে কী বলতে চায়ছবি: এআই/বন্ধুসভা

প্রচলিত একটি ধারণা আছে, যারা আত্মহত্যার কথা বলে, তারা আসলে আত্মহত্যা করে না।

এটি সম্পূর্ণ ভুল। গবেষণা বলছে, আত্মহত্যা করার আগে প্রায়ই মানুষ কোনো না কোনোভাবে ইঙ্গিত দেয়। কখনো সরাসরি বলে, ‘আমি আর বাঁচতে চাই না’, ‘সবকিছু শেষ করে দিতে চাই’। আবার কখনো আচরণের ভেতরেই সংকেত লুকিয়ে থাকে—একাকিত্ব খোঁজা, প্রিয় জিনিসগুলো অন্যকে দিয়ে দেওয়া, ঘুম ও খাওয়ার ধরন বদলে যাওয়া ইত্যাদি। এগুলো আমাদের জন্য সতর্কতার সিগন্যাল।

আত্মহত্যা করেছে, এমন এক মেয়ের সঙ্গে আমার কথা হতো। তার কথায় বহুবার প্রকাশ পেয়েছে সে মরে যেতে চায়, জীবন সম্পর্কে বিতৃষ্ণা ও কষ্ট এবং মানুষ তাকে না বোঝার একধরনের চ্যালেঞ্জ। পরিবার, আত্মীয়স্বজন, বন্ধুবান্ধব সবাইকে সচেতন করার পরেও কেউ সচেতন হননি। নিয়ে যাননি কোনো পেশাদার জায়গায়। বিষয়টিকে এড়িয়ে যান। সবাই ধরে নিয়েছিলেন, সে তো ভালোই আছে, বন্ধুদের সঙ্গে সময় কাটাচ্ছে, ঘুরতে যাচ্ছে, নতুন করে কাজ করছে!

মেয়েটি বলত, ‘মাঝেমধ্যে এমন লাগে মনে হয়, আমাকে একটা বাক্সের মধ্যে আটকে রেখেছে। এর বাইরে যেতে পারব না। কোনো কিছু ভালো লাগে না, সবকিছু বিরক্ত লাগে। মনে হয়, আমার জন্য অন্যরা বিরক্ত হচ্ছে। কারও সঙ্গে কথা বলতে ইচ্ছা করে না, শুধু ঘুমাতে ইচ্ছা করে। কিন্তু ঘুম আসে না। কোনো কিছু করতেই ভালো লাগে না। মাঝেমধ্যে মরে যেতে ইচ্ছা করে, কিন্তু মরতে আবার ভয়ও লাগে। আমার কথাগুলো কেন জানি কেউ বোঝে না। বুঝতে চায় না। ওরা ওদের মতো করে বলতে থাকে...।... দম বন্ধ লাগে... আমি ভালোই থাকি। হঠাৎ কী জানি হয়, আমার মুড পুরো চেঞ্জ হয়ে যায়। আমি ইচ্ছা করে এমন করি, তা কিন্তু নয়...।’

কেন মানুষ আত্মহত্যা করে?
আত্মহত্যা হলো অসহায়ত্ব ও তীব্র মানসিক যন্ত্রণার বহিঃপ্রকাশ। হতাশা, দীর্ঘস্থায়ী মানসিক অসুস্থতা, সম্পর্কের ভাঙন, আর্থিক সংকট, সামাজিক লজ্জা বা হীনম্মন্যতা—এসব কারণে একজন মানুষ মনে করতে পারেন, আর কোনো পথ নেই। আসলে তাঁরা মরতে চান না, কেবল কষ্ট থেকে মুক্তি চান।

আরও পড়ুন

কখন আত্মহত্যার চিন্তা আসে?
আত্মহত্যার চিন্তা সাধারণত তখনই জাগে, যখন একজন মানুষ মনে করেন তাঁর যন্ত্রণার আর কোনো শেষ নেই। গভীর হতাশা, অসহায়ত্ব ও নিঃসঙ্গতা মিলে তখন এক অন্ধকার চক্র তৈরি করে। জীবনের প্রতি আশাবাদ হারিয়ে যায়, ভবিষ্যৎকে আর উজ্জ্বল মনে হয় না। অনেক সময় প্রিয়জন হারানো, সম্পর্কের ভাঙন, চাকরি হারানো বা বড় কোনো আর্থিক সমস্যার মতো সংকট এই চিন্তার সূচনা ঘটায়। আবার কারও কারও ক্ষেত্রে দীর্ঘদিন ধরে বিষণ্নতা, উদ্বেগ বা মানসিক অসুস্থতা ধীরে ধীরে তাঁকে সেই সীমান্তে ঠেলে দেয়, যেখানে মৃত্যু ছাড়া আর কোনো মুক্তির পথ খুঁজে পান না।

