করোটির কথামালা (পর্ব ১৫)

প্রতীকীছবি: এআই/বন্ধুসভা
লুইস তোমাকে ডিনার করাতে পারিনি; কিন্তু তোমাকে ভালোবাসা জানাতে ভুল করিনি। তুমি বেঁচে থাকো ডায়েরির পাতায়, ভালোবাসার আকর হয়ে।

এ মুহূর্তে এ লেখা লিখতে না বসলে নিজের স্মৃতির সঙ্গে প্রতারণা করা হবে, ভীষণভাবে কষ্ট দেওয়া হবে লুইসের আত্মাকে। আসলেই কি লুইসের আত্মা এই মুহূর্তে আছে আমার সঙ্গেই?

এই নীরব ঘরেই কি লুইস দেখতে পাচ্ছে কেমন আকুল হয়ে ফিরলাম ওর ফিউনারেল অনুষ্ঠান থেকে? লুইস কি আমাকে ক্ষমা করে দিল? ওকে যে বলেছিলাম একদিন রাতে ডিনার করাব, তার আগেই তো লুইস চলে গেল সব ছেড়ে। মানুষ চলে গেলে কি আসলেই চলে যায় নাকি থেকে যায় অন্য কোনো কর্মের ভেতর দিয়ে?

নাইয়াকে নিয়ে বের হয়েছি সেই দুপুর সাড়ে ১২টায়। অনেক দিন ধরে নাইয়া একটা ট্যাটু করবে বলে ঘ্যান ঘ্যান করে টাকা চাইছিল। গত পরশু অফিস থেকে ফিরে বললাম, তোমাকে এক শর্তে টাকা দেব— রোববারে আমার সঙ্গে লুইসের ফিউনারেল প্রোগ্রামে যেতে হবে। সেই কথায় কাজ হলো। যাত্রা শুরু করলাম মা-ছেলে। গত ১৪ বছরে আমি কোনো দিন এমন প্রোগ্রামে যাইনি, আসলে জীবনেও কোনো দিন এমন অনুষ্ঠানে যাইনি। প্রাথমিক নির্দেশ নাইয়ার কাছ থেকেই আসে। বাবু জানায়, ‘মা, তোমাকে কালো ফরমাল ড্রেস পরতে হবে এবং একদম ফরমাল হয়ে যেতে হবে।’

একটা ভারী বুট এই জার্নিকে কঠিন করে দেয়। যতটা পথ হাঁটতে হবে বলে নাইয়া বলেছিল তার চেয়ে ১০ গুণ বেশি হাঁটতে হয়েছে। পথে কয়েকবার বাবুকে ধাক্কাই—আর কত দূর? বরফে ঢাকা ১৬০ বেক্রফ সিমেট্রিতে প্রবেশ করে অবাক লাগে, চারপাশে ছোট ছোট পাথরের ফলক লাগানো, সার দেওয়া সিমেট্রি এরিয়া, কী ভীষণ পরিচ্ছন্ন আর গোছানো কবরখানা; ৬ ইঞ্চি পুরু বরফের নিচে কি কোথাও লুইসের নিথর দেহ পড়ে আছে?

নাইয়া জোরে হাঁটছে, আমি ওর পিছে। বুক হিম হয়ে আসে—কোনো অচেনা দূর দেশে মরণ হবে আমার, লাশ কি যাবে বাবা-মায়ের কাছে? ভালোবাসার মানুষেরা কি একসঙ্গে বসে আমার কথা বলবে কোনো দিন? বিচ্ছিন্ন ভাবনায় একসময় ভিজিটেশন সেন্টারে প্রবেশ। নাইয়া সাবধান করে, ‘মা, খুব আস্তে আস্তে কথা বলবা।’

লুইস এ্যাস্তে অন্টে, ৭৩ বছর বয়সী গোঁড়া ক্যাথলিক লুইস আমাদের কষ্টির সহকর্মী ছিল। কষ্টি ইমিগ্রান্ট সার্ভিসের ১৭টা ব্রাঞ্চ অফিস আছে এই টরন্টো শহরে। ১৫ বছরের চাকরিজীবনে অনেকগুলো ব্রাঞ্চে কাজ করেছে লুইস। তাই সুপরিসর, চকচকে সাজানো ফিউনারেল ঘরে প্রবেশ করেই কষ্টির বেশ কয়েকজন সহকর্মী চোখে পড়ে।

আরও পড়ুন

সবচেয়ে বেশি চোখে পড়ে তিনজন হাই অফিশিয়াল ডিরেক্টরকে। এই বিশ্রী বাজে স্যাঁতসেঁতে আবহাওয়াকে মারিয়ে এরাও এসেছে? নিজের মনকে প্রবোধ দিই, একদম মনের নিভৃত কূপমণ্ডূক বাঙালি মন—নিজে লুইসের সঙ্গে ৯ মাস কাজ করে জানি কষ্টিতে সে একজন সামান্য অ্যাডমিন স্টাফ হিসেবে কাজ করত; তবু ওকে সম্মান জানাতে এতগুলো ডিরেক্টর হাজির হয়েছে? একটু কি বেশি অহংকার করছিলাম নিজের অফিস নিয়ে? লুইসের দুই ছেলে যাদের বয়স ৪৫-এর ওপরে—ওরা মায়ের অনুষ্ঠান শুরু করে সবাইকে বিনীত ধন্যবাদ দিয়ে।

