আইয়ুব বাচ্চুর শৈশব ও স্মৃতির খোঁজে

আইয়ুব বাচ্চুর সঙ্গে লেখক (কালো টি-শার্ট পরিহিত)ছবি: সংগৃহীত

খরনা গ্রামের নামকরণটি বেশ সুন্দর। খরনা ছিল একসময় প্রকৃতির আধার পাহাড়ি অঞ্চল। চতুর্দিকে সবুজে ঘেরা গ্রামের পাশ দিয়ে এঁকেবেঁকে বয়ে গেছে খরনা খাল। খালটি একসময় ছিল ছড়া বা পানির লেক। পাহাড় থেকে ঝরনা গড়িয়ে ছড়ার সৃষ্টি হয়। ছোট ছোট ছড়া থেকে আসত খরস্রোত। কথিত আছে, খরস্রোত থেকে খরনা খাল, খরনা খালের নামানুসারে খরনার নামকরণ হয়েছে। পটিয়া উপজেলা থেকে মাত্র সাত কিলোমিটার দূরে হজরত শাহজাহান আউলিয়ার পুণ্যভূমি খরনা গ্রাম।

এই গ্রামের অদূরে রয়েছে পাখি ডাকা ছায়াঘেরা চিরসবুজের হাতছানি দেওয়া মোজাফফরাবাদ গ্রাম। মোজাফফরাবাদের একটু আগে আরাকান সড়ক থেকে পূর্ব দিকে যে সড়কটি সোজা চলে গেছে, সেটি খরনা গ্রাম। রাস্তার পাশে সারি সারি গাছ, সবুজ ধানি জমি। শরতের আকাশে শুভ্র মেঘের ভেলা, নিচে চিরসবুজ ধানখেত। ধানের শিষের ডগায় রাতে ঝরে পড়া শিশিরকণাগুলো রোদের আলো পড়াতে মুক্তোদানার মতো জ্বলছে। ধানখেতে পানি জমে আছে।

সড়ক দিয়ে যাওয়ার পথে শোয়েব নামের এক ভদ্রলোককে জিজ্ঞেস করলাম, ‘শিল্পী আইয়ুব বাচ্চুর বাড়ি কোন দিকে?’ তিনি দেখিয়ে দিলেন, খরনা রেলস্টেশন থেকে একটু পূর্ব দিকে হেঁটে গেলে দেখতে পাবেন নুরুজ্জামান সওদাগরের বাড়ি। ওটাই শিল্পী আইয়ুব বাচ্চুর বাড়ি।

জীবনের শেষদিকে নিজের গ্রামের এন জেড উচ্চবিদ্যালয়ে একটা কনসার্ট করার কথা ছিল আইয়ুব বাচ্চুর। করা হয়ে ওঠেনি। এর আগেই পৃথিবী থেকে বিদায় নেন।

হাজি নুরুজ্জামান সওদাগর আইয়ুব বাচ্চুর দাদা। প্রয়াত নুরুজ্জামান সওদাগর ছিলেন খরনার দানবীর। তাঁর দান করা জায়গায় নির্মিত হয়েছে খরনা ইউনিয়ন পরিষদ, নুরুজ্জামান সওদাগরের নামে হাটবাজার, হাজি নুরুজ্জামান স্মৃতি সংসদ। খরনা রেলস্টেশন, মসজিদ, মাদ্রাসা, শানবাঁধানো পুকুরঘাট। পুকুরের পাশে মসজিদ, কবরস্থান। পুকুরে হাঁসের পাল সাঁতার কাটতে ব্যস্ত। গ্রামের ছেলেরা কাদামাখা শরীর নিয়ে পুকুরে লাফ দিচ্ছে। ছবির মতো সাজানো গ্রাম। একটু দূরে গেলে খরনা শ্রীশ্রী জগজ্জননী জ্বালাকুমারী মায়ের মন্দির। খরনা মায়ের বাড়ি নামে পরিচিত। ১৯৪৭ সালে এটি প্রতিষ্ঠিত হয়। হিন্দুধর্মাবলম্বীদের অনেকে পুণ্যলাভের আশায় মায়ের মন্দিরে পূজা দিতে আসেন।

