একটি রেলস্টেশনের কাব্য

বর্তমানে আয়ারল্যান্ডে বসবাস করছেন বন্ধুসভা জাতীয় পরিচালনা পর্ষদের সাবেক অর্থ সম্পাদক সজল মিত্র রিচার্ড। ঘুরে দেখছেন দেশটির দর্শনীয় সব স্থান। সেসব নিয়ে বন্ধুসভার পাঠকদের জন্য লিখেছেন তিনি। আইরিশ নৈসর্গিক রূপকথার ধারাবাহিক পর্বের দ্বিতীয় গল্পে থাকছে আয়ারল্যান্ডের মিডল্যান্ডে অবস্থিত মোউট রেলস্টেশনের কথা।

আয়ারল্যান্ডের মিডল্যান্ডে অবস্থিত মোউট রেলস্টেশনছবি: লেখক

মোউট রেলস্টেশন যেন এক ঐতিহাসিক জ্ঞানগহ্বর। ইতিহাসকে সামনে থেকে দেখার এক অনন্য অভিজ্ঞতা।

বিশ্বে রেল যোগাযোগ অত্যন্ত আধুনিক। বিংশ শতাব্দীর পথ মাড়িয়ে একবিংশ শতাব্দীতে সারা বিশ্বেই চোখধাঁধানো প্রযুক্তিসংবলিত রেল যোগাযোগব্যবস্থা দেখতে পাই। বাস্তবতার নিরিখে নাগরিক জীবনের ব্যস্ততা আর যোগাযোগের ক্ষেত্রে প্রযুক্তির আধুনিকতা—সব মিলিয়ে যোগাযোগের এই মাধ্যম অনন্য–অসাধারণ। আধুনিক মেট্রোরেল যখন বিশ্ব দাঁপিয়ে বেড়াচ্ছে, তখন আন্তশহর যোগাযোগে রেল খাত সেই প্রতিদ্বন্দ্বিতায় শামিল হবে, সেটি খুবই স্বাভাবিক।

আমাদের দেশের রেল খাত বিশ্বের সঙ্গে খুব বেশি তাল মেলাতে পারেনি। মূলত এশিয়ার বুকে চীন, জাপান, কোরিয়া রিপাবলিক ইত্যাদি দেশ ছাড়া বাকিরা রেল খাতে ইউরোপের তুলনায় কিছুটা পিছিয়ে। এটা মোটামুটি সবারই জানা। কিন্তু এর ব্যতিক্রমও রয়েছে। ইউরোপজুড়ে বিভিন্ন দেশে যোগাযোগের অন্যতম মাধ্যম এই রেল খাত অনেক জায়গায় যেমন প্রসিদ্ধ, ঠিক তেমনি ব্যবসায়িকভাবে লাভবান না হওয়ায় কিছু জায়গায় রেলস্টেশন বন্ধ হওয়ার অনেক নজির রয়েছে। বলছি সে কথাই। আয়ারল্যান্ডের মিডল্যান্ডে অবস্থিত মোউট রেলস্টেশনের কথা। বন্ধ হওয়ার পর মৃতপ্রায় এই স্টেশনে স্থানীয় পৌর কমিটি ও আইরিশ ইতিহাস গবেষণা সংস্থা মিলে এটিকে এখন গড়ে তুলেছে বিনোদন ও শরীরচর্চার কেন্দ্রবিন্দু হিসেবে।

আরও পড়ুন

পৌনে ২০০ বছর আগের কথা। কয়লার ইঞ্জিনের যুগ। তখন আয়ারল্যান্ড পুরোপুরি ব্রিটিশ কলোনি। ব্রিটিশরা আয়ারল্যান্ডের ভূখণ্ডকে চাষাবাদের জমি হিসেবে ব্যবহার করত। চিরসবুজ প্রকৃতির কারণে দেশটিকে এমনিতেই শুরু থেকে ইউরোপের গ্রাম হিসেবে অভিহিত করা হতো। পুরো আয়ারল্যান্ডের কেন্দ্র হিসেবে যদি বিবেচনা করা হয়, তাহলে মিডল্যান্ডের নাম বলতেই হবে। এই অঞ্চলের সবচেয়ে পুরোনো রেলস্টেশনটির নামই মোউট রেলস্টেশন। এটি প্রতিষ্ঠিত হয় ১৮৫০ খ্রিষ্টাব্দে। এরও পাঁচ বছর আগে এর কাজ শুরু হয়।

