বাউন্ডুলে এক আত্মা, হারিয়ে গেল জীবনের স্রোতে
একটুকরো জলজ্যান্ত ছেলেবেলা হঠাৎ হারিয়ে গেল। এ রকম একটা খবরের জন্য আমরা কেউ প্রস্তুত ছিলাম না। পিসতুতো দাদা মিল্টন আচার্য্য চট্টগ্রামে ১১ অক্টোবর সকাল সাড়ে আটটায় হৃদ্রোগে আক্রান্ত হয়ে এই পৃথিবীর মায়া ছেড়ে চলে গেলেন। অল্প কিছুদিন আগেই আমার একমাত্র পিসি নিভা আচার্য্য চৌধুরী চলে গিয়েছেন। মা হারানোর শোক একাকিত্ব বাড়িয়ে তুলেছে। একাকী মানুষের জীবনে মা একটা বড় জায়গা নিয়ে থাকে। এ ধরনের সন্তানেরা কখনো বড় হয় না।
এক বোহেমিয়ান দুরন্ত জীবনের নাম মিল্টন আচার্য্য। মিল্টন, নিউটন আর অপটিমা—আমার তিন পিসতুতো ভাইবোন। অন্য দুজনের পুত্র–কন্যা নিয়ে সুন্দর সংসারজীবন। কিন্তু সংসারে থেকেও সংসারজীবন তাঁকে টানে না। আমার মতোই চিরকুমার।
অনেক কথাই মনে পড়ছে। সেন্ট প্লাসিডস স্কুলের ছাত্র, পরবর্তী সময়ে জে এম সেন কিন্ডারগার্টেন স্কুলে পড়েছেন। বড় স্কুলে পড়লেও পড়াশোনায় কখনো তাঁর মন ছিল না। আমি যখন চট্টগ্রামে ফাইভ-সিক্সে পড়ি, তখন তিনি মেট্রিক পরীক্ষা দিচ্ছেন।
তখন পরীক্ষার ফলাফল সংবাদপত্রে প্রকাশিত হতো। সেদিন ফল প্রকাশিত হবে, রাউজান উত্তর গুজরা গ্রাম থেকে বাসে করে আমাদের পরিবার, পিসির পরিবার—সবাই শহরের বাসায় ফিরছি। মিল্টন দা সেবার আমাদের বাড়ির পূজা উৎসবে যোগ দিতে যায়নি। রাস্তা থেকে খবরের কাগজ কেনা হলো। হাজারো সফল পরীক্ষার্থীর মধ্য থেকে তন্ন তন্ন করে খুঁজেও মিল্টনদার রোল নম্বর পেলাম না। আমার মন খারাপ, অকৃতকার্য দাদার পাশে গিয়ে দাঁড়াতেই হবে। বাস থেকে নেমে নিজেদের বাসায় না গিয়ে পিসির সঙ্গে তাঁদের বাসায় ছুটে গেলাম। গিয়ে দেখি, ঘরের ভেতর মিল্টনদা তাঁর অন্য এক বন্ধুর সঙ্গে গান বাজিয়ে সিগারেটের ধোঁয়া উড়িয়ে নেচে বেড়াচ্ছেন। এই হলো অন্য জগতের এক মানুষ, পরীক্ষার পাস–ফেল তাঁকে বিন্দুমাত্র বিচলিত করে না। অথচ তিনি যাঁদের বইপত্র, পরীক্ষার নোটস সাপ্লাই করতেন, তাঁরা সবাই ভালোভাবে পাস করে গেছে।
পাথরঘাটা সেন্ট প্লাসিডস গির্জা স্কুলের পাশে পিসির বাসা ছিল। ছাদে কোনো রেলিং ছিল না। একবার বিজয়া দশমীতে তাঁর ঠাকুমার সঙ্গে গল্প করতে করতে তিনতলার ছাদ থেকে পাশের একতলার ছাদে পড়ে গিয়েছিলেন। সেদিনই এই তরুণের মৃত্যু হতে পারত। শরীরের হাড়গোড়, মাথা—সর্ব অঙ্গে মারাত্মক জখমের ক্ষত নিয়েও কোনোরকমে বেঁচে গিয়েছেন। আমার বাবা, পিসেমশাই—সবাই মিলে ঝাঁপিয়ে পড়ে চট্টগ্রামের বড় হাসপাতালে ভর্তি করে তাঁকে বাঁচিয়ে এনেছেন।