খরনা রেলস্টেশনের পূর্ব পাশের বাড়িটি নুরুজ্জামান সওদাগরের। বাড়ির সামনে কাঠ ও টিন দিয়ে ঘেরা শৈল্পিক ফটক। বাড়ির সামনে সারি সারি মাটির ঘর, জরাজীর্ণ টিন, সামনে দু-একটি নারিকেল–সুপারিগাছ দেখলাম। ঘরের সামনে কলা, আম, বিলিম্বি ও কাঁঠালগাছ। বাড়ির উঠোনে প্রকৃতির বিছিয়ে দেওয়া সবুজ ঘাসের গালিচা। সেমিপাকা টিনশেড, পাশে পাকা দালান, এটি শিল্পী আইয়ুব বাচ্চুর দাদার বাড়ি। বাড়িতে প্রবেশ করতেই দেখলাম চশমা পরা এক বৃদ্ধকে। তিনি কাশি দিয়ে জিজ্ঞেস করলেন, ‘কাকে চাই?’ আমার সঙ্গে ছিলেন পটিয়া বন্ধুসভার সভাপতি বাচিক শিল্পী ফারুক আহমেদ। দুজনে পরিচয় দিয়ে বললাম, ‘শিল্পী আইয়ুব বাচ্চু সম্পর্কে জানতে এসেছি চাচা।’

আইয়ুব বাচ্চুর চাচা আবদুল আজিজ (মাঝখানে)
ছবি: সংগৃহীত

বয়োজ্যেষ্ঠ ভদ্রলোকের নাম আবদুল আজিজ, সম্পর্কে শিল্পী আইয়ুব বাচ্চুর চাচা। তিনি জানালেন, ওনার চাচা নুরুজ্জামান সওদাগর ছিলেন তৎকালীন জমিদার ও জনহিতৈষী। পেশায় ছিলেন একজন কাপড় ব্যবসায়ী। নুরুজ্জামান সওদাগর প্রায় ১০ দুন বা ২০০ খানি জমির মালিক ছিলেন। নিজেই প্রতিষ্ঠা করেছেন এন জেড উচ্চবিদ্যালয়, মোজাফফরাবাদ কলেজ, মাদ্রাসা, মসজিদ, হাটবাজার, তফসিল অফিস, কৃষি অফিসসহ বিভিন্ন প্রতিষ্ঠান। খরনা গ্রামে প্রায় ১১টি প্রতিষ্ঠানের জায়গা দান করেছেন তিনি। এলাকার লোকের কথা ভেবে নিজের জায়গায় খনন করেছেন পুকুর, দিঘি।

হাজি নুরুজ্জামান সওদাগরের পাঁচ সন্তান। ইয়াকুব সওদাগর, ইসহাক সওদাগর, মুসা সওদাগর, আবদুল বারেক সওদাগর। ইসহাক সওদাগর সপরিবার থাকতেন এনায়েতবাজারে। শিল্পী মোহাম্মদ আইয়ুব বাচ্চু ১৯৬২ সালের ১৬ আগস্ট চট্টগ্রাম নগরীর এনায়েতবাজারস্থ ৩৪৪ জুবিলী রোডে জন্মগ্রহণ করেন। ডাকনাম ছিল রবিন। আইয়ুব বাচ্চু নামে সবাই চেনেন। অনেকে এবি বলে ডাকেন।

আইয়ুব বাচ্চু ছোটবেলায় গ্রামে যেতেন প্রায় সময়ই। গ্রামের ছেলেদের সঙ্গে মিশতেন। পাহাড়ে বেড়াতে পছন্দ করতেন। গ্রামের অদূরে পাহাড়ি এলাকায় নুরুজ্জামান সওদাগরের পেয়ারাবাগান ছিল। আইয়ুব বাচ্চু বাগানের গাছে উঠে পেয়ারা পেড়ে খেতেন। গ্রামের ছেলেদের সঙ্গে চুটিয়ে ফুটবল খেলতেন। খুব মিশুক প্রকৃতির ছিলেন তিনি।

