প্রিয় মুছা স্যারের জন্য

পটিয়ার আবদুস সোবহান রাহাত আলী উচ্চবিদ্যালয়ে সাবেক প্রধান শিক্ষক মুহাম্মদ মুছাছবি: সংগৃহীত

তখন আমি পটিয়ার আবদুস সোবহান রাহাত আলী উচ্চবিদ্যালয়ে পড়াশোনা করি। বিদ্যালয়ের প্রধান শিক্ষক ছিলেন মুহাম্মদ মুছা স্যার। ওনার ক্লাস বরাবরই সবার প্রিয়। আমাদের ইংরেজি পড়াতেন। একবার ক্লাসে তিনি একটি ভূতের গল্প শুনিয়েছিলেন। গল্পের নাম ‘বুগাস বু’।

স্যারের ভাষায় গল্পটি ছিল এমন—ছোটবেলায় মা–বাবা ও গুরুজনদের উপদেশ ছিল, তাড়াতাড়ি ঘুমাতে যাওয়া, তাড়াতাড়ি ঘুম থেকে ওঠা সবচেয়ে উত্তম কাজ। সুস্থ দেহ, জ্ঞানী ও সম্পদশালী হওয়ার সবচেয়ে সহজ উপায়। দাদুদের কাছে শুনেছি, ভোরবেলায় নাকি স্বর্গের বাতাস বইতে থাকে। যা শরীরে ছোঁয়া দিয়ে যায়। ভোরের হাওয়া এমন এক বড় দাওয়াই, যেটা পৃথিবীতে বিনা পয়সায় পাওয়া যায়। আবার সে দাওয়াইয়ের ভালো ফল অনন্তকাল পেয়ে থাকে মানুষ।

স্যার বলতে লাগলেন, ‘এক রাতে পাশের বাড়ির শিক্ষকের কাছে প্রাইভেট পড়ে বাড়ি ফিরছিলাম, সন্ধ্যা ঘনিয়ে রাত এল। গুঁড়ি গুঁড়ি বৃষ্টি, সে সময় বিদ্যুৎ আসেনি গ্রামে। হারিকেন আর কুপিবাতি জ্বালিয়ে পড়ালেখা করতে হতো। পুরো গ্রামে অমানিশা অন্ধকার। জোনাকি পোকা আর ঝিঁঝি গাইছে। রাস্তায় কাদাপানি জমেছে, বিলের ধারে ঘ্যাঙর ঘ্যাঙর ডাকছে ব্যাঙ। নিশাচর হুতুমপ্যাঁচা কু কু কু করে অবিরাম ডেকে যাচ্ছে। তালগাছে কলাবাদুড়ের বাসা থেকে চেঁচামেচি আর পাখা ঝাপটানোর শব্দ। বাড়ির পাশে ছিল কবরস্থান। হঠাৎ কবরস্থানের ঝোপের মধ্যে কী যেন নড়ে উঠল, ভয়ে গা ছমছম করে ওঠে। মনে হলো কালো কাপড় পরা মূর্তির মতো কী যেন দাঁড়িয়ে আছে! ভয়ে দম বন্ধ হয়ে আসছিল, শ্বাস নেওয়ার চেষ্টা করলাম।

আরও পড়ুন

‘কিছু দূর হেঁটে একবার পেছনে ফিরে তাকাই, মনে হচ্ছিল কেউ যেন পিছু পিছু আসছে! চাঁদের আলোতে লম্বা একটা ছায়া হঠাৎ চোখে পড়ল। মা বলেছিল ভয় পেলে আয়াতুল কুরসি পড়ার জন্য। কেঁপে কেঁপে কোনো রকমে আয়াতুল কুরসি পড়লাম। এক ভয়ানক অবস্থা! কোনো রকমে বাড়ি ফিরলাম। বাড়ি এসে মাকে সব বললাম। মা বলল, “ভয় পাওয়ার কিছু নেই। এটা তোমার মনের ভয়।”