মূলত ব্যবসায়িক কাঁচামাল এবং পণ্য আনা-নেওয়ায় দেশটির দুই প্রান্তের যোগাযোগব্যবস্থা ঠিক রাখার জন্যই এই স্থাপনা গড়ে তোলে মিডল্যান্ড গ্রেট ওয়েস্টার্ন রেলওয়ে। ১৮৪৫ সালে প্রায় ৯ হাজার শ্রমিক এটির কাজ শুরু করেন। ১৮৫০ খ্রিষ্টাব্দে চালু হলেও কাজ পুরোপুরি শেষ হয় ১৮৫৪ সালে। বিখ্যাত আইরিশ রেলওয়ে ইঞ্জিনিয়ার উইলিয়াম ড্রাগনের তৈরি করা নকশা ও তত্ত্বাবধানেই তৈরি হয় এই স্টেশন। যিনি পৃথিবীবিখ্যাত স্কটিশ রেলওয়ে ইঞ্জিনিয়ার থমাস টেলফোর্ডের ছাত্র ছিলেন।

মোউট রেলস্টেশনে লেখক
ছবি: লেখকের সৌজন্যে

আয়ারল্যান্ডের স্বাধীনতাসংগ্রামেও এই স্টেশন জায়গা করে নিয়েছে। দেশের দুই প্রান্তের স্বাধীনতাসংগ্রামীদের যোগাযোগে বিশাল ভূমিকা রেখেছে মোউট রেলস্টেশন। প্রায় ১০০ বছর পর আয়ারল্যান্ড যখন ব্রিটিশ কলোনি থেকে স্বাধীনতা পেয়ে নিজেদের স্বয়ংক্রিয় উন্নয়নের দিকে যাত্রা শুরু করে, ঠিক তখন ১৯৪৫ সালে রেলস্টেশনের দায়িত্ব দেওয়া হয় মোউট রেলস্টেশন কোম্পানিকে। তখন আয়ারল্যান্ডের অর্থনীতি অতটা শক্তিশালী ছিল না। নিজেদের অর্থনৈতিক শক্তিকে স্থিরাবস্থায় আনতে তারা হিমশিম খাচ্ছিল। স্থানীয় লোকজনের ভাষ্যমতে, তখন স্টেশনের ব্যস্ততা ছিল চোখে পড়ার মতো। যাত্রীর পাশাপাশি পণ্য পরিবহনের জন্য এই স্টেশনের ব্যবহার অত্যন্ত জনপ্রিয় হয়ে ওঠে।

কিন্তু, একটা সময় বাদ সাধে অর্থনৈতিক দুরবস্থা। আইরিশ অর্থনীতি মূলত ঘুরে দাঁড়ায় একবিংশ শতাব্দীর শুরুর দিকে ইউরোপীয় ইউনিয়নে নিজেদের যোগদানের মধ্য দিয়ে। তার আগেই রেল যোগাযোগের ক্ষেত্রে দুর্বল হতে থাকে তখনকার আইরিশ সরকার। বিগত শতকের আশির দশকে আধুনিকায়নের অভাবে ভেঙে পড়ে রেল খাত, যার প্রভাব পড়ে সব জায়গায়। ১৯৯১ সালে আসে সেই বেদনার ক্ষণ। অনেকটা সীমাবদ্ধতার ছোবলে আরও অনেক স্টেশনের মতো হারিয়ে যায় এই স্টেশনও। মানুষের কাছেও এটি আর ব্যবহারের উপযোগী হয়নি শুধু আধুনিকতার অভাবে। ফলাফলে বন্ধ হয়ে যায় স্টেশনটি।

পুরো রেলট্র্যাকটাকে বিন্দুমাত্র ক্ষতি হতে দেয়নি তারা। সাইক্লিং ও হাঁটার জন্য তৈরি করা হয় ৪২ কিলোমিটার পিচঢালা পাকা সড়ক
ছবি: লেখকের সৌজন্যে

