করোটির কথামালা (পর্ব ১২)

টরন্টো, কানাডাছবি: ফ্রিপিক
সব অনুভূতি এসে ভিড় করছে এই মুহূর্তে। কী করে লিখি করোটিতে বয়ে চলা এই অনুভূতির কথামালা?

যদি সত্যি বলতে হয় তাহলে বলতে হবে, বাংলাদেশে গিয়েছিলাম ১৩ বছর পরে। মাত্র চার দিন হলো ফিরেছি নিজের ঘরে। টরন্টো শহরে একান্ত ব্যক্তিগত যে ঘর আছে, সেই ঘরে ফিরেছি। জানি না কেন, গত চার দিনই ওলটপালট লাগছে, ঘুম ভেঙে যাচ্ছে দুই-তিন ঘণ্টা অন্তর। গভীর রাতে শুয়ে মনে হচ্ছে, আজকে ঢাকাতে বুধবার; গত সপ্তাহে বুধবারে গিয়েছিলাম দাদাবাড়িতে। সেই মাগুরা শহর থেকে আরও এক ঘণ্টা ভ্যানগাড়িতে পা দুলিয়ে আমরা চার বোন যাচ্ছি আর হেসে হেসে লুটিয়ে পড়ছি। আশপাশের পথিক, গ্রামের মানুষের চোখে যেন এক রঙিন সিনেমা—কারা এরা? কোথা থেকে এসেছে? না, আমরা চার বোনই খুব শালীন পোশাক পরেছিলাম, বড় ওড়না দিয়ে জড়ানো ছিল আমাদের শরীর। তবু আমরা কারও নজর এড়াতে পারিনি।

ক্লান্তিকর দারিদ্র্য, ক্ষুধা, সহায়হীন জীবনের সঙ্গে যুদ্ধ করা আমার গ্রাম, দাদাবাড়ির সেই টুপিপাড়া গাঁয়ের অনেকেই জেনেছিল আমরা বোনেরা কেবল ঢাকা থেকে আসিনি, বরং মার্কিন মুলুকের কোনো স্বপ্নে দেখা শহরে আমাদের বাস।

আজকে টরন্টো শহরে মাইনাস ২৭ ডিগ্রি সেলসিয়াস তাপমাত্রা। এখন ভোর পাঁচটা। এই ভোরেই একটা ছোট সিদ্ধান্ত নিলাম। আগামীকালও অনেক ভোরে উঠে যাব। হয়তো এই চারটা-পাঁচটা নাগাদ। নিজের ঘরেই চা বা কফি বানিয়ে খাব, একটা ছোট ক্যাটল রাখব সাইড টেবিলে। তারপর ইন্টারনেটে বসে মৌলিক কিছু কাজ করব, যেমন জব খোঁজা বা বই পড়া। নিজের জগৎকে নিজের মতো গোছাতে হবে। কেউ আমাকে সময় দিয়ে সুখী করবে, এই ভাবনা আরও কঠিন করে ঝাড়তে হবে মাথা থেকে। ঝেড়েছি অনেক আগেই। তবু মন কেমন কাদার মতো হয়ে যায় নীরব রাতে বা খুব ভোরে। মানুষ নাকি একবার ভুল করে। কিন্তু আমি দেখি, মানুষ আজন্ম ভুল করে। যাক সেসব প্যাঁচাল।

আরও পড়ুন

গত বুধবার মাগুরা থেকে ফিরে কী করেছিলাম? ১৩ বছর পরে ঢাকায় ফিরে কেমন লাগল আমার? একান্ত নিজের মনে কথা বলতে থাকি। বালিশে চোখ মুছেছি কয়েকবার, আজকেই মাথার কাছে একটা টিস্যুবক্স নিয়ে রাখতে হবে। ঢাকায় সবাইকে ফেলে চলে এলাম এই দূরদেশে—একটা একাকী জীবনে, ভীষণ একা লাগে। অনেক বছর ধরেই একাকী জীবনে অভ্যস্ত। হয়তো সে কারণেই খুব বেশি কোলাহল আর নিতে পারি না।

তবু মন কাঁদে, বিশেষ করে ৮২ বছরের বাবার কথা মনে হলে কেমন হতবিহ্বল লাগে। কী করলাম এই জীবনে? আমার পরিণতি অবশ্যই বাবার চেয়ে কঠিন হবে, অনেক কঠিন; কেউ কি হাত রাখবে আমার মাথায়? সারা দিনের ২৪ ঘণ্টায় মানুষ কি কোনো মুহূর্তে নিজের কাছে সৎ এবং সত্য বলে? মঙ্গলবার ভোর চারটায় বাসা থেকে বের হয়েছি। ফ্লাইট ছাড়বে ছয়টায়, আগের রাতেই বাবার সঙ্গে কথা বলে বিদায় নিতে চেয়েছিলাম। বাবা বললেন, ‘না না, তুমি চিন্তা কোরো না, আমি ভোরে উঠে যাই।’

তাই অপেক্ষা করেছি। কিন্তু ভোরবেলায় বাবার বিছানার কাছে গিয়ে দেখি, তিনি জেগে আছেন, কিন্তু বিছানা ছাড়েননি। আমি মাথার কাছে বসে দুটি সুরা পড়লাম। চেষ্টা করলাম একটু কাঁদতে। চোখে পানি এল না বলে কেমন ভার হয়ে আসছিল ওই কয়েকটা মিনিট। দুই হাত তুলে পরম করুণাময়কে বললাম, ‘আমার বাবাকে তুমি সবচেয়ে কম কষ্ট দিয়ে পৃথিবী থেকে তুলে নিয়ো খোদা।’