‘ভাত খেয়ে ঘুমাতে যাব। মা হারিকেন নিভিয়ে দিল। কাঁথা জড়িয়ে ঘুমানোর চেষ্টা, ভয় ভয় করছে, কিছুতেই ঘুম আসছে না। টিনের ছালে ধপাস করে কী যেন লাফ দিল। টিনের ছাদে ধস্তাধস্তি শব্দ! ভয় আরও বেড়ে গেল। কিছুক্ষণ পর শুনি দুই বিড়ালের ঝগড়া। রাতের ভয়টা নিয়ে মনে কৌতূহল। ভোরবেলা ঘুম থেকে উঠে মসজিদে নামাজ আদায় করে হাঁটতে লাগলাম। অন্ধকার কেটে ভোরের আলো আসতে শুরু করেছে, দোয়েল শিস তুলছে, পাখিদের কলরব, বিলের ধারে শুভ্র বক মাছ ধরার জন্য ধ্যানে বসেছে, পানকৌড়ি-বালিহাঁস মাছ ধরছে। মাছরাঙা পাখি টুপ করে ডুব দিয়ে মাছ ধরছে। দিঘিতে শাপলা ফুটেছে, কিছু মহিলাকে দেখলাম পূজার ফুল তুলছে। লাঙল–গরু নিয়ে মাঠে যাচ্ছে কৃষক, জলদাসরা বড় জাল কাঁধে ঝুলিয়ে মাছ ধরতে চান্দখালি খালের দিকে ছুটছে। মোরগ ডাক দিচ্ছে। পৃথিবীর সবচেয়ে সুন্দর সময় হলো ভোরবেলা এই পরিবেশ উপভোগ করতে পারা।

‘রাতে ভয় পাওয়া জায়গায় গেলাম, কালো কাপড় পরিধান করা মূর্তির মতো দাঁড়িয়ে থাকা বস্তুটা দেখার জন্য। কাছে গিয়ে দেখি পুরোনো ঝোপের মধ্যে শেওলা ধরা একটা সীমানা পিলার। মনে মনে হাসলাম।’

স্কুলজীবন পেরিয়ে এসেছি সেই কবে। মুছা স্যার শুধু ভূতের গল্প শোনাননি, সব সময় ভালো মানুষ হওয়ার জন্য পরামর্শ দিতেন। জাপানে প্রাথমিক শিক্ষা শুরু হয় পরিবার থেকে। ওদেরকে আগে শেখানো হয় শিষ্টাচার, নীতি-নৈতিকতা। স্যার বলতেন, ‘আমাদের সম্বোধন পৃথিবীর সবচেয়ে দামি সম্বোধন—আসসালামু আলাইকুম ওয়ারাহমাতুল্লাহি ওয়াবারাকাতুহু, অর্থাৎ আপনার ওপর শান্তি বর্ষিত হোক। কৃতজ্ঞতা দেখানো সবচেয়ে মহৎ মানুষের কাজ। কেউ ভালো কাজ করলে তাঁকে ধন্যবাদ দেবে। কারও মনে কষ্ট দিলে বা সামান্য ভুল করলে দুঃখিত বলবে, ক্ষমা চাইবে। ক্ষমা করা, ক্ষমা চাওয়া দুটোই মহৎ কাজের উজ্জ্বল দৃষ্টান্ত। বড় হয়ে মানুষকে কখনো ঠকাবে না। মা–বাবা ও গুরুজনদের সব সময় সম্মান দেবে। বই পড়ার বিকল্প নেই। আলোকিত মানুষ হতে হলে বই বেশি বেশি পড়তে হবে। জীবনে শুধু সফলতার পেছনে না দৌড়িয়ে, ভালো মানুষ হওয়ার জন্য দৌড়াবে। পরকালের সফলতার জন্য ভালো কাজ করতে হবে। তাহলে পরকাল ও ইহকাল দুই জগতে সমৃদ্ধ হবে জীবন।’

গল্পটা লিখতে বসে হাত কাঁপছিল। আলোকিত মানুষ গড়ার কারিগর শ্রদ্ধাভাজনেষু প্রিয় মুছা স্যার এই পৃথিবীতে নেই। কিন্তু ওনার গল্পটা হৃদয় কুঠিরে ছবির মতো গেঁথে আছে।

উপদেষ্টা, পটিয়া বন্ধুসভা