মুসলিম সমাজ জাগরণের দীপ্ত অধ্যায় মুসলিম ইনস্টিটিউট
১৭৫৭ সালের পলাশীর যুদ্ধ ছিল উপমহাদেশের রাজনৈতিক ইতিহাসে এক গভীর মোড় ঘোরানো অধ্যায়। এ যুদ্ধে নবাব সিরাজউদ্দৌলার পরাজয়ের মাধ্যমে বাংলার শাসনভার চলে যায় ব্রিটিশ ইস্ট ইন্ডিয়া কোম্পানির হাতে। পরবর্তী সময়ে ব্রিটিশরা ‘চিরস্থায়ী বন্দোবস্ত’ প্রবর্তনের মাধ্যমে মুসলমান জমিদারদের জমি ও ক্ষমতা কেড়ে নেয়। ফলে মুসলিম সম্প্রদায় শুধু অর্থনৈতিকভাবেই নয়, সামাজিক ও শিক্ষাগত দিক থেকেও পিছিয়ে পড়ে। বিজ্ঞানমনস্কতা, মুক্তচিন্তা ও আধুনিক শিক্ষার মূলধারায় মুসলমানদের অংশগ্রহণ ক্রমশ হ্রাস পেতে থাকে।
এই পশ্চাৎপদতা দূর করতে সময়ের পরিক্রমায় কিছু উদার, শিক্ষিত ও মানবহিতৈষী মানুষ এগিয়ে আসেন। মুসলিম সমাজকে আধুনিক শিক্ষায় শিক্ষিত করে আত্মমর্যাদায় প্রতিষ্ঠিত করার প্রয়াস শুরু হয়। সেই লক্ষ্যে ১৮৬৩ সালে ডেপুটি ম্যাজিস্ট্রেট আবদুল লতিফের উদ্যোগে কলকাতায় প্রতিষ্ঠিত হয় মোহামেডান লিটারারি সোসাইটি। এটি ছিল মুসলমানদের জন্য প্রথম সংগঠিত আধুনিক শিক্ষা ও সংস্কৃতিচর্চার কেন্দ্র। এরপর ধাপে ধাপে গড়ে ওঠে ‘সেন্ট্রাল ন্যাশনাল মোহামেডান অ্যাসোসিয়েশন’-এর মতো সংগঠন, যা বিভিন্ন অঞ্চলে মুসলিম সমাজ উন্নয়নে কাজ করে।
এই আন্দোলনের ধারাবাহিকতায় ব্রিটিশ ভারতের দ্বিতীয় বৃহত্তর জেলা ময়মনসিংহ শহরে ১৯৩১ সালের মে মাসে আত্মপ্রকাশ করে মুসলিম ইনস্টিটিউট, ময়মনসিংহ। এটি ছিল একটি অরাজনৈতিক, সমাজসেবামূলক ও সাংস্কৃতিক প্রতিষ্ঠান। উদ্দেশ্য ছিল মুসলমান সমাজকে আধুনিক শিক্ষার আলোয় আলোকিত করা, সাহিত্য ও সংস্কৃতিচর্চার পরিবেশ গড়ে তোলা এবং সমাজে ভ্রাতৃত্ব ও ঐক্য সৃষ্টিতে ভূমিকা রাখা।
প্রতিষ্ঠানটির পেছনে অনুপ্রেরণাদাতা হিসেবে যাঁদের নাম শ্রদ্ধাভরে স্মরণ করা হয়, তাঁদের মধ্যে রয়েছেন করটিয়ার জমিদার ওয়াজেদ আলী খান পন্নী, খান বাহাদুর মোহাম্মদ ইসমাঈল হোসেন, সৈয়দ নবাব আলী চৌধুরী ও এ কে গজনবী। এ ছাড়া ময়মনসিংহ অঞ্চলের অনেক সুধীজন ও দানশীল ব্যক্তিরা এ প্রতিষ্ঠান গঠনে সহায়তা করেন।
প্রথমে ‘আঞ্জুমান ইসলামিয়া’র স্বত্বাধীনে নগরীর ১০ নম্বর শ্যামাচরণ রায় রোডে শূন্য দশমিক ৪১ শতাংশ জমির ওপর কাঠ ও টিনের চৌচালা ঘরে শুরু হয় এর কার্যক্রম। গঠনের শুরুতে একটি সুস্পষ্ট গঠনতন্ত্র প্রণয়ন করা হয়, যাতে ছয়টি মৌলিক ধারা নির্ধারিত ছিল। এই গঠনতন্ত্র অনুযায়ী প্রাতিষ্ঠানিক কার্যক্রম পরিচালিত হতে থাকে। তৎকালীন সমাজের দানশীল ব্যক্তিদের অনুদানের মাধ্যমে অর্থায়ন করা হতো প্রতিটি কর্মকাণ্ড।
প্রতিষ্ঠার এক বছরের মধ্যেই পরিচালনা পর্ষদ একটি দৃষ্টিনন্দন পাকা ভবন নির্মাণের উদ্যোগ গ্রহণ করে। ১৯৩৩-৩৪ সালে নির্মিত হয় সেই ভবন, যা আজও ময়মনসিংহ শহরের অন্যতম গুরুত্বপূর্ণ ও ঐতিহাসিক স্থাপনা হিসেবে বিবেচিত হয়।
ময়মনসিংহের মুসলিম ইনস্টিটিউট শুধুই একটি প্রতিষ্ঠান নয়, এটি ছিল মুক্তবুদ্ধি, চিন্তার স্বাধীনতা, সাহিত্য-সংস্কৃতি ও সামাজিক ভ্রাতৃত্বের এক উন্মুক্ত মঞ্চ। প্রতিষ্ঠার সূচনালগ্নেই এখানে গড়ে তোলা হয় একটি সাধারণ পাঠাগার, যাতে সাধারণ মানুষ জ্ঞানচর্চার সুযোগ পায়। পাশাপাশি তরুণদের মানসিক ও শারীরিক বিকাশে ভূমিকা রাখতে প্রতিষ্ঠিত হয় একটি ব্যায়ামাগার।
এই প্রতিষ্ঠান শিক্ষিত সমাজের মিলনকেন্দ্র ছিল; যেখানে সাহিত্যচর্চা, আলোচনা সভা, বিতর্ক, বক্তৃতা ইত্যাদির মাধ্যমে বুদ্ধিবৃত্তিক পরিবেশ গড়ে তোলা হতো। এতে মুসলিম তরুণদের মধ্যে আত্মবিশ্বাস, নেতৃত্ব ও সমাজসচেতনতা বাড়তে থাকে।
বর্তমানে মুসলিম ইনস্টিটিউট তার ঐতিহাসিক ঐতিহ্য ধরে রেখেছে। এটি এখনো বিভিন্ন সাংস্কৃতিক ও সমাজকল্যাণমূলক কর্মকাণ্ডের মাধ্যমে ময়মনসিংহ শহরের সাংস্কৃতিক প্রাণকেন্দ্র হিসেবে বিবেচিত হয়।
সভাপতি, ময়মনসিংহ বন্ধুসভা