প্রত্যাশা কীভাবে আমাদের বাস্তবতা গড়ে তোলে
প্রায়ই মনে করি, আমরা বাস্তবতাকে নিরপেক্ষভাবে দেখি—বাস্তবতা যেমন, তেমনটাই। কিন্তু সত্যটা হলো, বেশির ভাগ সময়ই আমরা যা আশা করি বা প্রত্যাশা করি, সেটাই দেখি।
মস্তিষ্ক একটি সক্রিয় ভবিষ্যদ্বাণী যন্ত্র। এটি অনুমান করে পরবর্তী সময়ে কী ঘটতে পারে এবং আমাদের অভিজ্ঞতার ওপর ভিত্তি করে এই অনুমানগুলো আপডেট করে। আমাদের প্রতিটি ধারণা, অনুভূতি এবং সিদ্ধান্ত এই ভবিষ্যদ্বাণীর সঠিকতার ওপর নির্ভর করে। সময় যত যায়, এই অনুমানগুলো প্রত্যাশায় পরিণত হয়। এ প্রত্যাশাগুলোই মানুষের ব্যক্তিত্ব ও জীবনধারাকে গড়ে তোলে।
কীভাবে অনুমান প্রত্যাশায় পরিণত হয়
শৈশব থেকেই মস্তিষ্ক জীবনের প্যাটার্ন শিখতে শুরু করে। প্রতিটি মুহূর্তই একটি পরীক্ষা। আমরা কিছু করি, কিছু ঘটে, আর যা আশা করেছি এবং যা ঘটেছে তার মধ্যে পার্থক্য মস্তিষ্ককে শিখতে সাহায্য করে।
যদি প্রত্যাশার চেয়ে ভালো কিছু ঘটে, ডোপামিন নামের হরমোন সক্রিয় হয়। তখন সেই আচরণ পুনরায় করার প্রবণতা বাড়ায়। যদি ফলাফল হতাশাজনক হয়, ডোপামিনের পরিমাণ কমে যায়। তখন আমরা শিখি যে এ ধরনের কাজ এড়ানো উচিত।
এই হরমোনের পরিবর্তন আমাদের শেখায়—মানুষ আমাদের প্রতি কীভাবে প্রতিক্রিয়া জানায়, কোন চেষ্টা ফলপ্রসূ হয়, কোন অনুভূতি প্রকাশ করা নিরাপদ। যদি কেউ এমন পরিবেশে বেড়ে ওঠে, যেখানে স্থিরতা আছে, সে শেখে যে চেষ্টা ও বিশ্বাস থাকলে একসময় ফল পাওয়া যায়। আর যদি কেউ বিশৃঙ্খল বা উদাসীন পরিবেশে থাকে, সে শেখে যে চেষ্টা ও বিশ্বাসে কিছু হয় না, ভাগ্য লাগে।
এই শেখার অভিজ্ঞতাগুলো আমাদের অনুভূতি, কাজ ও সম্ভাবনার ওপর প্রত্যাশার ভিত্তি তৈরি করে।
জৈবিক কারণ
অভিজ্ঞতা আমাদের শেখায়। আর জৈবিক উপাদানগুলো সেই শেখা নিয়ন্ত্রণ করে। ডোপামিন, সেরোটোনিন ও নোরঅ্যাড্রেনালিন এই প্রক্রিয়ার মূল নিয়ন্ত্রক। এগুলো নির্ধারণ করে—আমরা পূর্বের ভুল থেকে কতটা শিখি, ভবিষ্যতে কতটা চিন্তা করি এবং ঝুঁকি ও নিরাপত্তার মধ্যে কীভাবে ভারসাম্য রাখি।
• ডোপামিন: এই হরমোন প্রত্যাশার চেয়ে ভালো কিছু ঘটলে সক্রিয় হয়। অনুসন্ধান ও লক্ষ্যপূরণের শক্তি বাড়ায়।
