থামেলের কোলাহলের ভেতর এক নিঃশব্দ বাগান

কায়সার মহল, কাঠমান্ডু, নেপালছবি: মাহমুদুল হাসান খলিফা

থামেল আমাকে সব সময়ই ব্যস্ত রেখেছে। রঙিন দোকান, চলমান মানুষ, শব্দ আর গতি—একজন ফটোগ্রাফার হিসেবে এই বিশৃঙ্খলার মধ্যেই খুঁজি ফ্রেম। কিন্তু সেদিন ক্যামেরা হাতে হেঁটে যেতে যেতে হঠাৎই যেন অন্য এক জগতে ঢুকে পড়লাম। থামেলের বুকেই দেয়ালের আড়ালে লুকিয়ে আছে এক নিঃশব্দ রাজ্য ‘গার্ডেন অব ড্রিমস’।

যখন গার্ডেন অব ড্রিমসের ভেতরে প্রবেশ করি, প্রথমেই টের পাই শব্দের অনুপস্থিতি। শহর যেন হঠাৎ থেমে গেছে। নীরবতার মধ্যেই দাঁড়িয়ে আছে প্রায় এক শতাব্দী আগের এক রাজকীয় স্বপ্ন।

কায়সার মহল, কাঠমান্ডু, নেপাল
ছবি: মাহমুদুল হাসান খলিফা

বিশ শতকের শুরুতে কাইজার শমশের জং বাহাদুর রানা ইউরোপ ভ্রমণ শেষে কাঠমান্ডুতে তৈরি করেছিলেন এই বাগান। ফ্রান্স ও ইতালির রেনেসাঁ গার্ডেন, ইংল্যান্ডের নব্য-ক্ল্যাসিক্যাল নকশা সবকিছুর ছাপ স্পষ্ট এখানে। একজন ফটোগ্রাফার হিসেবে বুঝতে পারি, এটি শুধু স্থাপত্য নয়; এটি একটি মানসিক অবস্থান, একটি যুগের রুচির প্রকাশ।

গার্ডেন অব ড্রিমস ছয়টি অংশে বিভক্ত, নেপালের ছয় ঋতুর প্রতীক। প্রতিটি অংশে আলো আলাদা, ছায়া আলাদা, অনুভূতিও আলাদা। কোথাও সকালের আলো মার্বেলের বেঞ্চে পড়ছে, কোথাও ফোয়ারার জল ভেঙে দিচ্ছে প্রতিফলন।

আরও পড়ুন
কায়সার মহল, কাঠমান্ডু, নেপাল
ছবি: মাহমুদুল হাসান খলিফা

ক্যামেরার ভিউফাইন্ডারে তাকিয়ে দেখি, এটি কোনো সাধারণ বাগান নয়। এটি আলো আর স্থিরতার এক নিখুঁত কম্পোজিশন। ইউরোপীয় ভাস্কর্য, ছায়াঘেরা পথ আর পরিমিত নকশা সবকিছু যেন ফটোগ্রাফারের জন্য তৈরি।

রানাশাসনের পতনের পর এই বাগান দীর্ঘদিন পড়ে ছিল অবহেলায়। সেই ইতিহাস ক্যামেরার চোখে অনুভব করি, যেন সৌন্দর্যের ওপর জমে থাকা সময়ের ধুলো। পরে নেপাল সরকার ও অস্ট্রিয়ান সরকারের সহায়তায় বাগানটি নতুন করে প্রাণ ফিরে পায়। ২০০৭ সালে গার্ডেন অব ড্রিমস আবার খুলে দেওয়া হয় মানুষের জন্য।

আজকের গার্ডেন অব ড্রিমসে দাঁড়িয়ে সেই ইতিহাস আর আধুনিকতার সংযোগ স্পষ্টভাবে ধরা পড়ে।

কায়সার মহল, কাঠমান্ডু, নেপাল
ছবি: মাহমুদুল হাসান খলিফা

অনেক জায়গায় ছবি তুলেছি—পাহাড়, শহর, মানুষ। কিন্তু গার্ডেন অব ড্রিমস আমাকে শিখিয়েছে থেমে থাকতে। এখানে ছবি তোলার চেয়ে ছবি না তোলার মুহূর্তও গুরুত্বপূর্ণ। ছায়ার দিকে তাকিয়ে, বাতাসের শব্দ শুনে, ক্যামেরা নামিয়ে রাখার মধ্যেও একধরনের ভ্রমণ আছে।

গার্ডেন অব ড্রিমস আমাকে মনে করিয়ে দেয়, ভ্রমণ শুধু দূরে যাওয়ার নাম নয়, কখনো কখনো ভ্রমণ মানে শহরের মাঝখানে দাঁড়িয়ে সময়ের গভীরতায় নেমে যাওয়া।থামেলের কোলাহলের ভেতর এই বাগান এক নিঃশব্দ ফ্রেম; যেখানে ইতিহাস, আলো আর নীরবতা একসঙ্গে ধরা দেয়।

দয়াগঞ্জ, গেন্ডারিয়া, ঢাকা