করোটির কথামালা (পর্ব ১৬)
ভালোবাসার গ্রামের নাম ‘পাই’।
ভীষণ শীতের বাতাসে গাড়ি অবধি দুলছে, হেঁটে চললে সত্যিকার অর্থেই বাতাসে উড়ে যাওয়ার দশা। কিন্তু আজ সকালেও আবহাওয়া এমন হিংস্র ছিল না। ভোরের নরম আলোয় যখন হেঁটে অফিসে যাচ্ছিলাম, তখন বাতাস শান্ত, ভারী একটা শাল পরেছিলাম, পাতলা জ্যাকেট ছিল গায়ে; কিন্তু সেই একই দিনে বিকেলে যখন দল বেঁধে ডাউনটাউন টরন্টোতে আমরা চারজন হাঁটছিলাম, তখন ভীষণ বাতাসে বারবার মনে হলো—তাহলে কি ১৪ বছর আগে শোনা সেই মিথ সত্য?
কানাডায় নতুন এসেছি সেই বছর, ২০০৪ সাল। একজন প্রবাসী বাঙালি বললেন, ‘লুনা, এই কানাডায় তিনটা ডব্লিউকে বিশ্বাস নেই—ওয়েদার, ওয়ার্ক, ওম্যান।’ কথাটা অন্য তিনজন সহকর্মীর সঙ্গে শেয়ার করতেই ওরা ঝড়ের বাতাসের মতোই হেসে ওঠে। আসুন, ভালোবাসার পাই রেস্টুরেন্টে আজকের সন্ধ্যার বাকি চারজনের সঙ্গে পরিচিত হওয়া যাক।
তিব্বতের মেয়ে সাঙ্গে, টরন্টোতে এসেছে সাত-আট বছর আগে। দুই সন্তানের জননী সাঙ্গে বয়সে আমার চেয়ে ১০-১২ বছরের ছোট। সে কাজে ভীষণ দক্ষ। কস্টি ইমিগ্র্যান্ট সার্ভিসে সাঙ্গে যে কাজের সঙ্গে জড়িত আছে সাত-আট বছর ধরে, সেখানে আমার অভিজ্ঞতা মোট দেড় বছরের না। অফিসে সাঙ্গে আমার সবচেয়ে বেশি কাছের। যেকোনো সহযোগিতায় সবার আগে সাঙ্গের কাছে নিজেকে খোলাসা করি। মূলত সাঙ্গে তিব্বতের মেয়ে হলেও বড় হয়েছে নেপালে। ছোটখাটো ভীষণ মিষ্টি মেয়ে সাঙ্গে হিন্দি বলতে পারে। মাত্র এক বছর আগে সে জয়েন করেছে আমাদের টিমে। আমরা দুজন এশিয়ার পাশাপাশি দেশ নেপাল, বাংলাদেশ, তিব্বত—আমাদের ভাষা ভিন্ন হলেও সংস্কৃতি, মূল্যবোধ আর জীবনযাপন ১০০তে ৯৯ ভাগ মিল আছে। আজকের সন্ধ্যায় সাঙ্গে আমার দুই চেয়ার দূরে বসলেও জানি সে আমার সঙ্গেই আছে।
মিকো বেথলেহেম এসেছে ইথিওপিয়া থেকে। যখন ওর বয়স দুই-তিন বছর তখন ওর মা–বাবা কানাডায় পাড়ি জমায় নতুন অভিবাসী হয়ে। মিকো আমাদের টিমের হাউজিং কাউন্সিলর। কস্টি শেল্টার সার্ভিসে যে টিমে আমি মাত্র দেড় বছর কাজ করছি, মিকো এখানে কাজ করছে তিন বছর হলো। ৩৮-৩৯ বছরের এই ছাই রঙের কালো মেয়েকে আমি এতটাই মুগ্ধ হয়ে দেখি যে এক দিন ওকে হাত ধরে বলেই ফেললাম, ‘তোমার সঙ্গে জীবন কাটাতে পারে, এমন পুরুষ কি জন্মেছে এই ধরণিতে?’ মিকো হেসে বলে, ‘মাহমুদা, উ লাভ মি সো মাচ।’
