ভূমিকম্পে মন ও শরীরের অস্থিরতা: কেন হয়, কীভাবে সামলাবেন
হাসপাতালে বসে ক্লায়েন্ট দেখছিলাম, হঠাৎ ঝাঁকি! আমার সামনে টেবিলে থাকা টিস্যুর বক্স নিচে পড়ে গেল, ইসিজি মেশিনটা খুব জোরে দুলতে শুরু করল। আমি দাঁড়িয়ে গেলাম টেবিলটা শক্ত করে ধরে, কিন্তু হাত ছুটে যাচ্ছিল। মায়ের কথা মনে হলো, মা ঠিক আছেন তো! কয়েক সেকেন্ড! ক্লায়েন্টকে বললাম, চলো ছাদে যাই। কয়েকটা সেকেন্ড... মনে হচ্ছিল আজ মারা যাব নিশ্চিত! কেমন বুক ধড়ফড়, হাত–পা ঠান্ডা হয়ে যাওয়া এবং মাথা ঘোরা অনুভব করতে লাগল। কম্পন থেমে যাওয়ার পরও বারবার অনুভূতি হয় বিছানা নড়ছে। রাতে ঘুমাতে গেলে চমকে উঠি।
অফিসে বসে থাকা অবস্থায় ভবন কেঁপে উঠলে বেসরকারি চাকরিজীবী রিয়াদের মাথায় প্রথমেই আসে, পরিবার নিরাপদ তো? তিনি দ্রুত নিচে নেমে হাঁপাতে হাঁপাতে ফোন করেন। শারীরিক ক্ষতি কিছু হয়নি, কিন্তু মানসিকভাবে তিনি কয়েক দিন খুবই অস্থির ছিলেন। কাজেও মনোযোগ দিতে পারছিলেন না। বলেন, ‘আমি এক সেকেন্ডে বুঝলাম, কোনো কিছুই স্থায়ী নয়।’
ছোটবেলায় একবার ভূমিকম্পে ঘরের জিনিসপত্র পড়ে গিয়েছিল, ওই স্মৃতি মাথায় থাকায় এবার কম্পন শুরু হতেই জাহিন কান্নায় ভেঙে পড়ে। তার শরীর কাঁপছিল, মনে হচ্ছিল, ভয়ানক কিছু একটা ঘটবে। কম্পন থেমে যাওয়ার পরও সে বারবার আতঙ্ক অনুভব করছিল।
ছোট্ট শিশু পিহু বলে, ‘আমি দৌড়ে গিয়ে মাকে জড়িয়ে ধরেছিলাম’।
শব্দ শুনে ও ঘর নড়তে দেখে পিহু ভয় পেয়ে মায়ের দিকে দৌড়ে যায়। ভূমিকম্প থেমে যাওয়ার পরও সে মায়ের হাত ছাড়ে না। রাতে সে দুঃস্বপ্ন দেখে এবং বলে, ‘বাড়ি আবার নড়বে না তো?’
আমাদের প্রায় অনেকেই এই অভিজ্ঞতার ভেতর দিয়ে বর্তমানে সময় পার করছি।
প্রাকৃতিক দুর্যোগের মধ্যে ভূমিকম্প সবচেয়ে আকস্মিক ও অপ্রস্তুত করে দেওয়া অভিজ্ঞতাগুলোর একটি। কয়েক সেকেন্ডের কম্পন আমাদের শরীর ও মনকে এমনভাবে নাড়া দেয় যে তার প্রভাব অনেকক্ষণ, অনেক দিন, কখনো কখনো বহু বছর পর্যন্ত থেকে যায়। এটি আমাদের মানসিক স্বাস্থ্যের ওপর গভীর ছাপ ফেলে। দৈনন্দিন কাজকর্ম করার সময় হঠাৎ হঠাৎ মনে হচ্ছে, এই বুঝি ঘর দুলছে, শরীরটা হঠাৎ কাঁপুনি দিয়ে উঠল, যা স্বাভাবিক কাজকর্মে ব্যাঘাত ঘটায়। প্রভাব পড়ে শিশু থেকে বয়োজ্যেষ্ঠ সবার মধ্যে।
আকস্মিক শারীরিক প্রতিক্রিয়া
• ভূমিকম্প শুরু হওয়ার মুহূর্তে শরীর স্বয়ংক্রিয়ভাবে ‘ফাইট–অর–ফ্লাইট’ অবস্থায় ঢুকে পড়ে।
• বুক ধড়ফড় করা।
• ঘাম হওয়া।
• হাত–পা কাঁপা।
• মাথা ঝিমঝিম করা।
• দ্রুত শ্বাস নেওয়া।
এসব প্রতিক্রিয়া স্বাভাবিক; এটি আমাদের শরীরের সেফটি সিস্টেম সক্রিয় হওয়া মাত্র।