একেবারে আত্মভোলা কবি–শিল্পীর মতো একজন তরুণ। একসময় চুলের বাহারে সেজে ওঠে। আমাদের পাথরঘাটা জেলেপাড়ার বাসায় মাঝেমধ্যে ছুটে আসতেন। দুপুরে আমার মায়ের হাতে খেতেন। একেবারে ছেলে মানুষ। যাওয়ার সময় সরাসরি আমার মাকে বলেন, ‘মামি, কিছু হাতখরচ দিন।’ মায়ের হাত থেকে সেই টাকা নিয়ে বাসা থেকে নিচে নেমে দামি সিগারেট কিনে ফুঁকতে ফুঁকতে দেখতাম চলে যাচ্ছে। সেই নব্বইয়ের দশকের শুরুতে তাঁর সংগ্রহে থাকত সুমন চট্টোপাধ্যায়, পঙ্কজ উদাস, অনুপ জ্বালোটাসহ কত ভারতীয় শিল্পীর অ্যালবাম। গান, সিনেমা, সিগারেট, বন্ধুবান্ধব—এসব নিয়েই ছিল তাঁর পৃথিবী।
অথচ মনের একটা গভীর নির্জন জায়গাও ছিল। সেটা বরাবরই অনুভব করতাম। আমার সঙ্গে ঠিক দাদাভাইয়ের মতো নয়, একপ্রকার বন্ধুত্বপূর্ণ সম্পর্ক ছিল।
১৯৯৫ সালে একবার কলকাতায় চলে এসেছিলেন। আমি বেলুড় মঠসহ কত জায়গায় নিয়ে গিয়েছি। মঠের এক সাধুর সঙ্গে আলাপ করে চোস্ত ইংরেজিতে কথা বলে একপ্রকার ভাব জমিয়ে ফেললেন। চট্টগ্রামে রামকৃষ্ণ মিশনের যে শাখা আছে, সেখানে নিয়মিত যান—এসব সাধুকে বললেন। বেলুড় মঠ থেকে রামকৃষ্ণ কথামৃত কিনলেন। সেখান থেকে চলে আসার সময় জিজ্ঞেস করলাম, ‘সাধু মহারাজ তো বাঙালি ছিলেন; তা সত্ত্বেও ইংরেজিতে কথা বলে গেলেন কেন?’ হেসে বললেন, ‘আমি বাংলাদেশ থেকে এসেছি বলে, তিনি যেন আমাকে আকাট মূর্খ না ভাবেন, তাই বলে গেলাম।’
অন্তরে ভক্তিবোধ ছিল প্রবল। হয়তো সাধক হওয়ারও ইচ্ছা ছিল মনে। সে রকমই জীবনযাপনের দিকে এগোচ্ছিলেন। ঠাকুমার গলার একটা রুদ্রাক্ষের মালা নিজের কাছে রাখতেন। অথচ চট্টগ্রামে তাঁর পড়ার ঘরে দেখতাম লাগানো আছে বব ডিলান, মাইকেল জ্যাকসনের ছবি। এ এক বাউন্ডুলে বিশ্বমানব প্রকৃতির সাধক। মদ্যপানে কখনো কখনো খুঁজে নিতেন অন্য পৃথিবীর ঠিকানা। বেলুড়ে অল্প দিনের জন্য এসেছেন, এখানেও বেশ কিছু বন্ধু জুটিয়ে ফেলেছেন। আমাকে না জানিয়ে কলকাতা ছেড়েও চলে গেলেন একসময়। সেই শেষ দেখা। আজ এই অকালবিয়োগ মেনে নেওয়া বড় কঠিন। কিন্তু বন্ধনহীন স্বাধীন পৃথিবীর ডাকে ছুটে চলা এই যুবককে মা–বাবা, পরিবার কে কবে কখন আর আটকাতে পেরেছে? আজও সেই মুক্ত পৃথিবীর ডাকে সাড়া দিয়ে চলে গেলেন।
বিষয়টা খুবই আশ্চর্যের যে রাতে অফিস থেকে বাড়ি ফেরার পরে বাবা হঠাৎ আমাকে জিজ্ঞাসা করলেন, ‘বাংলাদেশ থেকে কেউ কি ফোন করেছে? নিভার বাৎসরিক কাজ, ও তো এসে গেল মনে হয়! ওরা কে কেমন আছে, কে জানে।’
আমি তখনো দুঃসংবাদটা শুনিনি। বাবাকে বললাম, ‘না, কেউ ফোন করেনি তো।’ এখন বুঝতে পারছি, বাবার মনের মধ্যেও কিছু একটা জানা হয়ে গিয়েছিল। এই ভাগনে-ভাগনিরা সবাই আমার বাবার কলিজার টুকরা। আর মিল্টনদার অকালপ্রয়াণের মধ্য দিয়ে আমাদের ভাইবোনদের মধ্যেও এখন থেকেই যাত্রাপর্ব শুরু হয়ে গেল।