স্টেশনটি বন্ধ হওয়ার পর অযত্ন আর অবহেলায় এটি হয়ে ওঠে ধ্বংসপ্রাপ্ত। আগাছা ও জঙ্গলে পরিপূর্ণ হয়ে এটি পরিণত হয় জরাজীর্ণ ভাগাড়ে। স্থানীয় লোকজনের মুখে সেই সময়কার গল্প শুনলে মনে হবে যেন আমাদের কেউ ‘ঠাকুরমার ঝুলি’র ভুতুড়ে কোনো রেলস্টেশনের গল্প শোনাচ্ছে। পরবর্তী সময়ে ২০১৪ সালের দিকে স্থানীয় কমিউনিটি ও আইরিশ ইতিহাস গবেষণা সংস্থা এটিকে সংরক্ষণের উদ্যোগ নেয়। পুরো রেলট্র্যাকটাকে বিন্দুমাত্র ক্ষতি হতে দেয়নি তারা। সাইক্লিং ও হাঁটার জন্য তৈরি করা হয় ৪২ কিলোমিটার পিচঢালা পাকা সড়ক। নিষিদ্ধ করা হয় মোটরযান চলাচল। শুধু স্বাস্থ্যসচেতন নাগরিকদের হাঁটা ও সাইক্লিংয়ের জন্যই এই রাস্তা বরাদ্দ রাখা হয়েছে। রয়েছে ক্লান্ত পথচারীদের বসার স্থান।

পেছনে গলফ ক্লাব থাকার কারণে আড্ডাপ্রিয় আয়েশি মোউট শহরবাসীর কাছে এটি হয়ে উঠেছে বিনোদনের কেন্দ্রও। পরিচ্ছন্ন করে সাজানো এই স্টেশনে প্ল্যাটফর্ম রয়েছে ডামি হিসেবে। এ ছাড়া সিগন্যাল গেট, সিগন্যাল বাতি, সাধারণ ল্যাম্পপোস্ট, যাত্রী বিশ্রামাগারসহ সবকিছুই রাখা হয়েছে, যখন এটি সচল ছিল, ঠিক তখনকার মতো করে। পাশাপাশি মোউট ফ্যামিলি স্টেশন নামে একটি কর্নারও রাখা হয়েছে পরিবারের সবাইকে নিয়ে বসার জন্য। পারিজাত ফুলের সৌজন্যে স্টেশনের প্রতিটি কর্নার একেবারে সুশোভিত। স্টেশনের দেয়ালে দেয়ালে আঁকা রয়েছে আইরিশ প্রকৃতির কাব্যগাথা গ্রাফিতি। এমনকি সেই সময়ের পথচারীদের জন্য তৈরি ওভারপাসটিও যত্ন করেই সংরক্ষণ করা হয়েছে। ঐতিহাসিক স্থাপনাটির বর্তমান সৌন্দর্যে আপনি মুগ্ধ হতে বাধ্য।

ঘুরেফিরে এই স্টেশন দেখে, ইতিহাস জানার ইচ্ছায় দিনটা ভালো কাটল
ছবি: লেখকের সৌজন্যে

এই গল্প বলার আরও একটি কারণ রয়েছে। আমাদের দেশেও এ রকম ঐতিহাসিক রেলস্থাপনা একেবারে কম নেই। বন্ধ হয়ে যাওয়া ব্রিটিশ আমলের রেলস্টেশনও খুঁজে পাওয়া খুবই প্রতুল বাংলাদেশে। সেগুলোকেও চাইলে বাংলাদেশ সরকার এভাবে সংরক্ষণের উদ্যোগ নিতে পারে। তবে সেটি বাস্তবসম্মত কি না, তা প্রথমে একটু বিবেচনা এবং তারপর গবেষণা করে দেখতে হবে।

ঘুরেফিরে এই স্টেশন দেখে, ইতিহাস জানার ইচ্ছায় দিনটা ভালো কাটল। পরের ভ্রমণ গল্পটাও তোলা থাকল বন্ধুদের জন্য। তার আগপর্যন্ত অপেক্ষা করতে হবে!

ওয়েস্টমিথ কাউন্টি, আয়ারল্যান্ড