মানসিক ধাক্কা ও আতঙ্ক: ভূমিকম্পের পর মানুষের মনে যে জিনিসটি সবচেয়ে বেশি দেখা যায়, তা হলো আতঙ্ক ও দুশ্চিন্তা। অনেকেই ভাবতে থাকেন, ‘আবার কি হবে?’ ‘আমি কি নিরাপদ?’ এই অনিশ্চয়তা তীব্র মানসিক চাপ তৈরি করে।
অতীত অভিজ্ঞতা জেগে ওঠা: যাঁরা আগে কোনো বড় দুর্ঘটনা, দুর্যোগ বা হঠাৎ ক্ষতির মধ্য দিয়ে গেছেন, তাঁদের পুরোনো স্মৃতি আবার জেগে উঠতে পারে। একে বলে ট্রিগারড রেসপন্স। এতে মানুষ আরও ভীত, আতঙ্কিত ও তটস্থ হয়ে পড়েন।
ঘুমের ব্যাঘাত: ভূমিকম্পের পর অনেক মানুষ রাতে ঘুমাতে পারেন না বা সামান্য শব্দেই ঘুম ভেঙে যায়। কেউ কেউ মনে করেন, বিছানাটি নড়ছে, যেন আবার কম্পন হচ্ছে।
শিশুদের ওপর প্রভাব: শিশুরা কম্পনকে পুরোপুরি বোঝে না, কিন্তু পরিবেশের আতঙ্ক অত্যন্ত দ্রুত ধরে ফেলে। তাদের মধ্যে দেখা দিতে পারে—
• বেশি কান্না
• মা–বাবার সঙ্গে লেগে থাকা
• রাতে দুঃস্বপ্ন
• হঠাৎ রেগে যাওয়া
এ সময়ে শিশুদের আশ্বস্ত করতে হবে। তাদের অনুভূতি শুনে নেওয়া খুব জরুরি।
দীর্ঘমেয়াদি মানসিক প্রভাব: কিছু মানুষের ক্ষেত্রে ভূমিকম্প ট্রমা রেসপন্স তৈরি করতে পারে। যেমন—
• অতিরিক্ত সতর্কতা
• মনোযোগ কমে যাওয়া
• উদ্বেগ বৃদ্ধি
• আবার ভূমিকম্প হবে, এই ভয়
এসব অনুভূতি দুর্যোগ–পরবর্তী কয়েক দিন চলা স্বাভাবিক। কিন্তু যদি কয়েক সপ্তাহের বেশি স্থায়ী হয়, এই সময় অবহেলা না করে মানসিক স্বাস্থ্য বিশেষজ্ঞের কাছে নিয়ে যাওয়া জরুরি।
এই সময় নিজেকে ও অন্যকে মানসিকভাবে স্থির রাখতে যা করতে পারেন
• শান্তভাবে শ্বাস নেওয়ার অনুশীলন। দুই মিনিটের গভীর শ্বাস মনকে স্থির করে।
• বাস্তবতা যাচাই করা। নিজেকে বলা, বুকের যে জায়গায় হার্টবিট হয়, সেখানে স্পর্শ করে বলা, ‘আমি এখন নিরাপদ। কম্পন থেমে গেছে।’ এটি মস্তিষ্ককে বর্তমান মুহূর্তে স্থির হতে সাহায্য করে।
• কারও সঙ্গে কথা বলা। পরিস্থিতির কথা শেয়ার করলে চাপ কমে। পরিবারের সদস্য, বন্ধু বা সহকর্মীর সঙ্গে আলাপ মন হালকা করে।
• শিশুকে আস্থা দেওয়া। তার পাশে বসুন, জড়িয়ে ধরুন, সহজ ভাষায় নিরাপত্তার কথা বলুন।
• অতিরিক্ত খবর এড়িয়ে চলুন, যে খবর আপনাকে প্যানিক করে। অতিরিক্ত নিউজ স্ক্রলিং উদ্বেগ বাড়ায়।
ভূমিকম্প একটি স্বাভাবিক প্রাকৃতিক ঘটনা। কিন্তু এর মানসিক অভিঘাত একদমই বাস্তব। ভয়, দুশ্চিন্তা, অস্থিরতা—এসব আমাদের মস্তিষ্কের স্বাভাবিক প্রতিক্রিয়া। নিজের ও আশপাশের মানুষের মনের অবস্থার প্রতি যত্নশীল থাকুন।
লেখক: সাইকোথেরাপিস্ট ও মানসিক–বিষয়ক প্রশিক্ষক, কনসালট্যান্ট, সিটি হাসপাতাল লিমিটেড এবং সভাপতি, ঢাকা মহানগর বন্ধুসভা।