মমির রহস্যময় ইতিহাস
মৃত্যুর কয়েক ঘণ্টার মধ্যেই মানুষের দেহে পরিবর্তন শুরু হয়—রক্ত জমে যায়, কোষ ভেঙে পড়ে, আর ধীরে ধীরে পচনপ্রক্রিয়া শুরু হয়। পরিবেশ যদি উষ্ণ ও আর্দ্র হয়, তাহলে এ প্রক্রিয়া আরও দ্রুত ঘটে। কিছু সময় পর ত্বক শুকিয়ে যায়, পোকামাকড়ের খাদ্যে পরিণত হয়, আর শেষে শুধু হাড়ের কাঠামোই বাকি থাকে। কিন্তু হাজার হাজার বছর আগেই মানুষ শিখে ফেলেছিল, কীভাবে সময়ের ক্ষয় থেকে দেহকে রক্ষা করা যায়। সেই বিশেষ প্রক্রিয়ার নামই ‘মমি’ করা।
প্রাচীন মিসর মমি প্রথার জন্য সবচেয়ে বেশি পরিচিত। সেখানে মৃতদেহকে বিশেষ রাসায়নিক পদার্থ, তেল ও কাপড়ে সংরক্ষণ করা হতো, যাতে সময়ের প্রভাবে তা ক্ষতিগ্রস্ত না হয়। মানবসভ্যতার ইতিহাসে মৃত্যু অনিবার্য সত্য হলেও মানুষ বরাবরই চেয়েছে মৃত্যুর পরও অমর হয়ে থাকতে—স্মৃতিতে, কীর্তিতে কিংবা দেহ সংরক্ষণের মধ্য দিয়ে। সেই চিরন্তন আকাঙ্ক্ষারই ফল হলো মমি, যা আজ ইতিহাসের জীবন্ত দলিল।
প্রাচীন মিসরীয়দের বিশ্বাস ছিল, মৃত্যুর পর আত্মা এক অতিপ্রাকৃত জগতে পৌঁছায়, যেখানে শরীরের উপস্থিতি প্রয়োজন। তাই তারা মনে করত, দেহ অক্ষত না থাকলে আত্মা পুনরায় ফিরে আসতে পারবে না। এই বিশ্বাস থেকেই মমি তৈরির প্রথা শুরু হয়। মৃতের সঙ্গে এমন অনেক সামগ্রীও কবর দেওয়া হতো, যা পরবর্তী জীবনে প্রয়োজন হতে পারে, যেমন কাপড়, গয়না, খাদ্য, এমনকি অলংকারও।
গবেষকদের ধারণা, মিসরে মমি তৈরির প্রচলন শুরু হয় ২৬০০ খ্রিষ্টপূর্বাব্দের দিকে। প্রথম দিকে শুধু রাজা বা অভিজাত শ্রেণির মানুষদের দেহই এ প্রক্রিয়ার মাধ্যমে সংরক্ষিত হতো। পরে প্রায় ২০০০ খ্রিষ্টপূর্বাব্দে ধনী সাধারণ মানুষও প্রিয়জনের দেহ মমি করতে শুরু করেন। তবে এটি ছিল অত্যন্ত ব্যয়বহুল প্রক্রিয়া, তাই সবার পক্ষে সম্ভব হয়নি। রোমান শাসনামলে ও খ্রিষ্টধর্মের প্রভাব বৃদ্ধির সঙ্গে সঙ্গে চতুর্থ শতাব্দীর দিকে মিসরে মমি প্রথা ধীরে ধীরে বিলুপ্ত হয়।
মমির ইতিহাস কিন্তু শুধু মিসরের মধ্যেই সীমাবদ্ধ নয়। বিশ্বজুড়েই নানা সময় বিখ্যাত ব্যক্তিদের দেহ সংরক্ষণ করা হয়েছে বিশেষ উদ্দেশ্যে—কখনো ধর্মীয়, কখনো রাজনৈতিক কারণে।
রাশিয়ার বিপ্লবী নেতা ভ্লাদিমির লেনিন ছিলেন প্রথম কমিউনিস্ট নেতা, যাঁর দেহ মস্কোর রেড স্কয়ারে নির্মিত মসোলিয়ামে সংরক্ষিত আছে। আজও প্রতিদিন হাজারো মানুষ সেখানে ভিড় করেন।
চীনের বিপ্লবী নেতা মাও সে–তুংয়ের দেহও মমির মতো করে সংরক্ষণ করা হয়েছে বেইজিংয়ের তিয়েনআনমেন স্কোয়ারে অবস্থিত চেয়ারম্যান মাও মেমোরিয়াল হলে।
আর্জেন্টিনার প্রথম নারী নেতা ইভা পেরন, যিনি মাত্র ৩৩ বছর বয়সে ক্যানসারে মারা যান, তাঁর দেহও সংরক্ষিত রয়েছে বিশেষ পদ্ধতিতে।
