এই জীবনই কি আমি চেয়েছিলাম

অলংকরণ: মাসুক হেলাল
আজকে ফিরতে ফিরতে ভেবেছি, আগামীকাল ফোনে নানার সঙ্গে কথা বলব। নানাকে জানাব, ‘এই জীবনটাই কি আমি চেয়েছিলাম?’

‘মানুষ শেষ পর্যন্ত তার ইচ্ছার জীবনটাই যাপন করে। অর্থাৎ একজন মানুষ যে জীবনকে গড়ে তুলতে চায় মনের আয়নায়, সেই জীবনই সে যাপন করে। আরও সোজা করে বললে, তুমি আজকে যা হয়েছ, একদিন তুমি তা–ই হতে চেয়েছিলে।’
ওপরের কথাগুলো নিজের নয়, ধার করা কথা। কিন্তু কথাগুলো কি এই জীবনের সঙ্গে মেলে?

একটু পেছনে ফেরা যাক। মাত্র ৩০ বছর আগে, তখন ইন্টারমিডিয়েট পরীক্ষা দেব বা কলেজে দ্বিতীয় বর্ষে। বাবার কর্মসূত্রে এক আঙ্কেলের মাকে নানি ডাকি। একদিন নানির বাসায় বেড়াতে গেছি সাভার থেকে। ঢাকার মিরপুর ১১ নম্বরের পূরবী সিনেমা হলের কাছে ছায়াঘেরা এক দ্বিতল বাড়ি। ওই বাড়ির প্রধান মানুষ মানে আঙ্কেলের মা-নানি আমার খুব কাছের বন্ধু—খুব বিচক্ষণ আর বুদ্ধিদীপ্ত মানুষ। নানির সঙ্গে বন্ধুত্বের গভীরতার অনেক গল্প জমে আছে; কিন্তু আজকে নানির কথা নয়, বরং নানির আপন ভাই যাঁকে এই জীবনের একজন সেরা মানুষ বিবেচনা করে আসছি গত ৪৫ বছর; সেই ড. শেখ আব্দুল ওয়াহাব নানার কথা বলতে চাই। মনে রাখা দরকার, কথা শুরু করেছিলাম, মানুষ তাঁর ইচ্ছা অনুযায়ী জীবন যাপন করে এই কথা দিয়ে।

তো ওই বাসায় সেদিন বেড়াতে গেছি, অবসন্ন দুপুর, শ্রান্ত, পড়ন্ত বেলা, দুপুরের খররোদ ছাপিয়ে বাতাস আসে নানির খোলা জানালা দিয়ে, সেই ১৯৮৮ সালের ঢাকা। স্বভাব অনুযায়ী হইচই শুরু করব, এমন সময় নানি বললেন, ‘দাদু, তোমার আরও এক নানা, মানে আমার বড় ভাই লন্ডন থেকে এসেছেন, তুমি তো তাঁকে চেনো না। উনি একটু বিশ্রাম করছেন পাশের ঘরে, তুমি একটু চুপ করে বসো।’
তা–ই কি হয় নাকি? আমি কি কোনো দিন সেই মেয়ে নাকি?
লন্ডন থেকে কে এসেছেন, সেটা জানতে হবে না?

নানির কথার অবাধ্য হয়ে পাশের ঘরে যাই। দেখি, ইজিচেয়ারে আধশোয়া হয়ে চোখ বুজে আছেন একজন পশ্চাশোর্ধ্ব বয়স্ক মানুষ, চোখে কালো মোটা ফ্রেমের চশমা, বয়স ৬০-৬৫ হবে হয়তো। আমি নানার কাছে গিয়ে বসে ওনার হাত টেনে নিয়ে নিজের কোলের ওপরে রাখি। নানা বলেন, ‘দাদু তোমার সঙ্গে তো এখন কথা বলব না, কথা বলতে ইচ্ছে হচ্ছে না। বরং তুমি পাশের ঘর থেকে রবীন্দ্রনাথের “গীতাঞ্জলি” নিয়ে ২৬৭ নম্বর পাতা থেকে “শাহজাহান” কবিতাটা পড়ে শোনাও।’
আমি তা–ই করি এবং কবিতা শেষে দেখতে পাই, নানার চোখের দুই কোনা বেয়ে নোনাজল গড়িয়ে যাচ্ছে। ওই ১৮-১৯ বছর বয়সেই প্রথম দেখি, একজন বয়স্ক মানুষ কবিতা শুনে কাঁদছেন। এরপর নানার সঙ্গে আমার দেখা হয়েছে আরও পাঁচ-ছয়বার। ধীরে ধীরে জানতে পারি, বাংলাদেশের দর্শনশাস্ত্রে নানা একজন কিংবদন্তিতুল্য শিক্ষক। দীর্ঘজীবন লন্ডনে নানা দর্শনের অধ্যাপক ছিলেন। বাংলাদেশে এম এম লেভেলে নানার দুইটি পাঠ্যবই আছে। আমি আমার বিশ্ববিদ্যালয়জীবনের অনার্স থেকে মাস্টার্স অবধি—সব পরীক্ষা নানার কিনে দেওয়া কলম দিয়ে পরীক্ষা দিয়েছিলাম।

