মায়ের কণ্ঠে ভেসে আসা গানের সঙ্গে বেজে ওঠা হারমোনিয়াম

ছবি: এআই/বন্ধুসভা
বিয়ের পরের দিন একটা কালো রঙের হারমোনিয়াম এবং অন্যান্য অনেক উপহার-উপঢৌকনের সঙ্গে মা আমাদের বাড়িতে এলেন।

১৯৭৪ সালে মা–বাবার বিয়েতে জ্যাঠামশাই যৌতুক চেয়েছিলেন একটা হারমোনিয়াম। যৌতুক প্রথাকে আমি সমর্থন করি না। দুজন পাত্রপাত্রী নবপরিণয়ে নতুন ঘর বাঁধতে চলেছে; সেখানে টাকাপয়সা, গয়নাগাটি বা কিছু জিনিসপত্রের বিনিময়ে পাত্রী সম্প্রদান কিছুতেই সমর্থনযোগ্য নয়। এই যৌতুক প্রথা একধরনের সামাজিক অভিশাপ। কত বিয়ে ভেঙে গেছে, আবার বিয়ের পরেও সংসার সুখের হয়নি। তবু এই প্রথা বরাবর চলে আসছে।

মা কানে কম শুনতেন। ১৯৭১ সালে চট্টগ্রামের বাঁশখালীর কোকদণ্ডী গ্রামে খান সেনাদের ভয়ে পালিয়ে পালিয়ে থাকার সময় মায়ের টাইফয়েড হয়ে যায়। ঠিকমতো চিকিৎসা করাতে পারেননি। তার মধ্যে অনবরত গোলাগুলি, বোমা বিস্ফোরণের শব্দে মা বধির হয়ে যান। শিক্ষিত এবং দেখতে সুন্দরী সোনার টুকরা বধির পাত্রীকে আমার বাবারও পছন্দ হয়ে যায়। ঠাকুমা, ঠাকুদ্দা, জ্যাঠামশাইরাও না করেননি।

মামাবাড়িতে গানের পরিবেশ ছিল। মা আর দুই মাসি যখন পটিয়া কলেজে হোস্টেলে থেকে পড়াশোনা করতেন, সেখানেও দল বেঁধে গানের আসর বসত। এ রকম সংস্কৃতিমনস্ক একটি পরিবারের কাছে যৌতুক চাওয়া যায় না! তবু বিয়েতে যৌতুক হিসেবে সবাই যেমন কিছু চায়, জ্যাঠামশাইও আমতা আমতা করে একটা হারমোনিয়াম চেয়ে বসেন। আমাদের বাড়িতে ছোট কাকা তখন পাড়ায় পাড়ায় গান করে বেড়ায়। বাবা নিজের কাজের অবসরে বাড়িতে এবং এখানে–ওখানে কাঁধে মৃদঙ্গ নিয়ে দলের সঙ্গে পুঁথি পড়তে ছোটেন। যাত্রাদলে অভিনয়েও বাবার সুনাম আছে।

বিয়ের পরের দিন একটা কালো রঙের হারমোনিয়াম এবং অন্যান্য অনেক উপহার-উপঢৌকনের সঙ্গে মা আমাদের বাড়িতে এলেন। এর পর থেকে সবার গানের আগ্রহ বেড়ে গেল। বাড়িতে মাঝেমধ্যে গানের আসর বসত। মা–বাবা, কাকা, ঠাকুমা সবাই মিলে বসাতেন গানের জলসা।

চট্টগ্রামে সনাতন ধর্মের মানুষের মধ্যে শ্রাবণ মাসে মনসাপূজার একটা পার্বণ আছে। সারা মাস মনসার পূজার পাশাপাশি মনসামঙ্গল কাব্যের পুঁথি পাঠ করা হয়। আমাদের বাড়িতে গৃহদেবতা কালী আছে। বাড়ির সবাই বিশেষত ঠাকুমা বলিষ্ঠ কণ্ঠে সুন্দর চণ্ডী পাঠ করতেন। মনসাপূজাও হয়। সারাটা মাস মনসার পুঁথিপাঠে বাড়ির উঠানে যেমন আসর জমে উঠত, আমাদের রাউজান উত্তর গুজরা গ্রামের অন্য অনেক বাড়িতে গিয়েও বাবা, ঠাকুমা, কাকাকে পুঁথি পড়তে হতো। ঘরের হারমোনিয়ামের সুর তখন তাই গোটা গ্রামে ছড়িয়ে পড়তে শুরু করে।

