এক বিকেল, একজন শিক্ষক আর জীবনের পাঠ

শিক্ষক রাবেয়া রাবুর সঙ্গেছবি: লেখকের সৌজন্যে
পরীক্ষার সময়টা আমার ভালো যাচ্ছিল না। মন বসছিল না পড়ায়, লিখতেও পারছিলাম না। তৃতীয় পরীক্ষার পর সাহস করে ফোন করলাম ম্যামকে।

২০২৪ সালের জুলাই মাস। দেশের রাজপথ তখন উত্তপ্ত। ছাত্র–জনতার আন্দোলন জ্বলে উঠেছে দাবানলের মতো। শিক্ষার্থীদের মুখে একটাই স্লোগান, ‘কোটা না মেধা, মেধা, মেধা!’

ভর্তির পর ১৪ জুলাই থেকে বিশ্ববিদ্যালয়ে ক্লাস শুরু হওয়ার কথা। এর মধ্যেই ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়সহ দেশের অন্যান্য সব পাবলিক বিশ্ববিদ্যালয় ও কলেজে বৈষম্যবিরোধী আন্দোলন ছড়িয়ে পড়েছে। বেসরকারি বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষার্থীরাও আর চুপ থাকতে পারল না; একযোগে তারাও যোগ দিল আন্দোলনে। ক্লাস পরীক্ষা বর্জনের ঘোষণা এল, প্রতিবাদের আগুন ছড়িয়ে পড়ল সবখানে।

এই অস্থির সময়ে আমাদের বিশ্ববিদ্যালয় ১৯ জুলাই এক নোটিশে জানাল, বিশ্ববিদ্যালয় অনির্দিষ্টকালের জন্য বন্ধ। তবে সাময়িকভাবে অনলাইন ক্লাস চলতে লাগল।

প্রথম অনলাইন ক্লাসে পরিচয় রাবেয়া রাবু ম্যামের সঙ্গে। স্ক্রিনের ওপারে এক অচেনা মুখ, কণ্ঠস্বরে এক অদ্ভুত মাধুর্য, আত্মবিশ্বাসে ভরা। ম্যামের বোঝানোর ধরন যেন অন্য সবার চেয়ে আলাদা। প্রথম ক্লাসটি কেটে গেল অজান্তেই। সেদিনই পরিচয় হলো সহপাঠীদের সঙ্গে।

দ্বিতীয় ক্লাসে ম্যাম বললেন, ‘আমাদের একজন ক্লাস প্রতিনিধি (সিআর) দরকার।’ দুজনের নাম প্রস্তাব করা হলো, তার মধ্যে একজন আমি। সহপাঠীদের সমর্থনে নির্বাচিত হলাম সিআর।

দেশে আন্দোলন তীব্র থেকে তীব্রতর হলো। গুলিতে ঝরে পড়ল আবু সাঈদ থেকে মুগ্ধ, মুগ্ধ থেকে ওয়াসিমসহ অসংখ্য তরুণ তাজা প্রাণ। রাস্তায় আগুন, চোখে ক্রোধ আর মনে একটাই স্বপ্ন—নতুন বাংলাদেশ। ৩৬ দিনের রক্তক্ষয়ী অধ্যায় শেষে পতন ঘটল স্বৈরাচার সরকারের। নতুন ভোরের আলোয় জন্ম নিল বাংলাদেশ ২.০।

২০ আগস্ট, আন্দোলনের ধুলোবালি পেরিয়ে, শুরু হলো আমাদের অফলাইন ক্লাস। প্রথম দিনই দেরি করলাম। সিআর হয়ে দেরি করা মানায় না। ম্যামের ক্লাস তখন পুরোদমে চলছে। দরজায় নক করে বললাম—ম্যাম, আমি কি আসতে পারি? তিনি তাকিয়ে বললেন, আসেন।

আরও পড়ুন

সেদিনই প্রথম সামনাসামনি দেখা। অনলাইন প্রোফাইলের ছবির সঙ্গে এই মানুষটার কোনো মিল নেই। বাস্তবে আরও প্রাণবন্ত, আরও গভীর এক উপস্থিতি। ওনার ক্লাস ছিল এক অনন্য অভিজ্ঞতা। যেখানে পাঠ্যবইয়ের পাতার বাইরে ছিল জীবন, স্বপ্ন আর বাস্তবতার পাঠ। কোনো বিষয় বোঝাতে গিয়ে উদাহরণ দিতেন নিজের জীবনের ঘটনা, বা চারপাশের সমাজের চলমান ঘটনা থেকে। তাঁর বলা প্রতিটি কথা মনে গেঁথে যেত। কখনো কঠোর, কখনো একরাশ মিষ্টতা মেশানো স্নেহ।

তবু একদিন আবার দেরি করে ক্লাসে এলাম। ম্যাম বললেন, ‘নয়ন, আপনি ক্লাসে লেট করেছেন। আপনি সিআর হয়ে যদি দেরি করেন, তাহলে অন্যরা কী শিখবে? অর্ধেক সময় শেষ, আপনি ক্লাসে ঢুকতে পারবেন না। বেরিয়ে যান।’
মন খারাপ করে নিচে নেমে এলাম, লবিতে বসে রইলাম একা। পরের ক্লাসে ঠিক সময়ে যাওয়ার প্রতিজ্ঞা করলাম।