বাবা জেগে ছিলেন ওই সময়টুকু। কী ভাবছিলেন তিনি? ওনার মাথায় হাতে দিয়ে বললাম, ‘কিছু চিন্তা করবে না বাবা। তুমি গোটা একটা জীবন পার করেছ, আমাদের সৎ পয়সায় বড় করেছ। কারও ভাগ্য মেরে এই জীবন তুমি যাপন করোনি। মনে রেখো বাবা, পৃথিবীর যেই প্রান্তেই থাকি না কেন, আমরা চার বোন কষ্ট করে পয়সা উপার্জন করে জীবন চালাই। জীবনের এই অমোঘ মন্ত্র আমরা তোমার কাছে থেকে পেয়েছি। আর কী চাওয়ার আছে এই নশ্বর জীবনের কাছে বাবা! এর চেয়ে বেশি প্রাপ্তি মানুষ হিসেবে আর কারও দরকার নেই। তুমি নিশ্চিন্তে ঘুমাও।’

বাবা কি কাঁদলেন একটু? পাশ ফিরে শুয়ে ছিলেন। আমি আবার ওনার সাদা চুলে হাত রাখি। একসময় ঘড়ির কাঁটার ওপরে চলা এই বাবা আজ ফ্যালফ্যাল করে চেয়ে থাকেন। জীবন কি ভয়ংকর কঠিন এবং নির্মম।

ধানমন্ডি পুরোনো ১৯ নম্বর বাড়ি ছেড়ে আসতে কষ্ট হচ্ছিল সংগত কারণেই। অন্ধকার ভোরে মাইক্রোতে আমরা চার বোন, সঙ্গে মা আর আজাদ—সবাই বেশ চুপচাপ। এটা একটা পরিকল্পিত সফর, প্রতিটি দিন হিসাব করা ছিল। ১৪ তারিখে টরন্টো ফিরতে হবে, ১৫ তারিখ থেকে অফিস যেতে হবে—সবকিছুই ছিল পরিকল্পনার অংশ।

আমি ফিরে ফিরে তাকাই আম্মার মুখের দিকে—এই সেই মা, একদিন যাঁকে যমের চেয়েও বেশি ভয় পেতাম; আজ তিনি কেমন আদুরে শিশু হয়ে উঠেছেন।

কিন্তু দীর্ঘ ১৩ বছর পর দেশে গিয়ে কতটা ভালোবাসা পাব অন্য সবার কাছে থেকে, সেটাও কি চড়া দামে টিকিট কাটার মতো কনফার্ম ছিলাম আমি বা অন্য বোনেরা? সেটা কি কেউ বলতে পারে কোনো দিন? ঢাকায় যাওয়ার আগেই ঠিক করেছিলাম, ফেসবুক খুলব না এবং নিজে সেলফোন নেব না। দ্বিতীয় সিদ্ধান্তে অটল থাকতে পরিনি। যাওয়ার আট দিন পরে ছোট বোন শাহিন একটা সেলফোন দিয়েছিল।

সব অনুভূতি এসে ভিড় করছে এই মুহূর্তে। কী করে লিখি করোটিতে বয়ে চলা এই অনুভূতির কথামালা? যে বন্ধু ছোট করে লিখে জানাল, ‘লুনা, এত বছর পরে তোকে পেলাম, মন ভরেনি রে, একবারেই না—তুই আবার আয়।’ কী করে ভুলে থাকি এই আহ্বান?

এয়ারপোর্টে সিকিউরিটি গেট পার হওয়ার সময় ছোট বোন কনা পেছন ফিরে তাকায় না। কারণ, ও জানে আম্মা কাঁদছেন হাপুস হয়ে। কিন্তু আমি ফিরে ফিরে তাকাই আম্মার মুখের দিকে—এই সেই মা, একদিন যাঁকে যমের চেয়েও বেশি ভয় পেতাম; আজ তিনি কেমন আদুরে শিশু হয়ে উঠেছেন। একদিন যে মায়ের চোখের দিকে না তাকিয়ে এক টুকরা মাছ পর্যন্ত নিতে পারিনি, এই মাত্র সেদিন বিশ্ববিদ্যালয়জীবনেও যখন বারবার মনে হতো কবে আম্মার শিকল থেকে স্বাধীন হব! আজকে সেই মাকে যা বলছি, তাতেই রাজি হচ্ছেন! কেমন অবাক করা জীবন, তাই না?

আমি তাই ফিরে ফিরে তাকাই ভালোবাসার মানুষের দিকে। বন্ধুরা যখন আটতলা লিফট থেকে নেমে একদম ছাদ বরাবর কোনা থেকে রিকশা নিত, আমি ছাদের কোনায় দাঁড়িয়ে থেকে একদম চলে যাওয়া অবধি শেষ দৃশ্য দেখতাম। আজন্মই গোটা জীবনটা দেখতে ইচ্ছা হয়, ভালোবাসা বা দুঃখেরও শেষটা দেখতে ইচ্ছা হয় ভীষণ।

মাত্র ২১ দিনের সফরে কয়েক ট্রিলিয়ন ভালোবাসার অনুভূতি নিয়ে ফিরেছি। অল্প সময় ছিলাম বলেই কি বন্ধু আর পরিবার–পরিজনদের এমন পাগল করা বুক নিংড়ে দেওয়া সময় আর ভালোবাসার সাক্ষী হলাম?

আরও লিখতে চাই, দেশের সবার কথা লিখতে চাই এই সিরিজেই। এই লেখার প্রথম প্যারার মতো, খুব ভোরে উঠব আগামীকাল—করোটিতে বহন করা অনুভূতি লিখে হালকা হতে চাই।

১৮ ফেব্রুয়ারি ২০১৯

টরন্টো, কানাডা