টাকা কি সত্যিই সুখ কিনতে পারে, কী বলছে গবেষণা
অনেক সময় মনে হয়—সুখ বা দুঃখ নির্ভর করে ব্যাংক ব্যালান্সের ওপর
টাকা আমাদের জীবনের, পরিচয়ের এবং মানসিক সুস্থতার গুরুত্বপূর্ণ অংশ। অনেক সময় মনে হয়—সুখ বা দুঃখ নির্ভর করে ব্যাংক ব্যালান্সের ওপর। কখনো আমরা নিজেরাই নিজেদের বলি, ‘যদি বেতন বাড়ত, আমি আরও ভালো থাকতাম’ বা ‘যদি পারিবারিক সম্পদ আরও বেশি থাকত, জীবন কত সহজ হতো!’—এমন ভাবনা আমরা প্রায় সবাই করি।
কিন্তু মনোবিজ্ঞানের গবেষণা কি সত্যিই বলে, টাকা আমাদের সুখ বাড়াতে পারে? আসুন, বিষয়টি সহজভাবে দেখি।
আয় বাড়লে কি সুখও বাড়ে
১০ বছর আগে এক হাজার জনের ওপর একটি জরিপ করেছিল গবেষণা প্রতিষ্ঠান গ্যালাপ। সেখানে উঠে এসেছিল— যাঁদের আয় বেশি, তাঁরা সাধারণত বেশি সুখী। তবে চাহিদার বাইরে অতিরিক্ত আয় মানসিক সুখে তেমন প্রভাব ফেলে না। অর্থাৎ যখন মৌলিক চাহিদা আর কিছু বাড়তি প্রয়োজন পূর্ণ হয়, তখন আরও অর্থ মানসিক সুখে বড় ভূমিকা রাখে না।
সুইডেনে লটারিজয়ীদের ওপর গবেষণায় দেখা গেছে—লটারি জেতা মানুষেরা সাধারণ মানুষের তুলনায় দীর্ঘ সময় ধরে জীবনে বেশি সন্তুষ্ট, মানসিকভাবে সুস্থ এবং কঠিন পরিস্থিতি (যেমন অসুস্থতা বা একাকিত্ব) মোকাবিলায় বেশি প্রস্তুত। অর্থাৎ অর্থের প্রাচুর্য কিছু পরিস্থিতি মোকাবিলা সহজ করে দেয়।
গবেষণায় দুই ধরনের সুখ দেখা হয়—
• মূল্যায়নমূলক সুখ: আপনার জীবন কেমন যাচ্ছে, তা আপনি কীভাবে মূল্যায়ন করছেন।
• অভিজ্ঞতালব্ধ সুখ: আপনি প্রতিদিন কী অনুভব করছেন, ইতিবাচক ও নেতিবাচক আবেগের অনুপাত কেমন।
বেশি আয়ের মানুষদের ক্ষেত্রে গবেষকেরা মূলত অভিজ্ঞতালব্ধ সুখকে মেপেছেন। তবে এ ধরনের সুখ সব দেশে একরকম নয়।
যুক্তরাষ্ট্রে গবেষণায় দেখা গেছে, বেশি আয়ের সঙ্গে অভিজ্ঞতালব্ধ সুখ বেড়ে যায়। কিন্তু মেক্সিকোর ইউকাতান অঞ্চলের দরিদ্র মায়া জনগোষ্ঠীর ক্ষেত্রে ধনসম্পদ সুখের সঙ্গে সরাসরি সম্পর্ক রাখে না। তাদের সামগ্রিক সুখের মাত্রা তবু বেশি।
গ্যালাপ ওয়ার্ল্ড পোলের বহুজাতিক গবেষণায় দেখা গেছে, বেশি আয়ের মানুষ জীবনকে মূল্যায়ন করতে পারে। কিন্তু অভিজ্ঞতালব্ধ সুখ নির্ভর করে শেখা, স্বাধীনতা, সম্মান ও সামাজিক সম্পর্কের মতো বিষয়গুলোর ওপর।
গবেষণায় দেখা গেছে, যাঁরা পরিশ্রম ও নিজ যোগ্যতায় ধনসম্পদ অর্জন করেছেন, তাঁরা উত্তরাধিকার সূত্রে সম্পদ পাওয়া মানুষের তুলনায় বেশি সুখ অনুভব করেন। অর্থাৎ স্বপ্ন দেখা ও পরিশ্রম করা কেবল অর্থ নয়, সুখও এনে দেয়। তবে লক্ষ্য পূরণের পথে নিজের মানসিক সুস্থতা বিসর্জন দেওয়া উচিত নয়।
সুখের বিভিন্ন ধরন
সুখ কেবল একটি অনুভূতি নয়। এতে রয়েছে—উচ্ছ্বাস, সন্তুষ্টি, কৃতজ্ঞতা, ভালোবাসা, সহমর্মিতা, গর্ব ও শান্তি। গবেষণা দেখিয়েছে, ধনী মানুষদের মধ্যে নিজের প্রতি ইতিবাচক অনুভূতি (গর্ব, সন্তুষ্টি) বেশি; অন্যদিকে তুলনামূলকভাবে কম সম্পদশালী মানুষের মধ্যে অন্য মানুষের প্রতি ইতিবাচক অনুভূতি (ভালোবাসা, সহমর্মিতা) বেশি।
সুইডেনের লটারিজয়ীদের ক্ষেত্রে দেখা গেছে, সামাজিক সম্পর্ক বা বন্ধু-পরিবারের সম্পর্ক সাধারণ মানুষের তুলনায় আলাদা হয়নি। অর্থাৎ টাকা সামাজিক সম্পর্ককে বদলাতে পারে না। লটারিজয়ীদের হাতে বেশি অবসর সময় থাকে—এটাই তাদের জীবনে সন্তুষ্টির মূল কারণ। ভাবুন, যদি আমাদের পর্যাপ্ত আর্থিক নিরাপত্তা থাকত, আমরা আমাদের প্রিয় কাজে সময় দিতে পারতাম, সারাক্ষণ আয় বাড়ানোর চাপ না থাকলে কি আরও সুখী হতাম না?
টাকা নিজে সুখ দেয় না। এটি সময়, মানসিক শান্তি, নিরাপত্তা, উদারতা ও নিরাপত্তার অনুভূতি এনে দিতে পারে। টাকা জীবনকে এমন জায়গা তৈরি করে, যেখানে সত্যিকারের সুখ বিকশিত হতে পারে।
আমরা আমাদের জীবন এবং সম্পদ যেমন চাই, তেমনভাবে গড়ে তুলি। ধনী হওয়া কিছুটা সুখ এনে দিতে পারে, তবে একমাত্র পথ নয়। স্বাস্থ্য, সহমর্মিতা, সামাজিক সম্পর্ক, ভালোবাসা, আত্মগর্ব—এগুলোও সুখের মূল। তাই আমরা চাইলে প্রত্যেকেই মানসিকভাবে ধনী হতে পারি।
সূত্র: সাইকোলজি টুডে