কাকার বিয়ে হলো। কাকার এক শ্যালক কলকাতায় ব্যাগের ব্যবসা করে। কাকাও তাই রুটিরোজগারের আশায় নতুন বউকে নিয়ে কলকাতায় চলে এলেন। তত দিনে আমার বাবা মাকে গ্রাম থেকে চট্টগ্রাম শহরে ভাড়া বাসায় নিয়ে আসেন। হারমোনিয়ামসহ বিয়েতে পাওয়া অনেক উপহার সেই বাসাতে নিয়ে আসা হয়।

আমার মা কখনো কোথাও গান শেখেননি, কোথাও কোনো অনুষ্ঠানেও গান করতে যাবেন বলেও প্রস্তুতি নেননি। নিজের মন ভালো করার জন্য গান করতে বসতেন।

মা–বাবার বিয়ের পাঁচ বছর পর চট্টগ্রাম শহরের হাসপাতালে আমার জন্ম। বাকলিয়া অঞ্চলে ক্লাবের ছেলেরা পাড়ার রবীন্দ্র-নজরুলজয়ন্তী পালনের জন্য একদিন হারমোনিয়ামটা নিয়ে গেল। সেদিন ছোট্ট আমারও শরীরটা বেশ খারাপ। সন্ধ্যাবেলা কাজ থেকে বাবা ফিরে আসার পর মা আমাকে নিয়ে বাসায় তালা লাগিয়ে ডাক্তার দেখাতে গেলেন। রাতে যখন ডাক্তার দেখিয়ে ফেরেন, পাড়ার মোড় থেকে শুধু দমকলের গাড়ি দেখা যাচ্ছিল। পুলিশ কাউকে আর এগোতে দিচ্ছে না। আমাদের কলোনির বাসায় আগুন লেগেছে। আশপাশের বাসাগুলো যে যতটা পারে নিজেদের জিনিসপত্র বের করে নিয়ে আসে; কিন্তু আমাদের বন্ধ ঘরের তালা আর খোলা সম্ভব হয়নি।

আমার তখন মাত্র তিন-চার মাস বয়স। শিশুপুত্রকে কোলে দিয়ে মা–বাবার সেই বিধ্বংসী রাতের কষ্ট যে কতটা প্রকট, তা আমার বোধগম্য নয়। এগুলো সবই মা–বাবা আর আত্মীয়দের মুখে যখন থেকে বোধ বুদ্ধি হয়েছে, তখন বারবার শুনেছি।

মা-বাবা দ্বিতীয়বার ঘর ভাড়া নিলেন জলিলগঞ্জে। বিয়েতে পাওয়া কোনো উপহারের অস্তিত্ব আর না থাকলেও হারমোনিয়ামটা সেখানে নিয়ে আসেন। নতুন করে শুরু হয় মা-বাবার অস্তিত্ব রক্ষার লড়াই। আমার ছোট মামা একদিন হারমোনিয়ামটা শহরের একটা আশ্রমের অনুষ্ঠানে নিয়ে গেলেন। বাবা ঢাকা থেকে ব্যবসার কাজ সেরে সেদিন বিকেলে ফেরেন। ছোট্ট আমাকে বিছানায় বসিয়ে কোলে নিয়ে আদর করছিলেন, মা চা বসিয়েছেন। এমন সময় চেঁচামেচি শুরু হয়ে গেল। আমাদের বাসার সারির শেষ বাসাটাতে আগুন লেগেছে। তৎক্ষণাৎ ছোট্ট আমাকে কোলে নিয়ে মা বেরিয়ে এলেন। বাবা কিছু কাগজ আর টাকাপয়সা যা আছে সঙ্গে নিয়ে বেরিয়ে এলেন। কিছুক্ষণের মধ্যেই তীব্র গতিতে ছড়িয়ে পড়া আগুনে আমাদের বাসাও পুড়তে শুরু করে। অসহায় মা-বাবা শিশুপুত্রকে কোলে নিয়ে চোখের সামনে সব পুড়ে ছাই হয়ে যেতে দেখলেন। কিছুই করতে পারলেন না।

