করোটির কথামালা (পর্ব ১১)
মুহূর্তের জন্য উদাস হওয়া ইঠার মন অন্য কোথাও ছিল তখন। আমাকে বলল, ‘না মাহমুদা, আমি আর বিমানবালার কাজ করব না। অন্য কাজ করব এবং বাচ্চাদের বড় করতে সময় দেব, অনেক বেশি সময় দেব।’
লাথিটা সরাসরি বুক বরাবর মেরেছে আবিবা। ইথিওপিয়া থেকে আসা এই পরিবার গত বছর জুলাই মাসে আমাদের শেল্টারে আসে। রোটেশনের ভিত্তিতে কাউন্সিলর নির্বাচিত হয় অফিসে। আবিবা আর ওর বউ ইঠাকে দেখে খুব চমকে উঠেছিলাম, তাদের কাউন্সিলর আমি। ইঠা অপরূপ সুন্দরী আর স্মার্ট। আদ্দিস আবাবা আন্তর্জাতিক বিমানে ইঠা একজন সুপরিচিত বিমানবালা ছিল। পরিচয় সূত্রেই জানতে পারি, পাশে বসা স্বামী আবিবা, সঙ্গে ফুটফুটে দুই মেয়ে।
অনেক বছর আগে আমার খুব কাছের বন্ধু লাবণী বিমানবালা ছিল। সে এত বেশি সুন্দর, মেধাবী আর আকর্ষণীয় মেয়ে ছিল যে আমি প্রায় দ্বিধায় পড়ে যেতাম আসলেই কি লাবণী আমাকে ভালোবাসে? কাছের বন্ধুর মতো করে দেখে? লাবণী খুব কাছের বন্ধু, এখনো কাছের; যদিও যোগাযোগ তেমন হয় না। সেই ১৯৯৫ সালে ওর সঙ্গে খুব গভীর বন্ধুত্ব হয়ে ওঠে। কতভাবে যে লাবণীকে চিনেছি গত ৩০ বছরে, কিন্তু আজও বিমানবালা বললেই আমার চোখে লাবণীর সেই রক্তিম কনে দেখা আলোর মতো মুখটা ভেসে ওঠে।
তাই ২০১৯ সালে শেল্টারে ক্লায়েন্ট ইঠা আর আবিবার পরিবারকে যেদিন প্রথম ইনটেক সেশনে (ইনটেক মানে হচ্ছে যেদিন কাউন্সিলররা সেবা পরিকল্পনা নিয়ে ক্লায়েন্টের সঙ্গে সেশনে বসেন) বসেছিলাম, সেদিনই একটু সহজ হওয়ার জন্য ইঠাকে লাবণীর কথা বলি। পাশাপাশি এও বলি, ‘ইঠা, যদিও তুমি রিফিউজি দাবি করে কানাডায় এসেছ, এই দেশে হালে পানি পেতে হয়তো কিছুদিন সময় তোমার লাগবে। কিন্তু মনে রেখো, কানাডার ইমিগ্রেশন মিনিস্টারও একজন রিফিউজি। মাত্র ৩২ বছর আগে একদিন, সেও তোমার মতো করেই একই দাবি নিয়ে এসেছিল। সুতরাং, তুমিও চেষ্টা করলে কানাডাতেও বিমানবালা হতে পারবে।’
কিন্তু মুহূর্তের জন্য উদাস হওয়া ইঠার মন অন্য কোথাও ছিল তখন। আমাকে বলল, ‘না মাহমুদা, আমি আর বিমানবালার কাজ করব না। অন্য কাজ করব এবং বাচ্চাদের বড় করতে সময় দেব, অনেক বেশি সময় দেব।’
আমার ছিদ্রান্বেষী মন। অবাক হয়ে তাও বলেছিলাম, ‘এই দেশে বাচ্চারা নিজেদের মতো বড় হবে, তোমার নিজের জীবন গুছিয়ে নেওয়ার এই তো সময়।’
যা হোক, এরপর যা হয়, ৪৬টা পরিবারের দেখাশোনা করতে গেলে কি কেবল ইঠা আর আবিবাকে নিয়ে পড়ে থাকলে চলবে? হারিয়ে যাই নিত্যদিনের কাজের ভিড়ে। কিন্তু ইঠা থেকে যায় মনের কোণে। একই ভবনে ক্লায়েন্টরাও থাকে, আমরাও অফিস করি। সুতরাং, পথে পথে দেখা তো হতেই হবে। কোনো কোনোদিন দেখি ইঠা বেশ সুন্দর করে সেজে নানান কাজে দৌড়ে দৌড়ে ছুটছে; সে তুলনায় আবিবা বেশ আয়েশি দিন পার করে—দেখি বাচ্চাদের নিয়ে স্কুলে নামায়–উঠায়, আবার দেখি লবিতে, ডাইনিং রুমে বসে অন্য ইথিওপিয়ানদের সঙ্গে চুটিয়ে আড্ডা দিচ্ছে।
বাদ সাধল গতকাল সকাল দশটার দিকে। এমনিতেই করোনার দিন, নানা বাধা দিয়ে বেঁধে দেওয়া অফিস সময় পার করতে হচ্ছে, ক্লায়েন্টদের সঙ্গে দেখাসাক্ষাৎ ভীষণ কম করে দিয়েছে। একজন নার্স যেমন বলতে পারবে না যে চাকরিতে যাবে না, তেমনি কষ্টির তিনটা শেল্টার স্টাফরা বাসা থেকে কাজ করতে পারবেন না, অফিসে আসতেই হবে। যখন গতকাল আবিবা এসে বলল, ‘মাহমুদা, তোমার সঙ্গে জরুরি কথা বলতেই হবে।’ আমি সাহস করেই দরজায় দাঁড়িয়ে নিরাপদ দূরত্ব বজায় রেখে বলি, ‘বলো কী বলবে?’ আবিবা বলে, ‘তুমি কি আমাকে অন্য শেল্টারে স্থানান্তর করতে পারো?’
