আইরিশ প্রান্তরে প্রকৃতির সঙ্গে কথোপকথন

বর্তমানে আয়ারল্যান্ডে বসবাস করছেন বন্ধুসভা জাতীয় পরিচালনা পর্ষদের সাবেক অর্থ সম্পাদক সজল মিত্র রিচার্ড। ঘুরে দেখছেন দেশটির সব দর্শনীয় স্থান। সেসব নিয়ে বন্ধুসভার পাঠকদের জন্য লিখেছেন তিনি। আইরিশ নৈসর্গিক রূপকথার ধারাবাহিক পর্বের প্রথম গল্পে থাকছে আয়ারল্যান্ডের লংফোর্ড কাউন্টির উষ্ণোই হিলের কথা।

আয়ারল্যান্ডের লংফোর্ড কাউন্টির উষ্ণোই হিলে লেখকছবি: লেখকের সৌজন্যে

এ যেন এক স্বপ্নের রাজ্য। পৃথিবীর সবুজ সৌন্দর্য দেখার এক অনন্য অভিজ্ঞতা। সামনে কিছুটা দূরত্বে বিছানো নয়নাভিরাম ঘাসের গালিচা। বলা হচ্ছে আয়ারল্যান্ডের উষ্ণোই পাহাড়ের কথা।

আয়ারল্যান্ডের রাজধানী ডাবলিন। আটলান্টিকের তীরে অবস্থিত এই দ্বীপ দেশটির সবচেয়ে ব্যস্ত শহর। যেকোনো জায়গায় আপনাকে যেতে হলে এই শহরে হয়তো ট্যাক্সি, নয়তো বাসের শরণাপন্ন হতে হবে। বাস সার্ভিস খুবই পরিষ্কার-পরিছন্ন। যদিও গন্তব্যে পৌঁছাতে সময় একটু বেশি লাগবে। খুবই নিয়মানুবর্তিতার দেশ আয়ারল্যান্ডে যেকোনো কিছুতেই একটু দেরি করলে সব শেষ। মিস করবেন অনেক কিছু। সময়ানুবর্তিতার জায়গায় সাবধানী হওয়া ছাড়া বিকল্প নেই। সে ক্ষেত্রে ট্যাক্সিই সেরা। ভাড়া আকাশচুম্বী, তবে চলতে পারবেন নিজের সময় অনুযায়ী।

ডাবলিন থেকে লংফোর্ডের দূরত্ব প্রায় ১১৯ কিলোমিটার। মহাসড়ক ধরে এই দূরত্বে ট্যাক্সি কিংবা বাসে প্রায় ১ ঘণ্টা ৪৫ মিনিটের মতো লাগার কথা। তাই সকাল সকালই বের হয়ে পড়লাম। ট্যাক্সিযোগেই রওনা হলাম। ভাড়াটা চোখ ছানাবড়া করার মতো হলেও রাজি হয়েছি। ২৫০ ইউরো (বাংলাদেশি মুদ্রায় প্রায় ৩৬ হাজার টাকা)। মাঝে ১ ঘণ্টা পর একটি কফিশপে যাত্রাবিরতি করি। এখানকার মহাসড়কের একটি বড় বিষয় হলো—আশপাশে কোনো দোকানপাট কিংবা রেস্টুরেন্ট নেই। মহাসড়কের পথ ধরে মাঝেমধ্যেই ছোট ছোট শহরে ঢুকে পড়তে হবে। সেখানেই মিলবে কফিশপের দেখা।

যাহোক, দুপুরের আগেই পৌঁছে গেলাম উষ্ণোই পাহাড়ে। ১০ ইউরোর মতো লাগে টিকিট কেটে ভেতরে প্রবেশ করতে। সেই সঙ্গে একটি অনুমতিপত্রও তাদের কাছে জমা দিতে হবে। আমার সঙ্গীরা স্থানীয় পর্যটক। সবাই আগে থেকেই ই-মেইলের মাধ্যমে অনুমতি নিয়ে রেখেছিলাম। তাই কোনো কাঠখড় পোহাতে হয়নি।

প্রাকৃতিক সৌন্দর্য উপভোগের নেশায় একেবারে বুঁদ হয়ে ছিলাম কয়েকটি ঘণ্টা
ছবি: লেখকের সৌজন্যে