আরও পড়ুন

সেই নানা আজও বেঁচে আছেন, কথা হয় ফোনে। গত ২৫ বছর নানার সঙ্গে দেখা হয়নি। কিন্তু আমার কাছে আছে নানার লেখা ২০-২৫টি চিঠি। কানাডায় আসার পর নানা লিখেছিলেন আমাকে। একটা ব্যক্তিগত ব্যাগপ্যাক আছে। সেখানে জমানো দামি কিছু স্মৃতি রাখা আছে—নানার চিঠি, আরও কিছু কাগজপত্র, যা আমি কোনো অঙ্কের টাকা দিয়ে কিনতে পারব না এই জীবনে।

নানার সঙ্গে যখন কথা হয়, তখন বুঝতে পারি, নানা কি পরম মমতা থেকে আমাকে মনে রেখেছেন। ৯০ বছর বয়স নানার। লন্ডনে যখন ফোন করি, নানি ওপরতলা থেকে ফোন ধরেন। নানির কাছে থেকে নানার প্রাথমিক কিছু খবর নিই, যেমন নানা কী করে সময় কাটান, শরীর কেমন, লেখালেখি করতে পারেন কি না, সব খেতে পারেন কি না ইত্যাদি। এরপর নানি ফোনটা নানাকে দেন। নানা ফোন ধরেই বলেন, ‘দাদু, আমি তোমাকে দেখতে পাচ্ছি, তোমার পাঠানো বই আর লেখাগুলো যখন ছুঁয়ে থাকি, তখন তোমার ভালোবাসা টের পাই দাদু।’

সেই ১৯৯০ সাল। একদিন জাহাঙ্গীরনগর বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষক বাস থেকে নানাকে ধরে এনেছিলাম আমাদের সাভারের পিএটিসির বাসায়। নানা তখন জাবির ভিজিটিং প্রফেসর। নানা বলেছিলেন, ‘বুলি (আমার মায়ের নাম), আমি তোমার মেয়েদের গান শুনি, আর তুমি আমার জন্য ছোট চিংড়ি দিয়ে কচি লাউ রান্না করো।’
সেদিন দুপুরে শাহিন আর বড় আপা নানাকে অনেকগুলো রবীন্দ্রসংগীত শোনাল। এখন আর মনে নেই, কোনো একটা গান শুনে নানা বললেন, ‘গত বছর সুচিত্রা মিত্র লন্ডনে আমার বাসায় এই গান গেয়েছিল। আজকে তোমাদের গলায় শুনলাম।’ আমরা চার বোন এত অবাক হয়েছিলাম, সুচিত্রা মিত্র গিয়ে নানাকে গান শোনালেন আর সেই মানুষ আবার আমাদের গান শুনছেন?

এরপর নানা আমাদের চার বোনকে একটা বই দিয়েছিলেন। বইটা এ মুহূর্তে আমার র‍্যাকে, নাম ‘সূর্যাবর্ত’, রবীন্দনাথের কবিতা সংকলন। বইয়ে নানা আমাদের চার বোনের নাম লিখতে গিয়ে সবার ওপরে বড় করে আমার নাম লিখে পরের লাইনে ছোট ফন্টে বাকি বোনদের নাম এক কাতারে লিখেছিলেন। বই ধরেই বড় আপা আর শাহিন বলে, ‘এটা কোনো গিফট হলো? মেজ আপার নাম এত বড় আর আমাদের নাম এত ছোট কেন?’ নানা হেসে বলেছিল, ‘তোমরা চাইলে আমি তোমাদের নাম কেটেও দিতে পারি; কিন্তু লুনার কারণেই তো তোমাদের পাওয়া, তাই না? এটা কী করে অস্বীকার করি বলো?’

এবার ফিরি সেই প্রথম লাইনে, মানুষ তার ইচ্ছার জীবনটা যাপন করে। নানা আমাকে একবার এক চিঠিতে লিখেছিলেন, ‘দাদু, তোমার জীবনের গতিপথটা যে সরলরেখার মতো করে যায়নি, তাতে আমি একটুও অবাক হই না। আসলে সত্যিকারের চলার পথে কখনো দোসর জোটে না। এই যে জাহাজের নাবিকের মতো তুমি জীবনটাকে নিয়ন্ত্রণ করছ, সেখানে সময় সময় লেখালেখি দিয়ে তুমি পেছন ফিরে দেখতে পাচ্ছ, তোমার চলার দিকনিদর্শন ঠিক আছে কি না, তুমি ঠিক পথে যাচ্ছ কি না—এসব সৌভাগ্যকে তুমি অনেক বড় করে দেখবে। তাহলে দেখো কষ্ট কমে আসবে, কাঁদতে যে পারে তার মতো সুখী কয়জন আছে দাদু?’

কোনো কোনো দিন অফিস থেকে ফিরলে কোনো কাজ থাকে না। বিশেষ করে সামারের এই লম্বা বিকেলে আমি একান্ত ভুবনে বসি। পড়ার টেবিলে বসে এই শহরের অপরূপ রূপ দেখি। তখন অতীত মনে পড়ে, ফেলে আসা সময় অক্টোপাসের মতো গিলতে থাকে, আমি কিছুতেই বুঝতে পারি না নিজের এই লেখার প্রথম প্যারা কি ঠিক?

আজকে ফিরতে ফিরতে ভেবেছি, আগামীকাল ফোনে নানার সঙ্গে কথা বলব। নানাকে জানাব, ‘এই জীবনটাই কি আমি চেয়েছিলাম?’

২৭ এপ্রিল ২০১৮

টরন্টো, কানাডা