আরও পড়ুন

জীবনের শেষদিকে নিজের গ্রামের এন জেড উচ্চবিদ্যালয়ে একটা কনসার্ট করার কথা ছিল আইয়ুব বাচ্চুর। করা হয়ে ওঠেনি। এর আগেই পৃথিবী থেকে বিদায় নেন। তিনি খুব বিনয়ী ও অভিমানী ছিলেন। বাবা-চাচাদের খুব সম্মান করতেন। মায়ের প্রতি খুব টান ছিল। ছোটবেলায় গানবাজনা এবং গিটার বাজানোর বিষয়টা বাবা-দাদারা খুব একটা পছন্দ করতেন না। একবার একটা পারিবারিক বিষয় নিয়ে তাঁর খুব অভিমান হয়েছিল। অভিমান নিয়ে চট্টগ্রাম ছেড়ে ঢাকায় চলে আসেন।

বয়োজ্যেষ্ঠ আবদুল আজিজ বলেন, ‘একসময় ভাতিজা আইয়ুব বাচ্চু দেশবরেণ্য ব্যান্ড তারকা শিল্পী হয়ে ওঠে। বাচ্চুর গিটারের সুর আজও কানে বাজে। ১৯৮২ সালের দিকে সোলস ব্যান্ডে বাজাত। পরে ১৯৯১ সালের দিকে বাচ্চু নিজেই এলআরবি (লাভ রানস ব্লাইন্ড) ব্যান্ড গঠন করে।’

আইয়ুব বাচ্চু একাধারে এলআরবি ব্যান্ডের গায়ক, লিড গিটারিস্ট, গীতিকার ও সুরকার ছিলেন। তাঁর প্রথম গাওয়া গান ছিল গীতিকার শহীদ মাহমুদ জঙ্গীর লেখা ‘হারানো বিকেলের গল্প’। ওনার গাওয়া সবচেয়ে জনপ্রিয় গান ‘সেই তুমি কেন এত অচেনা হলে’, ‘সেই তারা ভরা রাতে’, ‘আমি কষ্ট পেতে ভালোবাসি’, ‘এক আকাশের তারা তুই একা গুনিস নে’ ইত্যাদি। এত সুন্দর করে গাইতেন এবং গিটার বাজাতেন, সবাই মন্ত্রমুগ্ধ হয়ে শুনত। তিনি এভাবে অকালে চলে যাবেন, কখনো ভাবিনি। তিনি না থেকেও আজও বেঁচে আছেন লক্ষ–কোটি মানুষের হৃদয়ে।

আইয়ুব বাচ্চুর স্মৃতিবিজড়িত খরনা গ্রাম
ছবি: সংগৃহীত

বেলা গড়িয়ে দুপুর দেড়টা। সূর্যের লাল রশ্মি এসে পড়েছে আইয়ুব বাচ্চুর দেউড়ি–ঘরে। ট্রে ভরা নাশতা এল। আজিজ চাচা আমাদের নাশতা নিতে বললেন। আমরা যখন বাচ্চু ভাইয়ের দাদাবাড়ি থেকে বের হচ্ছিলাম, খরনা রেলস্টেশন দিয়ে পর্যটক এক্সপ্রেস হুইসেল বাজিয়ে পাগলা ঘোড়ার মতো ছুটে চলেছে কক্সবাজারের উদ্দেশে।

আইয়ুব বাচ্চুর স্মৃতিবিজড়িত খরনা গ্রামে তাঁর কোনো স্মৃতিচিহ্ন নেই। বাচিকশিল্পী ফারুক আহমেদকে বললাম, শিল্পী আইয়ুব বাচ্চুর স্মৃতিবিজড়িত খরনা গ্রামে ওনার নামে একটি ‘গিটার একাডেমি’ অথবা ‘আইয়ুব বাচ্চু সংগীত একাডেমি’ প্রতিষ্ঠা করলে ভালো হবে। আগামী প্রজন্ম আইয়ুব বাচ্চুর গানের চর্চা করবে। তাঁর স্মৃতি সংরক্ষণ করবে।

২০১০ সালে পটিয়ায় সনাকের আয়োজনে মাদকবিরোধী কনসার্টে এসেছিলেন শিল্পী আইয়ুব বাচ্চু। এটাই তাঁর দাদাবাড়ি এলাকার শেষ স্মৃতি। ২০১৮ সালের ১৮ অক্টোবর, কোটি ভক্তকে কাঁদিয়ে না–ফেরার দেশে চলে যান এই গুণী শিল্পী। চৈতন্য গলি কবরস্থানে মায়ের পাশে তাঁর শেষের ঠিকানা।

লেখক ও গবেষক এবং উপদেষ্টা, পটিয়া বন্ধুসভা