কথা বলছিল লুইসের বড় ছেলে মারকেল; মায়ের জীবনী পড়ছিল ছেলে, লিখে নিয়ে এসেছে নোট। আসলেই কি লুইসের জীবনী নাকি আমার? একা মা বড় করেছেন দুই সন্তানকে। চিলির যুদ্ধে সব শেষ হয়ে যাওয়ার পড়ে, একজন নতুন অভিবাসী হিসেবে কী করে দুই ছেলেকে নিয়ে কানাডায় এসে লুইস নতুন করে জীবন শুরু করেছিল—একদম শূন্য হাতে, একদম একা দাঁড়িয়ে। কতটা সাহসী ছিল ৭৩ বছর বয়সী লুইস, কী করে মানুষকে ভালোবাসত, কীভাবে আশপাশের মানুষকে জড়িয়ে এত আনন্দ নিয়ে লুইস বেঁচে ছিল, কমিউনিটির সঙ্গে লুইসের কী গভীর যোগাযোগ ছিল—সেসব ছোট ছোট টুকরো গল্প করছে ৫০ বছর বয়সী ছেলে মারকেল, দূরে দাঁড়ানো ছোট ছেলে মেগান ফোঁপাচ্ছে। অদ্ভুত পিনপতন নীরবতা চারপাশে, অনর্গল চোখ মুছছি দেখে নাইয়া কখন আমার হাত ওর কোলে নিয়ে চেপে ধরে বসে আছে টের পাইনি। যখন সংবিৎ ফিরে পেলাম তখন অনুষ্ঠান শেষের দিকে। প্রায় দেড় ঘণ্টার ওপরে এই সেশনে বসে থেকে মনে হলো—লুইস মরে যায়নি, আমি মরে গেছি—নাইয়া কি আমাকে নিয়ে কথা বলতে পারবে? মারকেলের কাছ থেকে কি কাগজের কপিগুলো নিয়ে রাখব? নাইয়ার হয়তো নতুন করে সবটা লিখতে হবে না!

বাসস্টপ থেকে নাইয়ার সঙ্গে পথ ভিন্ন হয়ে যায়। নাইয়া একবার জানতে চায়, ‘মা, তুমি পাস অ্যাওয়ে করলে কি এমন প্রোগ্রাম চাও?’ কী বলব ২০ বছরের ছেলেকে? লুইস যদি ৭৩ অবধি বাঁচে, তাহলে হয়তো এখনো কিছু সময় আছে আমার হাতে। এই ভিনদেশে মানুষ আমার মৃত্যুর পরে এত খানি শ্রদ্ধা করে কথা বলবে, সেটা আসলেই এত সহজ হবে? কতটা সম্মান এই জীবনে করেছি আমি অন্য মানুষকে? করোটির গোপন রন্ধ্রে রন্ধ্রে নিজেকে কাঠগড়ায় দাঁড় করাই। বাসে বসে আছি, বাইরে তীব্র শীতের বাতাস, জ্যাকেটের পকেটে ফোন বেজে ওঠে।

আমার অন্য এক প্রিয় বন্ধু শিরিন খালা। রক্তের খালা না, কিন্তু ভালোবাসার বন্ধন। লুইস যেমন বেঁচেছিল অনাত্মীয় প্রিয়জনদের নিয়ে—৭৩ বছর বয়সী শিরিন খালাও আমার সেই ভালোবাসার বন্ধনে গড়া বন্ধু। আমার সেলফোনে সেভ করা খালার নাম ‘বন্ধু শিরিন’। গত পাঁচ বছরে দেখা হয়েছে মাত্র দুইবার; কিন্তু খালা জানেন আমার জীবনের ওঠানামা, আমার জীবনের গতিপথ আর খালার গতিপথ একসুতায় বাঁধা। খালার কাছে কাঁদতে থাকি। খালা বলেন, ‘লুনা, লুইসকে নিয়ে যা যা বললে সব লিখে ফেলো—আমি অপেক্ষা করে আছি, তোমার অনুভূতি পড়ব।’

এই অপেক্ষা ভালোবাসার। লুইস তোমাকে ডিনার করাতে পারিনি; কিন্তু তোমাকে ভালোবাসা জানাতে ভুল করিনি। তুমি বেঁচে থাকো ডায়েরির পাতায়, ভালোবাসার আকর হয়ে।

২৪ ফেব্রুয়ারি ২০১৯

টরন্টো, কানাডা