২০ বছর আগে মিকো যে হাইস্কুল থেকে পাস করেছে; মাত্র তিন বছর আগে নাইয়া সেই স্কুল থেকে পাস করেছে। মিকোকে বলে রেখেছি, ‘একদিন তোমার মা–বাবার কাছে যাব। জানতে চাইব সেই ছোটবেলায় তোমাকে এই বিশাল দেশে নিয়ে এসেছেন তাঁরা; কিন্তু কী করে তুমি এমন অসম্ভব শক্তিতে তোমার নিজের ভাষা, মূল্যবোধ এবং সংস্কৃতি ধরে রেখেছ।’
মিকোকে জানলে যে কেউ একজন শক্তিশালী ইথিওপিয়ান মানুষকে দেখতে ও জানতে পারবে। স্রোতে গা ভাসিয়ে চলা এই সময়ে মিকোদের বড্ড প্রয়োজন। আজকের সন্ধ্যায় মিকো বসেছে আমার কোনাকুনি চেয়ারে।
ফরিদ জর্জের মূল বাড়ি ইরাকে, কিন্তু টরন্টোতে এসেছে স্কুল বয়সে। কস্টিতে কাজ করছে তিন-চার বছর হবে। আমাদের আজকের সন্ধ্যায় ফরিদ একমাত্র মেল ফিগার। বয়সে ক্রন এই যুবক এখনো ৩০-এ পৌঁছায়নি। আমাদের সঙ্গে কাজ করেছিল মাত্র আট মাস। এখন ও কস্টির অন্য লোকেশনে কাজ করে। দেখা হওয়ার প্রথম দিন থেকেই ফরিদের সঙ্গে আমাকে চুক্তি হয়, ও আমাকে আজন্ম হানি ডাকবে, আমি ওকে ডাকব হান। মূলত আজকে ফরিদের সঙ্গে দেখা করতেই এই আয়োজন।
অসাধারণ এই সন্ধ্যার শেষ কুশীলব আমার পাশের চেয়ারে বসা দুনিয়া আল দালাল। মূল বাড়ি ইরানে, কিন্তু বড় হয়েছে থাইল্যান্ডে। অফিসেই পাঁচ ওয়াক্ত নামাজ পড়া মেয়ে দুনিয়া ভীষণ সুন্দর দেখতে; যেমন ফিগার, তেমনি অমায়িক আচরণ, লালচে সাদার সঙ্গে দুধে আলতা গায়ের রং ওর, কোথাও কোনো বাড়তি মেদ নেই। যেমন কাজ জানে, তেমনি জানে কী করে নিজের যত্ন নিতে হয়।
দুনিয়া আল দালাল, টিমের শেষ মেয়ের নাম। সে আমাদেরকে গত কয়েক সপ্তাহে পই পই করে বলেছে— ‘চলো চলো থাই ফুড খেতে যাই। একদিন অফিস শেষে শুক্রবারে আমরা সবাই রেস্টুরেন্টে বসব, আড্ডা মারব, থাই স্যুপ আর নুডলস খাব। প্লিজ চলো যাই।’
পাঁচজনের এই টিমে শুধু সাঙ্গে আর আমার সন্তান আছে। ঘরে ফেরার তাড়া আছে। বাকি সবাই কনফার্ম ব্যাচেলর—আর চিন্তা কী? সাঙ্গে আর আমি নিজেদের বলি, ‘চলো যাই, একঘেয়ে এই জীবন থেকে দুঘণ্টার জন্য তো মুক্তি মিলুক।’ কিন্তু থাই স্যুপ খাবার এই জমজমাট রেস্টুরেন্টে ঢুকে ভীষণ অবাক হয়ে যাই; এত ভিড়, এত ভিড়, এত ভিড়—সবার আগে পৌঁছে যাওয়া ফরিদ প্রায় ৫৫ মিনিট লাইনে দাঁড়িয়ে একটা টেবিল বুক করতে পেরেছে। কেন এত ভিড় এখানে? থাইল্যান্ডে ২০ বছর কাটানো দুনিয়া জানাল সেই ‘ভালোবাসার গ্রামের গল্প’।