আর বেড়ার বাসা নয়। ছয় মাসের মধ্যে দুবার ঘর পুড়ে যাওয়াতে বাবা সিদ্ধান্ত নিলেন, যত কষ্টই হোক এবার একটা বিল্ডিংয়ে পাকা বাসা ভাড়া নেবেন। হেরে গেলে চলবে না। আগুন যতবার পুড়িয়ে ফেলবে ততবার মাথা তুলে দাঁড়াতে হবে। পাথরঘাটা জাইল্যা পাড়াতে একটা বিল্ডিংয়ের দোতলায় আমরা ভাড়াটে হয়ে এলাম। এই বাসাতে এসে শৈশবে আমার বেড়ে ওঠা। সেন্ট স্কলাস্টিক স্কুলে নার্সারি, আর কেজিতে পড়া। জেএমসেন কিন্ডারগার্টেন স্কুলে প্রাইমারি আর মিউনিসিপ্যাল মডেল হাইস্কুলে ওপরের ক্লাস। ছোট বোন আর ভাইয়ের জন্মও হয়েছে এই বাসাতে।

মাকে দেখতাম বিকেলে কখনো কখনো হারমোনিয়াম নিয়ে গান করতে বসতেন। দু-তিনটা গানই শুধু ঘুরেফিরে গাইতেন— ‘আমার পরান যাহা চাই তুমি তাই তাই গো..’, ‘তুমি কি দেখেছ কভু জীবনের পরাজয়…’, ‘বলো রে বলো সবে/ বলো রে বাঙালির জয়/ বাংলাদেশের নদীর বুকে এই বলি গান গাহিয়া যায়...’।

আমার মা কখনো কোথাও গান শেখেননি, কোথাও কোনো অনুষ্ঠানেও গান করতে যাবেন বলেও প্রস্তুতি নেননি। নিজের মন ভালো করার জন্য গান করতে বসতেন। আমরা তিন ভাইবোন মায়ের গান শুনতাম। বাবার অনুরোধেও কখনো কখনো গান শুনিয়েছেন। আবার মা–বাবা আমাদেরও কখনো গান শেখানোর চেষ্টা করেননি। পড়াশোনার ওপরে বরাবর জোর দিয়ে এসেছেন।

বহু বছর দেশের কোনো আত্মীয়স্বজনের সঙ্গে আমাদের যোগাযোগ ছিল না। তার মধ্যে মামার মেয়েদেরও বিয়ে হয়ে গেছে। ছেলেমেয়ে হয়েছে।

পাথরঘাটার এই বাসায় ছোট মামা, বড় মাসির ছেলে, বড় মামার মেয়ে, আমার পিসির মেয়ে অনেকেই বেড়াতে এসে হারমোনিয়ামটা নিয়ে গান করতে বসতেন। পুরোনো দিনের তৈরি হারমোনিয়াম, কখনো খারাপ হয়নি। জ্যাঠা তখন চট্টগ্রাম শহর থেকে রাঙামাটি পর্যন্ত বাস চালাতেন। খুবই আমুদে ফুর্তিবাজ মানুষ। মাঝেমধ্যে গ্রামের দু-একজন গায়ক বন্ধু নিয়ে আমাদের বাসায় রাতে উঠতেন, আর শুরু হয়ে যেত গানের জলসা। সেই জলসায় একটা সময়ে আমাদের ছোটদের প্রবেশ নিষিদ্ধ হয়ে যেত। কারণ, গানের সঙ্গে ওদের পান শুরু হয়ে যেত।

দেশের বাড়িতেও দেখেছি, জ্যাঠা এমনিতে গান করেন না; কিন্তু পান করার পর ওঁর গানের সঙ্গে নাচ দেখার জন্য গোটা বাড়ি, এমনকি পাড়ার লোকেরাও ছুটে আসতেন। সেসব রঙিন দিন একসময় ফুরিয়ে এল। বাবা দেশ ছেড়ে চলে আসতে বাধ্য হলেন। শহরের বাসা ছেড়ে আমরা মাসির বাড়ি, মামাবাড়ি, নিজেদের বাড়িতে গিয়ে অল্প কিছুদিন করে থাকতে শুরু করি।