এমন পরিস্থিতিতে মানুষ প্রায়ই মনে করেন, ‘আমাকে ছাড়া সবাই ভালো থাকবে’ বা ‘আমার বেঁচে থাকার কোনো অর্থ নেই।’ অপরাধবোধ, লজ্জা বা সামাজিক কলঙ্কের চাপ থেকেও এই চিন্তা মাথাচাড়া দিয়ে ওঠে। অনেক সময় আবার মাদক বা আসক্তি মানসিক ভারসাম্য নষ্ট করে দেয়, ফলে যুক্তিবোধ কমে যায় এবং আত্মহত্যার প্রবণতা বেড়ে যায়।

সবচেয়ে বড় বিষয় হলো, আত্মহত্যার চিন্তা হঠাৎ এলেও এর পেছনে থাকে দীর্ঘদিনের অমীমাংসিত কষ্ট, অবহেলা, একাকিত্ব ও না–পাওয়া ভালোবাসা। তাই যখন কেউ বলে বা ইঙ্গিত দেয় যে সে বাঁচতে চায় না, তখন তা অবহেলা করার মতো বিষয় নয়। এটি এক নিঃশব্দ সাহায্যের আর্তি, যা আমরা শুনতে, বুঝতে ও সাড়া দিতে পারলেই হয়তো একটি জীবন বাঁচানো সম্ভব।

কীভাবে পাশে থাকতে পারি?
মনোযোগ দিয়ে শুনুন, তাঁদের কষ্টকে অবহেলা বা ঠাট্টা করবেন না।
বলবেন না, ‘তুমি শক্ত হও’; বরং বলুন, ‘আমি তোমার পাশে আছি’।
তাঁদের অনুভূতিকে স্বীকৃতি দিন, বিচার করবেন না।
জরুরি প্রয়োজনে কাউন্সেলর বা মনোরোগ বিশেষজ্ঞের কাছে যেতে উৎসাহ দিন।

কীভাবে প্রতিরোধ সম্ভব?
আত্মহত্যা নিয়ে ভ্রান্ত ধারণা ভাঙতে হবে। খোলাখুলি আলোচনা করতে হবে। সচেতনতা বৃদ্ধি করতে হবে। মানসিক স্বাস্থ্যসেবা সহজলভ্য করতে হবে। পরিবার ও বন্ধুদের ভূমিকা এখানে অনেক গুরুত্বপূর্ণ। বিষয়টা নিয়ে প্রথমে নিজের সচেতন হওয়া, ভালোভাবে বিষয়টি বোঝা, তারপর সবাইকে একযোগে কাজ করতে হবে।

পরিবারের সদস্যদের মনোযোগ দিয়ে শুনতে হবে আসলে সে কী বলতে চায়। কথার মাঝখানে না কেটে সময় নিয়ে শোনা। ভালোবাসা, মনোযোগ ও সময়ই সবচেয়ে বড় সহায়ক। বন্ধুদের দায়িত্ব হলো তাকে নিয়ে ঘুরতে যাওয়া, বেড়াতে যাওয়া ও কোনো ভালো রেস্টুরেন্টে খেতে যাওয়া। পাশাপাশি একজন পেশাদার সাইকোথেরাপিস্টের কাছে নিয়ে যাওয়া। এটাই হবে বন্ধুর ভালোবাসার প্রতি কৃতজ্ঞতা এবং সত্যিকার অর্থে ভালোবাসা ও দায়িত্ববোধ।

লেখক: সাইকোথেরাপিস্ট ও মানসিক–বিষয়ক প্রশিক্ষক, কনসালট্যান্ট, সিটি হাসপাতাল লিমিটেড এবং সভাপতি ঢাকা মহানগর বন্ধুসভা।