ভবিষ্যতের জন্য অপেক্ষা নয়, আজকে বাঁচুন
নিজের জীবন নষ্ট করার নতুন নতুন উপায় খুঁজে বের করাটাই যেন বর্তমান যুগের অনেক তরুণের অন্যতম দক্ষতা! আমরা ঘণ্টার পর ঘণ্টা অনলাইনে থাকি, ফেসবুক স্ক্রল করি, রিলস দেখি। অথচ এই সময়ে চাকরির জন্য নিজের সিভিটাকে আরও ভালো মানের করা, কিংবা আত্মোন্নয়নমূলক দক্ষতা বৃদ্ধিতে কাজ করি না। ভাবতে থাকি, আসল জীবন তো এখনো শুরু হয়নি!
মনোবিজ্ঞানীরা এই প্রবণতাকে বলছেন ‘আগমনের ভ্রান্তি’। হার্ভার্ডের গবেষক টাল বেন-শাহার শব্দটি ব্যবহার করেছিলেন এমন এক মানসিক অবস্থাকে বোঝাতে, যেখানে আমরা ভাবি—একটা নির্দিষ্ট লক্ষ্য পূরণ হলেই জীবনে সুখ ও পরিতৃপ্তি আসবে। মনে হয়, ‘পড়াশোনা শেষ হলেই সুখী হব’, ‘প্রমোশন পেলে জীবনে আর সমস্যা থাকবে না’, ‘জীবনে সঠিক মানুষটা পেলেই সব ঠিক হয়ে যাবে’— আমরা মনে করি আসল জীবনটা এখন নয়, ভবিষ্যতে শুরু হবে।
কিন্তু নতুন দিন শুরু হওয়ার সঙ্গে সঙ্গে যদি একটু চেষ্টা করি—আজ থেকেই বেঁচে থাকা শুরু করা যায়।
কেন মস্তিষ্ক ‘ভবিষ্যৎ’কে এত ভালোবাসে
আমাদের মস্তিষ্ক বারবার ‘এরপর কী ঘটবে’ ভাবতে থাকে। এর কারণ খুঁজলে দেখা যায়, এটা বিবর্তনেরই ফল এবং একসময় এটা আমাদের বাঁচিয়ে রেখেছিল। মানুষের ইতিহাসের বেশির ভাগ সময়েই অলস থাকা ছিল বিপজ্জনক। যে মানুষগুলো টিকে গিয়েছিল, তারা ছিল ভবিষ্যৎ চিন্তায় পারদর্শী, যারা বিপদ বা সুযোগ আগে থেকেই আন্দাজ করতে পারত। আমরা সেই মানুষগুলোরই উত্তরসূরি। কিন্তু সমস্যা হলো, যে প্রবৃত্তি একসময় আমাদের বাঁচিয়েছে, আজ সেই একই প্রবৃত্তি আমাদের অস্থির রাখে।
গবেষণায় দেখা গেছে, মস্তিষ্কের আনন্দ হরমোন ‘ডোপামিন’, সবচেয়ে বেশি নিঃসৃত হয় যখন আমরা পুরস্কার পাওয়ার প্রত্যাশা করি, পুরস্কার পাওয়ার সময় নয়। একসময় এই প্রত্যাশা মানুষকে শীতের জন্য খাদ্য জোগাড়ে তাড়িত করত। আজ সেই একই প্রবৃত্তি আমাদের ই–মেইল রিফ্রেশ করতে বা নতুন লক্ষ্য স্থির করতে বাধ্য করে— ‘আরেকটা অর্জন করলেই’ পূর্ণতা পাব, এই ভ্রান্ত আশায়।
আমাদের মস্তিষ্ক ‘ভবিষ্যৎ’ প্রতিশ্রুতিতে আসক্ত। যদিও আমরা জানি ভবিষ্যৎ কখনো সত্যিকারে আসে না। হেডোনিক ট্রেডমিল বা ‘আনন্দের দোলাচল’ তত্ত্ব বলে, বড় কোনো সুখের ঘটনাও যেমন বিয়ে বা লটারিতে জেতা—কেবল অল্প সময়ের জন্য আনন্দ দেয়, তারপর মানুষ আবার আগের স্বাভাবিক অবস্থায় ফিরে যায়।
যে থিওরি পূর্বপুরুষেরা রক্ষা করেছিল, তা আজ আমাদের অশান্ত করে রেখেছে। আর ক্রমাগত প্রত্যাশার জীবনে আমরা যা ইতিমধ্যে পেয়েছি, তা উপভোগ করার সময় পাই না। এখন দায়িত্ব আমাদের মনের যে অংশটা ধীর, সচেতন আর চিন্তাশীল—সে যেন নতুন করে গল্পটা লেখে এবং মনে করিয়ে দেয়, জীবনের উদ্দেশ্য প্রস্তুতি নয়, বরং অংশগ্রহণ।
‘আসল জীবন তো এখনো শুরু হয়নি’ মনোভাবকে কীভাবে চ্যালেঞ্জ করবেন