• সেরোটোনিন: তাৎক্ষণিক আগ্রহ নিয়ন্ত্রণ করে। ধৈর্য, সন্তুষ্টি ও মানসিক শান্তি দেয়।
• নোরঅ্যাড্রেনালিন: সতর্কতা ও মনোযোগ নিয়ন্ত্রণ করে। অর্থাৎ আমাদের অনুমানের ওপর কতটা আত্মবিশ্বাস আছে তা ঠিক করে।
ট্রমা, চাপ ও অনুমান: যখন জীবনের আঘাত মস্তিষ্ককে সঠিকভাবে অনুমান করতে ভুল করে, তখন অনুমানের সিস্টেম নিজেই পরিবর্তিত হয়।
তীব্র ট্রমার সময়: তীব্র ট্রমার সময়, নোরঅ্যাড্রেনালিন ও কোর্টিসল হরমোনের বৃদ্ধি বিপদের স্মৃতি স্নায়ুতন্ত্রে অত্যন্ত স্পষ্টভাবে ছাপিয়ে দেয়।
দীর্ঘস্থায়ী চাপ বা কষ্ট: লম্বা সময় ধরে প্রতিকূল পরিস্থিতিতে থাকলে বিপরীত সমস্যা দেখা দেয়। ডোপামিন রিসেপ্টর কম সক্রিয় হয়; সেরোটোনিনের সংকেত দুর্বল হয়ে যায়। ইতিবাচক বা আনন্দদায়ক ঘটনা আর কোনো প্রভাব ফেলে না। পৃথিবী ধূসর মনে হয়, চেষ্টা অর্থহীন মনে হয়।
অনুমান শক্তি আবার জাগিয়ে তোলা
আমাদের মস্তিষ্কের অনুমান–ক্ষমতা স্থির নয়, নমনীয়। যে সিস্টেম ভয় শিখেছিল, সেটি নিরাপত্তা শিখতেও পারে; যে ব্যবস্থায় হতাশা শিখেছে, সেটি নতুন করে বিশ্বাস ও ক্ষমতা শিখতে পারে।
১. ভাষা ও সচেতনতা:
আমাদের অনুমানগুলোকে শব্দে প্রকাশ করা মানে তা পুনর্মূল্যায়নের সুযোগ পাওয়া। যেমন কথামূলক থেরাপি বা মাইন্ডফুলনেস। কোনো ভাবনা বা অনুভূতিকে নামকরণ করলে তা অচেতন হরমোন মডেল থেকে স্পষ্ট সচেতনতার অংশে আসে, যেখানে তা প্রশ্ন করা যায়।
সাংগঠনিক বা জ্ঞানমূলক থেরাপি ইচ্ছাকৃতভাবে অনুমানের ত্রুটি তৈরি করে। আপনি ভিন্নভাবে আচরণ করেন, ভিন্ন ফলাফল দেখেন আর মস্তিষ্ক সেই অনুযায়ী আপডেট হয়। সচেতনতা স্বয়ংক্রিয় ভবিষ্যদ্বাণীকে পরীক্ষাযোগ্য অনুমানের পর্যায়ে নিয়ে আসে।
২. গল্প ও অর্থ:
মানুষ গল্প বলার প্রাণী। আমরা আমাদের অভিজ্ঞতাকে সংগতি দেওয়ার জন্য গল্প ব্যবহার করি। আর এই গল্পগুলো আমাদের সম্পর্কে ওপরের দিক থেকে অনুমান তৈরি করে। গল্পের দৃষ্টিভঙ্গি বদলানো (দুর্বলতার পরিবর্তে টিকে থাকার গল্প দেখা, ক্ষতির পরিবর্তে শেখার গল্প দেখা) মস্তিষ্কের মডেলকেও পরিবর্তন করে, যা নতুন ঘটনার ব্যাখ্যা করতে সাহায্য করে।
অর্থ মানে মস্তিষ্ককে অনিশ্চয়তা সহ্য করার কারণ দেয়; এটি নতুন প্রমাণকে গ্রহণ করার জন্য স্থান বাড়ায়।
সূত্র: সাইকোলজি টুডে