শিক্ষকের দায়িত্ব শুধু পাঠদান নয়, মূল্যবোধ ও মনন গঠনেরও

একজন শিক্ষক প্রতিটি শিক্ষার্থীর আদর্শ। তাঁর কথা, আচরণ, চলাফেরা, পোশাক সবই ছাত্রদের কাছে অনুকরণীয়ছবি: লেখকের সৌজন্যে

একজন শিক্ষক যখন ক্লাসে ঢোকেন, তাঁর ব্যাগে শুধু বই থাকে না; থাকে অনুপ্রেরণার গল্প, ভালোবাসার চোখ, সাহস জোগানোর হাত।

আমি আমার প্রতিটি ক্লাস শেষে শিক্ষার্থীদের সব সময় বলি, ‘সবশেষে কী করব না করব, কিংবা ক্লাস টপার হব কি না সব পরে; আগে একটি জিনিস মনে এবং মস্তিষ্কে গেঁথে রাখবে, মানবিক মানুষ হতে হবে।’

মাঝেমধ্যে ক্লাসে একটি ছোট্ট খেলা খেলি, ভয়ের মোড়কে হাসানোর কৌশল। সবাইকে শান্ত করে গল্প শুরু করি, ছাত্রছাত্রীরা মনোযোগ দিয়ে শোনে, ঠিক তখনই হঠাৎ একটা চিৎকার! তারপর পুরো ক্লাসজুড়ে বিস্ময় আর হেসে কুটি কুটি হওয়ার শব্দ। এ এক অদ্ভুত আনন্দ, যা আমিও উপভোগ করি।

আমার প্রতিটি শিক্ষার্থীর জন্য বারবার পাঁচটি শব্দ রপ্ত করানোর প্রয়াস করি—মানবিকতা, বিনয়, পরিশ্রম, সৎ উদ্দেশ্য ও অহিংস মনোভাব। পাঠ্যবইয়ের বাইরেও এই পাঁচটি গুণ যদি হৃদয়ে গেঁথে যায়, তবে একেকজন শিক্ষার্থী হয়ে উঠবে একেকজন ‘মহারত্ন’।

শিক্ষকতার জায়গা থেকে কিছু দুঃখবোধও তৈরি হয়েছে। প্রশিক্ষণসূত্রে নানা প্রতিষ্ঠানে যাওয়ার সুযোগ হয়েছে, দেখি সহকর্মীদের। কেউ কেউ শিক্ষকতাকে শুধুই চাকরি হিসেবে দেখেন, সময় ধরে আসেন আবার বের হয়ে যান। কেউ কেউ শিক্ষার্থীদের সম্ভাবনা ও অগ্রগতির জন্য আন্তরিকভাবে কাজ করেন। এই বৈপরীত্য আমাকে ভাবায়।

কিছু প্রশ্ন বারবার মনে আসে—কেন আজকের প্রজন্ম শিক্ষকের কথা মনে রাখে না? কেন শিক্ষকেরা শিক্ষার্থীদের দ্বারা লাঞ্ছিত হন? এ দায় কি শুধুই সময়ের? সমাজের? নাকি আমাদের শিক্ষকদের মধ্যেই কোথাও কিছু ভুল হচ্ছে, যা আমরা বুঝতে পারছি না? শিক্ষকতা কি শুধুই পেশা? নাকি মানুষ গড়ার এক নিরন্তর দায়িত্ব? যেখানে কেবল সিলেবাস নয়, শেখাতে হয় মমতা, সহনশীলতা, ন্যায়বোধ ও বিবেক।

একজন শিক্ষক হবেন নিরহংকার, অহিংস, মানবিক, স্বার্থপরতা ও সংকীর্ণতার ঊর্ধ্বে। এই গুণগুলোর আলো ছড়িয়ে দেবেন প্রতিটি শিক্ষার্থীর হৃদয়ে
ছবি: লেখকের সৌজন্যে

কেন শিক্ষকেরা বড় হতে পারেন না? সমাজে যাঁদের সবচেয়ে গুরুদায়িত্ব ‘মানুষ গড়া’। তাঁরাই হন উপেক্ষিত, অবহেলিত কিংবা অসম্মানিত। এর উত্তরটি আমার কাছে, শিক্ষকতা বড় হবে তখনই, যখন তা কেবল পেশা নয়, প্রেরণা হয়ে উঠবে। শিক্ষক বড় হবেন তখনই, যখন সমাজের চোখে সম্মানের আসনে তাঁর স্থান হবে চিরস্থায়ী।

আমি একজন শিক্ষক, কিন্তু একসময় ছিলাম একজন শিক্ষার্থী। তখন কিছু বুঝতাম কম, কিন্তু এখন বুঝি। আমার অনেক শিক্ষক ছিলেন মহান। আবার এমনও কজন ছিলেন, যাঁরা কথায় বা ব্যবহারে নিজেদের ছোট করে ফেলতেন। যেমন:
‘একজন শিক্ষক ক্লাসে দাঁড়িয়ে অন্য একজন শিক্ষককে নিয়ে হাসাহাসি করেন, কটাক্ষ করেন; বলতেন, আমি যা বলি তাই। অমুক/তমুক কি কিছু পারে নাকি?’

এ ধরনের মন্তব্য শুধু অন্যকে ছোট করে না, নিজের অবস্থানও নিচু করে। ছাত্রছাত্রীরা এতে শেখে মানুষকে পেছনে পড়ে নিন্দা করা যায়।
আরেকটি বড় সমস্যা হলো—প্রাইভেট পড়ানো ঘিরে বৈষম্য। যাঁরা ক্লাসের শিক্ষকের কাছে আলাদা করে পড়েন, তাঁরা বেশি আদর পান, বাকি সবাই বঞ্চিত হন। এতে শিক্ষার্থীরাও শেখে বৈষম্য করা স্বাভাবিক।

আমার মতে, একজন শিক্ষক প্রতিটি শিক্ষার্থীর আদর্শ। তাঁর কথা, আচরণ, চলাফেরা, পোশাক সবই ছাত্রদের কাছে অনুকরণীয়। তাই তাঁর দায়িত্ব শুধু পাঠদান নয়, মূল্যবোধ ও মনন গঠনেরও।

শিক্ষক দিবস যেন শুধু একটি তারিখ না হয়। হোক এমন একটি দিন, যেদিন আমরা নিজেদের বিবেক জাগ্রত করতে পারি। শিক্ষক শুধু পাঠদাতা নন, তিনি হোন আদর্শের পথপ্রদর্শক। একজন শিক্ষক হবেন নিরহংকার, অহিংস, মানবিক, স্বার্থপরতা ও সংকীর্ণতার ঊর্ধ্বে। এই গুণগুলোর আলো ছড়িয়ে দেবেন প্রতিটি শিক্ষার্থীর হৃদয়ে।

বন্ধু, ভৈরব বন্ধুসভা