এটিকে পাহাড় না বলে বরং পাহাড়ি এলাকা বলা যায়! একগুচ্ছ পাহাড়ের সমন্বিত রূপ। হেঁটে হেঁটে যতটুকু দেখতে পারবেন, দেখবেন। যাঁদের অভ্যাস নেই, তাঁরা এই পাহাড়ি এলাকায় খুব বেশি সময় ধরে হাঁটতে পারবেন না। যাঁরা হাইকিং করতে অভ্যস্ত, তাঁদের খুব ভালো লাগবে। পাহাড়ের রাস্তা ধরে হাঁটতে হাঁটতে চোখে পড়বে পাহাড়ি জঙ্গল, বিস্তীর্ণ মাঠ এবং ছোট্ট লেক। এটিকে বিভিন্ন সময়ে শুটিং স্পট হিসেবেও ব্যবহার করা হয়। আশির দশকে বিশ্বব্যাপী জনপ্রিয়তা পাওয়া রিটা কনোলির আইরিশ গান ‘রিপলস ইন দ্য রকপুল’ গানটির মিউজিক ভিডিও এখানেই ধারণ করা হয়েছিল।

হাঁটতে হাঁটতে একটা সময় সর্বোচ্চ শৃঙ্গে পৌঁছে যাই। এই জায়গাটিই সবচেয়ে বেশি ভালো লাগে। উষ্ণোই পাহাড়ের মূল বিশেষত্ব হচ্ছে—এর সর্বোচ্চ চূড়া থেকে একবার ৩৬০ ডিগ্রি ঘুরলে আয়ারল্যান্ডের ২৬টি কাউন্টির মধ্যে ২০টি কাউন্টিকে একসঙ্গে দেখতে পাওয়া যায়। আমরাও দেখলাম। ঈশ্বর যেন নিজ হাতে সাজিয়েছেন অপরূপ এই প্রকৃতিকে। এই সৌন্দর্য উপভোগের জন্যই ভ্রমণপিপাসুরা এখানটায় আসেন। অনেকে বিছানার চাদর বিছিয়ে এখানেই সেরে ফেলেন তাঁদের ভোজন। আমরাও সেই প্রস্তুতি নিয়ে আসি। দুপুরের খাবার বনভোজনের মতো করেই সবুজ ঘাসের ওপর চাদর বিছিয়ে সেরে নিলাম।

খাওয়ার পর্ব শেষ করে আবার ঘোরাঘুরির পালা। একটি জিরো পয়েন্ট রয়েছে। সেখানে একটি বিশেষ জায়গাকে গোল করে কাঠের টুকরা দিয়ে একটু আলাদাভাবেই বাঁধাই করে রাখা। কথিত আছে—এই জায়গা থেকে পুরো আয়ারল্যান্ডের সব জায়গার দূরত্ব মোটামুটি সমান; অর্থাৎ এটিই আয়ারল্যান্ডের জিরো পয়েন্ট। অবশ্য কিছু মানুষের মুখে এর বিরোধিতাও শোনা গেল। স্থানীয় না হওয়ার কারণে এই বিতর্কে না জড়িয়ে প্রাকৃতিক সৌন্দর্য উপভোগে মনোযোগী হলাম। তবে মতের বিরোধীরাও স্বীকার করল যে কেন্দ্রটি আরেকটু দূরে, তবে আশপাশেই।

আইরিশ জিরো পয়েন্টের আশপাশে রয়েছি, সেটিই আমার কাছে ছিল পরম তৃপ্তির। সেই জায়গা থেকে ৫০০ মিটার এগোলেই দেখা মিলবে একটি বড় পাথরের। এটি বিখ্যাত একটি জায়গা, যার সঙ্গে জড়িয়ে আছে আয়ারল্যান্ডের স্বাধীনতার ইতিহাস। ১৯১৬ সালে যখন আইরিশরা ব্রিটিশদের কাছ থেকে স্বাধীনতা অর্জন করে তখনকার সময়ে আইরিশদের স্বাধীনতা আন্দোলনের অন্যতম রূপকার ছিলেন মাইকেল কলিন্স। তিনি এই পাথরের ওপর দাঁড়িয়ে একটি ভাষণ দিয়েছিলেন। অনেকটা উঁচু স্থান বলেই জায়গাটিকে বেছে নিয়েছিলেন তাঁরা। যেখান থেকে মানুষ অনুপ্রাণিত হয়ে ব্রিটিশদের এই অঞ্চল থেকে বিতাড়িত করতে উদ্বুদ্ধ হয়েছিলেন। প্রায় ১১০ বছর পুরোনো এই পাথরটি এখনো সংরক্ষণ করে রেখেছে আইরিশ ইতিহাস ও গবেষণা ইনস্টিটিউট।

সব দেখলাম। প্রাকৃতিক সৌন্দর্য উপভোগের নেশায় একেবারে বুঁদ হয়ে ছিলাম কয়েকটি ঘণ্টা। এবার ফেরার পালা। সেখান থেকেই ফিরতি যাত্রায় ডাবলিন, ট্যাক্সিযোগে। ভালো লাগার কিছু মুহূর্ত কাটিয়ে যে মহাসড়ক ধরে ফিরছি, তার দুপাশের দৃশ্যও অসাধারণ। দিনটা ভালো কাটল।

ওয়েস্টমিথ কাউন্টি, আয়ারল্যান্ড