দুপুর ১২টার ক্লাস—জার্নালিজম রাইটিং স্কিল। এবার সময়ের আগেই উপস্থিত। ম্যাম বললেন, ‘নয়ন, আমি আপনাকে শাস্তি দিয়েছি বলে আপনি চলে গেছেন; আমি তো ভাবছিলাম, সরি বলবেন অন্তত!’
আমি মাথা নিচু করে শুনছিলাম—লজ্জা আর শ্রদ্ধা মিশে এক অদ্ভুত অনুভূতি।

শিক্ষক রাবেয়া রাবু

এর পর থেকে ক্লাস মানেই আনন্দ, হাসি, কবিতা, আড্ডা আর শেখা। ম্যামের ক্লাসে শুধু বিষয় নয়, জীবন নিয়ে আলোচনা হতো। স্বপ্ন, লক্ষ্য, আত্মবিশ্বাস, ব্যর্থতা—সবকিছু নিয়ে। শুরুতে যাঁরা তাঁকে কঠোর ভাবতেন, তাঁরাও পরে বুঝলেন, এই কঠোরতার ভেতরেই লুকিয়ে আছে স্নেহ।

পরীক্ষার সময়টা আমার ভালো যাচ্ছিল না। মন বসছিল না পড়ায়, লিখতেও পারছিলাম না। তৃতীয় পরীক্ষার পর সাহস করে ফোন করলাম ম্যামকে। বললাম, ‘ম্যাম, আপনি কি ক্যাম্পাস থেকে চলে গেছেন?’ তিনি হেসে বললেন, ‘জি নয়ন, চলে এসেছি। কী হয়েছে?’ আমি বললাম, ‘মনোযোগ দিতে পারছি না, একটু কথা বলতে চাচ্ছিলাম।’ তিনি বললেন, ‘পরশু দিন পরীক্ষার পর দেখা হবে।’

সেই প্রতীক্ষিত দিন এল। পরীক্ষা শেষে নিচে অপেক্ষা করছিলাম। ম্যাম সেদিন শাড়ি পরেছিলেন—সম্ভবত লাল। আগে কখনো তাঁকে এত পরিপাটি, এত সুন্দর দেখিনি। তিনি এসে বললেন,
‘আজ আমরা হাঁটব, নয়ন। কোথায় যাওয়া যায় বলুন তো?’
আমি চুপ করে ছিলাম। ‘আচ্ছা, আগে কফি খাই, ভালো কফিশপ জানেন?’

আমরা কাছের এক কফিশপে ঢুকলাম। ম্যাম কফি অর্ডার দিলেন, তারপর বললেন, ‘নয়ন, এখন আমি আপনার শিক্ষক নই। মন খুলে সবকিছু বলুন।’
সব অজানা কথা, সব কষ্ট খুলে বললাম ওনাকে। আর তিনি দিলেন ছোট ছোট উপদেশ। বললেন, ‘আমি তোমাকে কিছু উপদেশ দেব। মনে রাখবে, এগুলো মিষ্টি, অথচ গভীর সত্যের মতো।’

তিনি বলতে থাকলেন, ‘জীবনে প্রচুর ঘুরো। প্রকৃতি আর সংস্কৃতির সঙ্গে মিশে যাও। যতটা সম্ভব তাদের কাছ থেকে শেখার চেষ্টা করো। শেষ বয়সে গল্প বলার জন্য স্মৃতি সংগ্রহ করো। লেখালেখির জন্য সব সময় গল্প খুঁজে নাও। বন্ধুবান্ধবের সংখ্যা কমিয়ে দাও। সত্যিকারের বন্ধুত্বই মানে রাখে। খারাপ লাগলে কান্না করো, গান শুনো, মুভি দেখো, বই পড়ো। মনে রেখো, অনুভূতির প্রকাশই মানুষের প্রকৃত শক্তি। নতুন কিছু জানার আগ্রহ রাখো। সব সময় জানতে চাও, বুঝতে চাও। আর জীবনের লক্ষ্য স্থির রাখো। উথাল-পাতাল জীবন আসবেই, তবে সবকিছু শক্ত হাতে মোকাবিলা করো।’

তিন ঘণ্টার বেশি সময় আমরা কথা বলেছিলাম। ওনার শব্দ যেন জীবনের দিকনির্দেশনা, প্রতিটি বাক্য অভিজ্ঞতার আলো। সেই আড্ডাটা শিক্ষক আর শিক্ষার্থীর মধ্যকার সত্যিকারের সংযোগ।

সেমিস্টারের শুরুতে ম্যাম বলেছিলেন, ‘নয়ন, তুমি তোমাকে নিয়ে দুই পৃষ্ঠা লিখবে।’ অথচ চতুর্থ সেমিস্টারেও আমি তা লিখে দিতে পারিনি। গত আগস্টে ম্যাম উচ্চশিক্ষার জন্য যুক্তরাষ্ট্রে চলে গেছেন। বড্ড মিস করি—ম্যামের সাজেশন, পড়ানো, আড্ডা সবকিছু।

আজ বিশ্ব শিক্ষক দিবস। প্রিয় শিক্ষক রাবেয়া রাবু ম্যামের প্রতি শ্রদ্ধা ও ভালোবাসা। আপনি আমাদের অনুপ্রেরণা হয়ে থাকবেন চিরকাল।

আহ্বায়ক, সোনারগাঁও বিশ্ববিদ্যালয় বন্ধুসভা