আমরা খুব সহজেই এই ভ্রান্ত ধারণার ফাঁদে পড়ি। কারণ, আধুনিক জীবনের প্রায় সবকিছুই এটা আমাদের শেখায়। ছোটবেলা থেকেই আমরা ভালো নম্বর পাওয়ার জন্য দৌড়াই, যেন পরবর্তী সময়ে ভালো স্কুল-কলেজ-বিশ্ববিদ্যালয়ে ভর্তি হতে পারি। তারপর চাকরির পেছনে দৌড়াই, যেন পরের ধাপের জীবনযাপন সহজ হয়। এরপর স্থিতিশীলতা খুঁজি, যেন অবশেষে কথিত ‘আসল জীবন’ শুরু করা যায়।
কিন্তু প্রতিটি লক্ষ্য পূরণের পর আমরা দেখি, কিছুই ‘শেষ’ হয়নি, ঘড়িটা আবার নতুন করে শুরু হয়েছে কেবল। এই অভ্যাস সম্পর্কে সচেতন হওয়াটাই প্রথম ধাপ। কিন্তু এটুকু যথেষ্ট নয়, পরিবর্তনের জন্য কাজও শুরু করতে হবে। আসল ওষুধ হলো কাজ, আর সেই শুরুটা করা যায় নিজের সঙ্গে কথা বলার ধরন বদলানোর মাধ্যমে।
নিজেকে প্রশ্ন করুন: যখনই নিজেকে বলতে শুনবেন, ‘যখন আমি এটা শেষ করব…’ বা ‘একবার ওটা হয়ে যাক, তারপর…’—ঠিক তখনই একটু থামুন। তার বদলে নিজেকে জিজ্ঞেস করুন, ‘এই মুহূর্তে আমি কি জীবন উপভোগ করছি?’ অথবা ‘যেদিন লক্ষ্যে পৌঁছাব, সেদিন আজকের কোন জিনিসটার জন্য আমার মন কাঁদবে?’
মুহূর্তটা নিয়ে ভাবুন: শুধু খেয়াল করাটাই বিশাল পরিবর্তন আনতে পারে। হার্ভার্ডের এক গবেষণায় ২ হাজার ২০০ প্রাপ্তবয়স্ক মানুষের ওপর সমীক্ষায় দেখা গেছে—দিনে তারা যা করছে, প্রায় অর্ধেক সময় সেটি ছাড়া অন্য কিছু ভাবতে ব্যস্ত থাকে। আর এটিই সরাসরি সুখের মাত্রা কমিয়ে দেয়।
একটি পরীক্ষা: ভাবুন, জীবনের একেবারে শেষ মুহূর্তে আপনি আজকের কোন মুহূর্তটার জন্য সবকিছু দিতে রাজি থাকবেন—শুধু একবার সেই মুহূর্তে ফিরে যাওয়ার সুযোগ পেলে? প্রশ্নটা আমাদের শেখায়, বর্তমানের সাধারণ সময়গুলোর মধ্যেই জীবনের আসল সৌন্দর্য লুকিয়ে আছে।
আপনি চাইলে ভবিষ্যতের দিকে না তাকিয়ে, অতীতের দিকেও তাকাতে পারেন। ফলাফল একই হবে। ভাবুন, আজ থেকে ১০ বছর আগের আপনাকে। সে সময়ের আপনি যদি আজকে আপনার যে জ্ঞান, অভিজ্ঞতা আর সুযোগ-সুবিধা আছে সেগুলো নিয়ে জীবন শুরু করতে পারতেন, তাহলে কেমন হতো? তখনকার আপনি হয়তো আজকের এ অবস্থাকে স্বপ্ন হিসেবেই দেখেছিলেন।
সুখের পেছনে দৌড় নয়, শান্তিতে থাকার অনুশীলন করুন
প্রতিদিন নতুন কিছু অর্জনের পেছনে না ছুটে, বরং ‘তৃপ্তি’ নিয়ে প্রতিটি মুহূর্ত উপভোগ করার চর্চা করুন। গবেষণায় দেখা গেছে, যারা প্রতি সপ্তাহে কৃতজ্ঞতার ছোট্ট তালিকা লেখে—অর্থাৎ কোন কোন বিষয়ে তারা কৃতজ্ঞ, সেগুলো শুধু লিখে রাখে; তারা সময়ের সঙ্গে সঙ্গে অনেক বেশি সুখী ও আশাবাদী হয়ে ওঠে।
এই ধারণা আমাদের শেখায় যে আনন্দ মানেই বড়, জাঁকজমকপূর্ণ কিছু নয়, বরং আসল আনন্দ বেশির ভাগ সময়ই নিঃশব্দ ও শান্ত।
আজ থেকেই চেষ্টা করুন জীবনকে ছোট ছোট সুন্দর মুহূর্তে খুঁজে নিতে—সদ্য বানানো কফির গন্ধে, নিজ হাতে বানানো রান্নার স্বাদে, প্রিয়জনকে কিছু উপহার দিয়ে বা সূর্যাস্তের আলোয় জানালায় পড়া এক ফালি সোনালি রোদে। এই ছোট মুহূর্তগুলোই একসঙ্গে মিলে আমাদের জীবনের পুরো ছবিটা গড়ে তোলে।
আর মনে রাখুন—আগামীকাল যখন আসবে, তা আজকের চেয়ে বিশেষ কিছু নয়। কারণ, ‘বিশেষ’ তো আপনি ইতিমধ্যে উপভোগ করছেন।
সূত্র: সাইকোলজি টুডে