ইঠা আমাকে রুমে ঢুকতে দিচ্ছে না। আমার মন তখনই কু ডেকেছিল। আবিবাকে বললাম, ‘তুমি নিচে যাও, আমি ফোন করছি, তুমি ফোন রিসিভ করো।’
বেশ অনেকক্ষণ ধরে শোনার পর আবিবাকে বললাম, ‘এই জরুরি অবস্থার ভেতর দয়া করে তোমরা চেষ্টা করো নিজেদের আবেগ নিয়ন্ত্রণে রাখতে। তুমি জানো, শহরে প্রায় ৬০ ভাগ কাজ বন্ধ হয়ে গেছে, কোথাও ইন-পারসন সেবা দেওয়া হচ্ছে না। আরও খারাপ সময় আসছে। দয়া করে আবিবা আমার কথা বোঝার চেষ্টা করো।’ কি জানি কী বুঝল আবিবা। তবে আমি খুব ভরসা নিয়ে বাসায় ফিরিনি। বারবার ইঠার মুখটা ভেসে উঠছিল চোখে।
টরন্টো শহরে করোনার এই দিনগুলোতে প্রতিদিন নতুন কিছু দেখছি। খুব ভোরে বাসে উঠে দেখি, বাসে পে করার পরে ড্রাইভার যে কাগজের ট্রান্সফার দেয়, সেটা দিল না। বলল, ‘আজ থেকে ট্রান্সফার বন্ধ, সব ধরনের ইন্টারেকশন বন্ধ।’ অফিসে চারপাশে রাখা বোতলে বোতলে হ্যান্ড স্যানিটাইজার, গ্লাভস, লেইসলের বড় বড় ডিব্বা; কষ্টি এইচআর থেকে হাজার রকমের মেইল আসছে; ভোর সাতটায় অফিস শুরু করি বলে আমিই সবার আগে দরজা খুলি, মেইল খুলি। আজকের মেইলে দেখি সবচেয়ে বড় খবর—গতকাল অফিস ছাড়ার পর পরই ইঠা পুলিশ কল করেছে আবিবাকে ধরিয়ে দেওয়ার জন্য। আবিবা ইঠার বুক বরাবর একটা লাথি মেরেছে কথা–কাটাকাটির এক পর্যায়ে।
আজ অফিসে সারা দিন সেই কেস সামলাতে সামলাতে ভাবছিলাম, করোনার দিনগুলোতে ইঠা-আবিবার এই সময়গুলো ‘করোটির খাতায়’ থেকে গেলে ক্ষতি কি! যেদিন অনেক অনেক সময় পাব, কাজ করার জোর থাকবে না, সেদিন নিজের খাতা খুলে ইঠাকে আবার মনে করব। হয়তো ঘুঘু ডাকা নীরব দুপুরে লাবণীকে ফোন করে বলব, ‘লাবণী, কেন তুই বিমানবালার কাজটা ছেড়ে দিলি? কেন?’ করোটিতে জমে থাকা কথাগুলো প্রতিদিন জীবন্ত হতে চায় মনের পাতায়; কিন্তু হায়, দিন শুরু হয় করোনা দিয়ে, রাত আসে এই ভেবে—আগামীকাল নিরাপদ থাকব তো?
ইঠা একদিন সব পাহাড় ঠেলে উজ্জ্বল আলোর মুখ দেখবে, নিশ্চয়ই দেখবে।
২০ মার্চ ২০২০
টরন্টো, কানাডা