ছোট মামা বাসা থেকে হারমোনিয়ামটা নিয়ে গিয়ে বড় মামার বাসাতে রাখেন। শহরে দু-একবার বড় মামার বাসাতে এসে দেখেছি, মামার দুই মেয়ে নুনুদি আর টুনুদি সেই হারমোনিয়াম নিয়ে গান করতে বসেছেন। মামার ছোট ছেলের বউ মানে সেজ বৌদিও গান করেন। তাই একটা নতুন হারমোনিয়ামও ওদের আছে।

আমাদেরও দেশ ছেড়ে চলে আসতে হয় একসময়। সঙ্গে কিছু আনার মতো নেই। আমার বয়স তেরো, ছোট ছোট দুই ভাইবোন, কীভাবে অন্য একটা দেশে আসবে মায়েরও চিন্তা অনেক।

হারমোনিয়ামের মতো একটা বাদ্যযন্ত্র আনার মতো উপায় বা ইচ্ছাও তখন আর থাকার কথা নয়। একটা শূন্য জীবনে শুধু একটা বাদ্যযন্ত্র দিয়ে কী আর হবে? তবে এই বাদ্যযন্ত্রটি একেবারে মামুলিও কিছু নয়। সারাটা জীবন এত জ্বালাপোড়া যুদ্ধের মধ্যেও এই হারমোনিয়াম কখনো ক্ষতিগ্রস্ত হয়নি। আত্মা সজীব থেকেছে। জীবনের ভাঙা-গড়ার সুর পাশ থেকে ঠিক বয়ে গেছে। বুকের ভেতরে রয়ে গেছে। তখন মনে মনে ভেবেছি, মায়ের বিয়েতে পাওয়া মামাবাড়ির উপহার মামাবাড়িতেই নাহয় থাকুক। ওরা সুর তুলে ঠিক বাঁচিয়ে রেখে দেবে আমাদের স্মৃতি, আমাদের সুরের অস্তিত্ব।

পশ্চিমবঙ্গে চলে আসার পর উদ্বাস্তুজীবনের কষ্ট অনেক বেড়ে গেল। সুরহীন জীবনে মাঝেমধ্যে তবু হারমোনিয়ামটার কথা মনে পড়ত। একসময় ভাবতাম, দেশে গিয়ে মামাবাড়ি থেকে একদিন হারমোনিয়ামটা ঠিক চেয়ে নিয়ে আসব। এ যন্ত্র হৃদ্‌যন্ত্রের মতো কখনো পুরোনো হতে পারে না, জন্ম মাটির শ্বাসপ্রশ্বাস ছাড়া শিকড়হীন গাছ যেভাবে বেশি দিন বাঁচে না।

বহু বছর দেশের কোনো আত্মীয়স্বজনের সঙ্গে আমাদের যোগাযোগ ছিল না। তার মধ্যে মামার মেয়েদেরও বিয়ে হয়ে গেছে। ছেলেমেয়ে হয়েছে। মামার ছেলেদের সন্তানদেরও বিয়ে হতে শুরু করেছে। একসময় যখন আবার ওরা কেউ কেউ কলকাতায় বেড়াতে আসত, আমাদের সঙ্গে যোগাযোগ হতো, হারমোনিয়ামটার কথা জানতে চাইতাম।

এত পুরোনো হারমোনিয়াম যে কেউ আর ওটার কোনো অস্তিত্বের কথা বলতে পারেনি। হয়তো ঘুন ধরেছে, পোকায় কেটে ফেলেছে, নষ্ট হয়ে যাওয়াতে বহু বছর আগেই অকেজো পুরোনো আসবাবপত্র-জিনিসপত্রের সঙ্গে ফেলে দিয়েছে! জীবনযুদ্ধের অসংখ্য পোকার দংশনে আমার উদ্বাস্তু মা–ও হারিয়ে গিয়েছেন। কিন্তু আমার বুকের ভেতরে এখনো বেজে চলেছে সেই স্মৃতি, সেই সুর। শেষ বিকেলে মায়ের কণ্ঠে ভেসে আসা গানের সঙ্গে বেজে ওঠা হারমোনিয়াম।

হাওড়া, পশ্চিমবঙ্গ, ভারত