গৌতম বুদ্ধের জন্মস্থান লুম্বিনী থেকে যাত্রা শুরু করে এখন নেপালের রাজধানী কাঠমান্ডুর দিকে। লুম্বিনীর শান্তি ও প্রাচীনতার ছোঁয়া মনে রেখেই কাঠমান্ডুর পথে চললাম, যেখানে তিনটি বিখ্যাত দরবার স্কোয়ার কাঠমান্ডু, ভক্তপুর ও পাটন আমার অপেক্ষায় ছিল। সবচেয়ে বেশি আমাকে মুগ্ধ করেছে পাটন দরবার স্কোয়ার, যা শুধু নেপালের নয়, ঐতিহ্যপ্রেমীদের জন্য এক অসাধারণ স্থান।
পাটন, প্রাচীন লালিতপুর, অর্থাৎ শিল্প ও সৌন্দর্যের শহর। এটি শাক্য ও মালি রাজবংশের রাজধানী ছিল। ১২ থেকে ১৭ শতকে পাটন শিল্প ও স্থাপত্যের স্বর্ণযুগ উপভোগ করেছিল। রাজারা এই স্কোয়ারে রাজপ্রাসাদ, মন্দির, চত্বর ও সামাজিক অনুষ্ঠানস্থল নির্মাণ করতেন। প্রতিটি স্থাপত্য কেবল সৌন্দর্য নয়, বরং ধর্মীয়, সামাজিক ও সাংস্কৃতিক ইতিহাসের এক জীবন্ত সাক্ষ্য বহন করে।
স্কোয়ারে প্রবেশ করলেই চোখে পড়ে রাজকীয় আঙিনা, যা মূল চৌক, সুন্দরী চৌক ও কেশব নারায়ণ চৌক নামে পরিচিত। চারপাশে ছড়িয়ে আছে নিখুঁত কাঠখোদাই, ধাতব মূর্তিগুলো এবং অনন্য পাথরের মন্দির। প্রতিটি কোণ যেন ইতিহাসের এক গল্প বলছে। বিশেষ করে কৃষ্ণমন্দির, সম্পূর্ণ পাথরের তৈরি মন্দির, যা রাজকীয় ও ধর্মীয় গুরুত্ব বহন করে এবং দর্শনার্থীদের মুগ্ধ করে। আর হিরণ্যবর্ণ মহাবিহার বা সোনালি মন্দির, বৌদ্ধবিহার হিসেবে পরিচিত। সোনালি ঝলমলে প্রাচীর ও সূক্ষ্ম খোদাইয়ের জন্য এটি বিশেষভাবে বিখ্যাত।
পাটন স্কোয়ার শুধু সৌন্দর্যের জন্য নয়, এটি নেপালের সংস্কৃতি, শিল্পকলা ও ইতিহাসের জীবন্ত প্রমাণ। এখানে প্রতিটি মূর্তি, প্রতিটি খোদাই, প্রতিটি মন্দির যেন মানবসভ্যতার সৃষ্টিশীলতা ও শিল্পের নিখুঁত দক্ষতার সাক্ষ্য বহন করছে, যদিও ২০১৫ সালের ভূমিকম্পে কিছু ক্ষতি হয়েছে। নেপালের প্রশাসন ধীরে ধীরে ক্ষতিগুলো মেরামত করছে এবং পুরোনো স্থাপত্যগুলো আগের মতো ঝলমলে ফিরিয়ে আনার চেষ্টা চালাচ্ছে।
স্কোয়ারে ঘুরতে ঘুরতে ছবি তুলছিলাম। প্রতিটি কোণ, প্রতিটি খোদাই যেন নিজের গল্প বলছিল। আলো–ছায়ার খেলায় প্রতিটি মন্দির, প্রতিটি চত্বর যেন জীবন্ত হয়ে উঠছে। পাটন দরবার স্কোয়ারে দাঁড়িয়ে বোঝা যায়, শহরটি শুধু পুরোনো নয়, বরং জীবন্ত ইতিহাসের ধারক। প্রতিটি মুহূর্ত, প্রতিটি দৃশ্য—সবই এই শহরের গল্প বাঁচিয়ে রাখে।
এখানকার সৌন্দর্য, ইতিহাস, ধর্মীয় গুরুত্ব ও শিল্পকলার সমন্বয় একত্রে পাটন দরবার স্কোয়ার নেপালের হৃদয় বানিয়েছে। এটি শুধু পর্যটকদের জন্য নয়, বরং যারা ইতিহাস, শিল্প ও নেপালের সংস্কৃতিকে ভালোবাসে, তাদের জন্য এক অমূল্য ধন। পাটন দরবার স্কোয়ারে এসে অনুভব হয় নেপাল শুধু পাহাড়ের দেশ নয়, বরং ইতিহাস, শিল্প ও মানবিক সৃষ্টিশীলতার এক অসাধারণ মিলনের দেশ। এটি ইউনেসকো ঘোষিত বিশ্ব ঐতিহ্য সাইট হওয়ার কারণে সমগ্র পৃথিবীর জন্য গুরুত্বপূর্ণ সাংস্কৃতিক সম্পদ।
দয়াগঞ্জ, গেন্ডারিয়া, ঢাকা