পৃথিবীর ম্যাপে বাংলাদেশের চেয়ে আয়তনে অল্প বড় দেশ থাইল্যান্ড। সেখানকার এক ছায়াঘেরা গ্রামের নাম ‘পাই’। অনেক অনেক বছর আগে, টরন্টো থেকে ২০-২১ বছরের এক ত্রুনী, যিনি পেশায় নার্স, তিনি গিয়েছিলেন নিজের গ্রামে, যেই গ্রামের নাম ‘পাই’। সেখানেই এক হাতি চড়ার বিকেলে পরিচয় হয় এক থাই তরুণের সঙ্গে। ওই পাই গ্রামেই নাকি গভীর ভালোবাসা হয় তাঁদের। গভীর ভালোবাসায় আচ্ছন্ন হয়ে থাই নার্স তরুণী এই ভীষণ একাকী শহর টরন্টোতে নিজের স্বামীকে স্পনসর করে নিয়ে আসে। তরুণ থাই যুবক ৪৫ বছর আগে একটা রেস্টুরেন্ট খোলেন, ভালোবাসার গ্রামের সঙ্গে নাম মিলিয়ে নিজের রেস্টুরেন্টের নাম রাখে ‘পাই’।
ভালোবেসে আর বিশ্বাস করে কি জীবনে সবাই শুধু ঠকে? সবাই কি কেবল হেরেই যায়? না, সেটা কিছুতেই সত্য না। থাই তরুণ প্রমাণ করেছে—ভালোবাসা ধরে রাখতে হয় বুকের গহিনে। দুনিয়া গল্প বলে চলছে অথচ আমি নেশাগ্রস্ত মানুষের মতো টেবিল থেকে উঠে যাই। প্রচণ্ড ভিড়ে মানুষের গা ঠেলে ঠেলে ‘পাই’ রেস্টুরেন্টের একদম দরজার কাছে পৌঁছে যাই। মূল দরজার দুই পাশজুড়ে টাঙানো আছে ৪৫ বছর আগের সেই যুবক-যুবতীর হাতিতে চড়া বিবর্ণ হয়ে যাওয়া ছবি। সারা দেয়ালজুড়ে আজও বেঁচে থাকা বয়স্ক সেই থাই তরুণের পরিবারের সবার ছবি, সুখী সব ছবি। দুনিয়া বলে যেতে থাকে, ‘দেখো মাহমুদা, ওরা এখনো বেঁচে আছে, ওদের নাতি-নাতনি সবাই বেঁচে আছে, দেখো, সৎ ভালোবাসার কি ভীষণ শক্তি।’
রাত পৌনে চারটা, অন্ধকারে ঘুম ভেঙে যায়। নিকষ কালো অন্ধকারে মাথার পাশে রাখা সেলফোনের আলো জ্বালাই, কেউ কি খোঁজে আমাকে?
এই যে মাত্র অল্প কিছুদিন আগে আমার ভালোবাসার বাংলাদেশ থেকে ফিরে এলাম, সেখান থেকে কি কেউ ডাকে আমাকে? কেউ কি বলে, ‘লুনা, তোমাকে মনে পড়ে?’ সেই থাই নার্স তরুণীর মতো আমার জীবনেও কেউ যাকে দূর দেশ থেকে এই কঠিন শহরে নিয়ে আসলে সে রেস্টুরেন্ট না খুলুক, অন্তত আলো জ্বেলে দিক— নির্মলেন্দু গুণের সেই কবিতার মতো ‘কামনা বাসনার সঙ্গী না হোক, কেউ অন্তত আমাকে জিজ্ঞেস করুক, তোমার চোখ এত লাল কেন।’
২৩ মার্চ ২০১৯
টরন্টো, কানাডা