এ ছাড়া ফিলিপাইনের সাবেক প্রেসিডেন্ট ফার্দিনান্দ মার্কোসের মৃত্যুর পর তাঁর দেহ সংরক্ষণ করে প্রদর্শিত হয়েছিল একটি জাদুঘরে, যদিও তা আসল মমি নয়, সংরক্ষিত দেহের প্রতিরূপ। এ নিয়ে গবেষকদের মধ্যে মতভেদ রয়েছে।
উত্তর কোরিয়ার প্রতিষ্ঠাতা প্রেসিডেন্ট কিম ইল-সুং ও তাঁর পুত্র কিম জং-ইলের দেহ সংরক্ষিত আছে পিয়ংইয়ংয়ের ‘কুমসুসান প্যালেস’-এ, যা এখন একধরনের জাতীয় স্মৃতিস্তম্ভ।
রাশিয়ার বিপ্লবী নেতা ভ্লাদিমির লেনিন ছিলেন প্রথম কমিউনিস্ট নেতা, যাঁর দেহ মস্কোর রেড স্কয়ারে নির্মিত মসোলিয়ামে সংরক্ষিত আছে। আজও প্রতিদিন হাজারো মানুষ সেখানে ভিড় করেন।
চীনের বিপ্লবী নেতা মাও সে–তুংয়ের দেহও মমির মতো করে সংরক্ষণ করা হয়েছে বেইজিংয়ের তিয়েনআনমেন স্কোয়ারে অবস্থিত চেয়ারম্যান মাও মেমোরিয়াল হলে।
আর্জেন্টিনার প্রথম নারী নেতা ইভা পেরন, যিনি মাত্র ৩৩ বছর বয়সে ক্যানসারে মারা যান, তাঁর দেহও সংরক্ষিত রয়েছে বিশেষ পদ্ধতিতে।
এ ড়া ফিলিপাইনের সাবেক প্রেসিডেন্ট ফার্দিনান্দ মার্কোসের মৃত্যুর পর তাঁর দেহ সংরক্ষণ করে প্রদর্শিত হয়েছিল একটি জাদুঘরে, যদিও তা আসল মমি নয়, সংরক্ষিত দেহের প্রতিরূপ। এ নিয়ে গবেষকদের মধ্যে মতভেদ রয়েছে।
উত্তর কোরিয়ার প্রতিষ্ঠাতা প্রেসিডেন্ট কিম ইল-সুং ও তাঁর পুত্র কিম জং-ইলের দেহ সংরক্ষিত আছে পিয়ংইয়ংয়ের ‘কুমসুসান প্যালেস’-এ, যা এখন একধরনের জাতীয় স্মৃতিস্তম্ভ।
বর্তমানে বিশ্বের অনেক জাদুঘরে সংরক্ষিত রয়েছে শত শত মমি, যা ইতিহাস ও বিজ্ঞানের অনন্য নিদর্শন। লন্ডনের ‘দ্য ব্রিটিশ মিউজিয়াম’-এ মিসর, সুদান ও অন্যান্য দেশ থেকে সংগৃহীত ১২০টির বেশি মানব মমি রয়েছে। এর মধ্যে খ্রিষ্টপূর্ব ৯০০ সালের পুরোহিতের কন্যা তামুত এবং খ্রিষ্টপূর্ব ৮০০ সালের গায়ক জায়া স্তুমোর মমি বিশেষভাবে উল্লেখযোগ্য। এ ছাড়া সেখানে প্রায় ৩০০টি প্রাণীর মমিও রয়েছে, যার মধ্যে রয়েছে কুকুর, বিড়াল, এমনকি কুমিরও।
এই মমিগুলো সাধারণত খোলা হয় না, তবে আধুনিক প্রযুক্তি যেমন এক্স-রে ও সিটি স্ক্যান ব্যবহার করে বিজ্ঞানীরা এখনো এগুলোর ওপর গবেষণা চালাচ্ছেন।
হাজার বছরের ব্যবধানেও মমি আজও মানুষের কৌতূহলের কেন্দ্র। এটি শুধু দেহ সংরক্ষণের এক প্রাচীন কৌশল নয়, বরং মানবজাতির মৃত্যুভয়, বিশ্বাস, ও অমরত্বের আকাঙ্ক্ষার এক প্রতীক। সময় বদলেছে, সভ্যতা এগিয়েছে, কিন্তু মানুষের সেই চিরন্তন ইচ্ছা—মৃত্যুর পরও স্মৃতিতে বেঁচে থাকার—আজও ঠিক আগের মতোই অমলিন।
তথ্যসূত্র: ব্রিটিশ মিউজিয়াম, বিবিসি, ন্যাশনাল জিওগ্রাফিক, অক্সফোর্ড ইউনিভার্সিটি প্রেস, স্মিথসোনিয়ান ন্যাশনাল মিউজিয়াম অব ন্যাচারাল হিস্ট্রি